Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২০ মে, ২০২৪,

অনুপ্রবেশ চেষ্টায় সীমান্তে চাকমা ও রোহিঙ্গাদের অবস্থান

মর্টার শেলে বাংলাদেশে নিহত দুই

নুর মোহাম্মদ মিঠু ও নাইক্ষ্যংছড়ি প্রতিনিধি

নুর মোহাম্মদ মিঠু ও নাইক্ষ্যংছড়ি প্রতিনিধি

ফেব্রুয়ারি ৬, ২০২৪, ১২:৩২ এএম


মর্টার শেলে বাংলাদেশে নিহত দুই
  • সশস্ত্রবাহিনী ও বিজিবিকে ধৈর্য ধারণের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর
  • ঘরবাড়ি ছেড়েছে ঘুমধুম সীমান্তের তিন গ্রামের বাসিন্দা
  • অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে বিজিবি সাগরে প্রস্তুত কোস্ট গার্ড

বিজিপি সদস্যদের ফিরিয়ে নিতে যোগাযোগ করছে দেশটি —পররাষ্ট্রমন্ত্রী

যখনই সংঘাতের সূত্রপাত ঘটে মিয়ানমারে, তখনই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বাংলাদেশে। কথায় কথায় অনুপ্রবেশ যেন স্বাভাবিক বিষয়ে রূপ নিচ্ছে। চলমান সংঘাতেও একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে দেশটির ১০৬ জন সীমান্তরক্ষী বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। আরও ৪০০ জন চাকমা এখন অনুপ্রবেশের অপেক্ষায়। পাশাপাশি কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গাও সীমান্তে জড়ো হচ্ছে। এর চেয়েও বেশি আতঙ্কিত হওয়ার মতো খবর হচ্ছে— মিয়মানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে গতকাল বাংলাদেশি হোসনে আরা নামে এক নারী ও আশ্রিত এক রোহিঙ্গা নাগরিক নিহত হয়েছেন। রান্নাঘরে এসে পড়া মর্টার শেলের আঘাতে মারা যান তারা। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সীমান্তবর্তী পাঁচটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ চলমান এই সংঘাতের নেতিবাচক প্রভাব আরও বাড়তে পারে। কারণ দেশটিতে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে তাদের জীবন। 

এদিকে এখন পর্যন্ত দেশটিতে ৬২ জন সেনা হত্যা করে একের পর এক ঘাঁটি দখলে নিচ্ছে বিদ্রোহীরা। ফলে বিদ্রোহীদের সঙ্গে জান্তা বাহিনীর সংঘাত আরও বাড়ছেই। সংঘাতে জীবনের ঝুঁকিতে এড়াতে যেকোনো মূল্যে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করছে তারা। বর্তমান এই পরিস্থিতি এড়াতে এবং সামনে পরিস্থিতির আরও অবনতি যেন না ঘটে সে জন্য সার্বিক পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বাংলাদেশ। সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও গতকাল সশস্ত্রবাহিনী ও বিজিবিকে ধৈর্য ধারণের নির্দেশ দিয়েছেন। 

চলমান সংঘাতে দেশটির দুই বাহিনীর গোলাগুলি ও মর্টার শেলের বিকট শব্দ আর গতকাল দুজন নিহতের ঘটনায় ভীতিকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে সীমান্তজুড়ে। গোলাগুলির মুহুর্মুহু শব্দে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ঘর ছেড়েছেন ঘুমধুম ইউনিয়নের তিন গ্রামের মানুষ। এরই মধ্যে টেকনাফের হোয়াইক্যং উলুবনিয়া সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের সময় এক রোহিঙ্গা পরিবারকে আটক করেছে বিজিবি। সূত্র বলছে, চলমান পরিস্থিতিতে সীমান্তের ওপারে বসবাস করা মিয়ানমারের চাকমা জাতি ও রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় জড়ো হচ্ছে। তবে বিজিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সীমান্তে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় সতর্ক অবস্থানে রয়েছে তারা। এদিকে সীমান্তে মর্টার শেলে দুজন নিহত হওয়ার ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছে বিজিবি। টেকনাফের ইউএনও আদনান চৌধুরী বলেন, ওপার থেকে রোহিঙ্গা ও বিজিপি সদস্যরা পালিয়ে বাংলাদেশে আসতে পারে— এমন আশঙ্কায় সীমান্তে বিজিবি সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন। সাগরে কোস্টগার্ড সদস্যরাও প্রস্তুত রয়েছেন। কোনো অবস্থাতেই আমরা রোহিঙ্গা কিংবা অন্য কাউকে ঢুকতে দেবো না। টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, সীমান্তে আমরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছি। 

৩৪ বিজিবি কক্সবাজার রিজিয়ন কমান্ডার লে. কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মাশরুকী বলেন, কোনো অবস্থাতেই মিয়ানমারের কোনো নাগরিককে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে দেয়া হবে না। বিজিবি কক্সবাজার রিজিওয়নের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোরশেদ আলম বলেন, মিয়ানমার অভ্যন্তরে চলা সংঘাতের কারণে আমরা সদর দপ্তরের অনুমতিক্রমে ১০৬ জন বিজিপি সদস্যকে আশ্রয় দিয়েছি। তাদের মিয়ানমার হস্তান্তর করার জন্য পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাজ করছে। তিনি আরও বলেন, জলপাইতলীতে দুজন সাধারণ নাগরিক নিহতের ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা এ ব্যাপারে তাৎক্ষণিকভাবে মিয়ানমার সরকারকে প্রতিবাদ জানিয়েছি। কক্সবাজার রোহিঙ্গা ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর উচিত আরাকান রাজ্যে আটকেপড়া চাকমা ও রোহিঙ্গাদের সাহায্য করা। কিন্তু মিয়ানমারের ক্ষেত্রে সহযোগিতা না করে বাংলাদেশে স্থান দেয়ার কথা বলে। অনেক সময় বাংলাদেশের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। এটি অবান্তর। 

সীমান্তের বাসিন্দারা বলছেন, রোববার রাত থেকে সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর ঢেঁকিবনিয়া থেকে তীব্র গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসছে। সেখানে রাখাইন রাজ্যের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ) বিজিপির ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরে হামলা চালালে এ লড়াই শুরু হয়। লড়াইয়ে উভয় পক্ষ মর্টার শেল, রকেট লাঞ্চার, মেশিনগানসহ ভারী অস্ত্র ব্যবহার করছে। এর আগে রোববার বিজিপির আরেকটি চৌকি তুমব্রু রাইট ক্যাম্প আরাকান আর্মি দখল করে বলে জানা গেছে। ওই চৌকি থেকে ঢেঁকিবনিয়ার দূরত্ব মাত্র দুই কিলোমিটার। স্থানীয় সূত্রের ভাষ্য অনুযায়ী, এর আগে গত ২৯ ও ৩১ জানুয়ারি ঘুমধুম সীমান্তের ওপার থেকে গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। সে সময় মর্টার শেল ও গোলার অন্তত চারটি অংশ তুমব্রু, কোনারপাড়া ও পশ্চিম ঘুমধুমে এসে পড়ে। 

বিজিবি ও পুলিশ সূত্র বলছে, সংঘর্ষের মধ্যে রোববার ভোরে বিজিপির ১৪ সদস্য সীমান্তের ওপার থেকে নাইক্ষ্যংছড়িতে পালিয়ে আসে। এর কয়েক ঘণ্টা পর একই সীমান্ত দিয়ে বিজিপির আরও ৫৪ সদস্য পালিয়ে আসে। বিজিবি তাদের নিরস্ত্রীকরণ করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে আহত ১৫ সদস্যকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৮৩ কিলোমিটার। এর বড় অংশ পড়েছে বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলায়। কয়েক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় যুদ্ধ জোরালো করেছে আরাকান আর্মিসহ কয়েকটি গোষ্ঠী। তারা সম্মিলিতভাবে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। এর মধ্যে কোনো কোনো সীমান্ত শহর দখল করে নিয়েছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা এ সংঘাতের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় সতর্ক অবস্থানের কথা জানিয়েছে কক্সবাজার ও বান্দরবানের জেলা প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দুজন নিহতের ঘটনায় নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ওসি আবদুল মান্নান জানান, দুপক্ষের গোলাগুলির সময় মর্টার শেল এসে বিস্ফোরিত হয়েছে। তখন ঘটনাস্থলে দুজন নিহত হয়েছেন। তবে হেলিকপ্টার থেকে বোমা মারার সময় গোলাটি এসে পড়েনি বলে মন্তব্য করেন তিনি। 

গতকালও দেশটির বিদ্রোহী দমনে তাদের অবস্থান লক্ষ্য হেলিকপ্টার থেকে বোমা হামলা করেছে জান্তা বাহিনী। একদিকে বিদ্রোহীদের জান্তা বাহিনীর ঘাঁটি দখল, অপরদিকে জান্তা বাহিনীর আক্রমণে তোপের মুখে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের ঘটনার মধ্যেই বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের জলপাইতলী গ্রামের একটি রান্নাঘরে মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে দুজন নিহত হয়েছেন। নিহত দুজনের মধ্যে একজন বাংলাদেশি নারী, অন্যজন রোহিঙ্গা পুরুষ। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে আট লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর কয়েক মাসে রাখাইন রাজ্য থেকে। রোহিঙ্গা ঢলের ছয় বছরেও একজন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। যদিও এর আগে দুবার প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয়া হলেও রোহিঙ্গাদের অনীহার কারণে তা ভণ্ডুল হয়েছিল। বর্তমানে সীমান্ত অতিক্রম করে মিয়ানমার থেকে কোনো রোহিঙ্গা অথবা অন্য কোনো সমপ্রদায়ের লোকজন যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য সীমান্তে বিজিবি টহল জোরদার করা হয়েছে। 

এদিকে গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, মিয়ানমার ইস্যুতে আর উদারতা দেখানোর সুযোগ নেই। কোনো অবস্থাতেই বাস্তুচ্যুতদের ঢুকতে দেয়া হবে না। সেখান থেকে নতুন কেউ বাংলাদেশে এলে তাকে গ্রহণ করা হবে না। ‘মিয়ানমার ইস্যুতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যকে সরকার ও দলের বক্তব্য উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ঘটনাস্থলের আশপাশে কয়েকটি গ্রাম নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে কথা বলবে। যতই উসকানি আসুক, আমরা প্রতিক্রিয়া দেবো না।’ গতকাল পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, বাংলাদেশে ঢুকে পড়া মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) সদস্যদের ফিরিয়ে নিতে সে দেশের সরকার যোগাযোগ করেছে। 

তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ আছে। গতকাল সকালেও মিয়ানমারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আমাদের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তারা তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। তাদের বর্ডার গার্ডের সদস্যদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। এখন তাদের উড়োজাহাজ, নাকি নৌকায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে, এ নিয়ে আমরা আলোচনার মধ্যে আছি।’
 

Link copied!