Amar Sangbad
ঢাকা রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪,

এক দিনেই শীর্ষ নেতাদের মুক্তি!

আবদুর রহিম

ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২৪, ০৮:০১ এএম


এক দিনেই শীর্ষ নেতাদের মুক্তি!
  • মির্জা ফখরুল, আমীর খসরু ও এ্যানীর জামিন  
  • এখনো কয়েক হাজার নেতাকর্মী কারাগারে
  • এক লাখ ৬২ হাজারের বেশি নেতাকর্মী আসামি
  • বিএনপিরই ২৮ হাজার নেতাকর্মী কারাগারে
  • হরতাল অবরোধ অসহযোগ আন্দোলন নিষ্ফল
  • আত্মগোপনে হাইকমান্ড মাঠে ছিল তৃণমূল

শীর্ষ নেতারা মুক্ত হওয়ার পর এখন মুক্তির পথ সৃষ্টি করা আবশ্যক 
— বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ ড. এটিএম নুরুল আমিন

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ে আটক হয়ে প্রায় সাড়ে তিন মাস পর দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, প্রচার সম্পাদক ও বিএনপি মিডিয়া সেল সদস্য সচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী একই দিন মুক্তি পেয়েছেন। এবার শুধু বিএনপিরই ২৮ হাজার নেতাকর্মীকে কারাগারে রেখে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। মামলা হয়েছে প্রায় ১২শ। আসামি এক লাখ ৬২ হাজারেরও বেশি ছিল। নির্বাচন সময়ে ক্ষমতাসীন দল ও প্রশাসনের আতঙ্কে এক কোটির বেশি নেতাকর্মী ঘরবাড়ি ছেড়ে বন-জঙ্গলে আত্মগোপনে ছিলেন। কারাগারে ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী, প্রায় ৬০ শতাংশ লোক বিএনপি নেতাকর্মী বলেও দাবি ছিল। এখনো কয়েক হাজার নেতাকর্মী কারাগারে। 

ওই সময়ে কয়েক ডজন শীর্ষ নেতা আটক হওয়ার পর দলটির প্রথম সারির হাইকমান্ডের সবাই আত্মগোপনে চলে যান। মাঠ পর্যায়ের নেতারা বিচ্ছিন্নভাবে আন্দোলন করে ঘরে কোনো ফসল তুলতে পারেননি। টানা হরতাল-অবরোধ-অসহযোগ আন্দোলন করেও আওয়ামী লীগকে ঠেকাতে পারেনি লম্বা সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি। ধারবাহিকভাবে ব্যর্থতার জন্য নেতৃত্বের দুর্বলতাকে চিহ্নিত করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞরা বলছেন, দেশের বেশির ভাগ জনগণ এবার ভোটকেন্দ্রে যায়নি। এর প্রভাব বিএনপি নির্বাচনে না যাওয়ার জন্যই হয়েছে। এখন বিএনপিকে গণতন্ত্র রক্ষা ও নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করতে এমন কিছু করা আবশ্যক, যাতে হতাশ নেতাকর্মীরা প্রাণ ফিরে পায় এবং রাজনীতিতে সৌন্দর্য ফিরে আসে।    

বিএনপি নেতাকর্মীদের মুক্তি প্রসঙ্গে গত ১৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য  ড. আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘বিএনপিকে ভোটে আনতে সব চেষ্টাই করেছে আওয়ামী লীগ। এমনকি এক রাতে সব নেতাকে জেল থেকে মুক্তির প্রস্তাবও দেয়া হয়েছে। বিএনপি এতে রাজি হয়নি। নির্বাচনে এলে ছাড় পেত বিএনপি।’ তার এই মন্তব্যের পর দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, বিএনপির আন্দোলনে জোট নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না, সাইফুল হক তারা তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, আওয়ামী লীগের এই নেতারা বক্তব্যের মাধ্যমে গ্রেপ্তার রহস্য জাতির সামনে উন্মোচিত হয়েছে। এ নিয়ে রাজনীতিতে আলোচনা-সমালোচনায় অনেক ঝড় বয়ে যায়। 

বিএনপির শীর্ষ নেতাদের মুক্তি ইস্যুতে জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিষয়ে চোখ রাখা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ ড. এ টি এম নুরুল আমিন আমার সংবাদকে বলেন, ‘বিএনপির শীর্ষ নেতাদের মুক্তির বিষয়টি অবশ্যই রাজনীতির জন্য ভালো খবর। এটি তাদের নেতাকর্মীদের উৎসাহিত করবে। রাজনীতিতে কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে। তবে এখনো দলটির হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাগারে । সরকারের উচিত তাদেরও মুক্তি দেয়া।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সবারই জানা, এবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি। দেশের বেশির ভাগ মানুষ এই নির্বাচন বর্জন করেছে। তবে শুধু এ নির্বাচন নয়, দলীয় সরকারের অধীনে অতীতের নির্বাচনগুলোও স্বচ্ছ হয়নি। জনগণের দ্বারা ভোটের মাধ্যমে নির্বাচনের পদ্ধতিটা আমাদের দেশ থেকে অনেকটাই চলে গেছে। আমাদের সবারই উপলব্ধি করা দরকার, এমন কোনো পরিস্থিতি যাতে তৈরি না হয়, যেখানে মানুষের মধ্যে অশান্তি হবে। এ  নির্বাচনে ভারত রাশিয়া কী করেছে তা অনেকেরই উপলব্ধি হয়েছে। তবে এটিও আমাদের জানা দরকার— এখন যারা সরকারপ্রধানে রয়েছেন তাদের পূর্বপুরুষরা ইংল্যান্ড-আমেরিকা পাশ্চাত্য আদর্শ অনুসরণ করে রাজনীতি করেছেন। এ দেশের বড় বড় অধিকাংশ নেতা পাশ্চাত্য দ্বারার রাজনীতি করেছেন। যারা জনগণের ভোটাধিকার গণতন্ত্রকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। আমাদের মানুষের ভাবনার চাওয়ার রাজনীতে ফিরে আসা আবশ্যক।’ এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক আরও বলেন, ‘নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী রাজনীতির যারা দীর্ঘ সময় কারাগারে ছিলেন তারা মুক্ত হওয়ার পর এখন একটা মুক্তির পথ সৃষ্টি করা আবশ্যক। যাতে নেতাকর্মীরা উন্মুক্তভাবে মত প্রকাশ করে তাদের অধিকার আদায় করতে পারে। রাজনীতির একটি সৌন্দর্যরূপে আবারও ফিরে আসতে পারে।’

গতকাল দলটির মহাসচিব মুক্ত হওয়ার পর খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে মহাসমাবেশের চার-পাঁচ দিন আগে থেকে গত সপ্তাহ পর্যন্ত প্রায় ২৩ হাজার নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছে। আসামি করা হয়েছে ৮০ হাজার। এ ছাড়া গত বছরের ২৮ ও ২৯ জুলাই থেকে সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী গ্রেপ্তার হয়েছেন ২৮ হাজার নেতাকর্মী। মামলার সংখ্যা প্রায় ১২শ। আসামি এক লাখ ৬২ হাজারেরও অধিক। ৮৪ মামলায়  ৯ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ ও  এক হাজার ২৯৪ জন নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছে বলেও দলটির পক্ষ থেকে দাবি। এখনো কয়েক হাজার নেতাকর্মী বন্দি। আইনজীবীরা তাদের মুক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।

মুক্তির পর ফখরুল-খসরু জে বার্তা দিলেন : গতকাল বিকেল ৩টা ৪৫ মিনিটে কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে প্রথমে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল এবং চার মিনিট পর স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান ফটকে উপস্থিত হলে নেতাকর্মীরা  করতালি দিয়ে তাদের নেতাদের বরণ করেন। কর্মীরা নেতাদের ফুলের পাঁপড়ি ছিটিয়ে ‘মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভাইয়ের ভয় নাই, আমরা আছি তোমার সাথে’, ‘আমীর খসরু ভাই এগিয়ে চলো আমরা আছি তোমার সাথে’, মহাসচিবের মুক্তি আন্দোলনের শক্তি, খসরু ভাইয়ের মুক্তি আন্দোলনের শক্তি’, ‘জিয়া, খালেদা, তারেক জিন্দাবাদ জিন্দবাদ’ ইত্যাদি স্ল্লোগান দিতে থাকে।’

নেতাকর্মীদের হাত তুলে অভিবাদন জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন,  বাংলাদেশের জনগণ সবসময় গণতন্ত্রের জন্য, ভোটের অধিকারের জন্য, ভাতের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করেছে, লড়াই করেছে। ইনশাআল্লাহ এই সংগ্রামে তারা জয়ী হবে। গণতন্ত্র ফেরানো চলমান আন্দোলন বিজয় না হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকার কথাও দৃঢ়তার সাথে বলেন বিএনপি মহাসচিব। পরে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী  বলেন,  ওরা রাষ্ট্রশক্তিকে কবজা করে ক্ষমতা দখল করেছে, বাংলাদেশের মানুষ তাদেরকে প্রত্যাখান করেছে। তারা নির্বাচনে নৈতিকভাবে জনগণের কাছে পরাজিত হয়েছে। আমরা বলতে চাই, গণতন্ত্রের আন্দোলন অটুট থাকবে। যদি দেশে গণতন্ত্র ফেরত না আসবে, জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার না আসবে ততদিন এই সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।’

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান ফটকে কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে তাইফুল ইসলাম টিপু, শামীমুর রহমান শামীম, নিপুণ রায় চৌধুরী, ফরহাদ হোসেন আজাদ, সাবেক সাংসদ আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়ম, ইসরাফিল খসরু চৌধুরী,  শায়রুল কবির খানসহ অঙ্গসংগঠনের কয়েকশ নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। মহাসচিবের গাড়িয়ে ছাত্রদলের নেতাকর্মী মোটরবাইকে কর্ডন করে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়। কারাগারে মুক্তির সময়ে বিএনপি মহাসচিবকে আনতে তার সহধর্মিণী রাহাত আরা বেগম, বিএনপি মহাসচিবের একান্ত সহকারী ইউনুস আলী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

গত ২৯ অক্টোবর গোয়েন্দা পুলিশ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে এবং ২ নভেম্বর দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে গুলশানে তাদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় এবং পরে ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশের দিন প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনায় পুলিশের করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখায়। ওই সংঘর্ষের ঘটনায় ফখরুলের বিরুদ্ধে ১১টি এবং খসরুর বিরুদ্ধে ১০টি মামলা হয়। এর মধ্যে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনাটি ছাড়া সব মামলায় তারা বিভিন্ন সময়ে জামিন পেয়ে যান। বুধবার ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক ফয়সল আতিক বিন কাদের প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনার মামলায় বিএনপি এই দুই শীর্ষ নেতার জামিন মঞ্জুর করেন। গতকাল সকালে দুই নেতার আইনজীবীরা বিভিন্ন মামলার জামিন আদেশ, প্রোডাকশন ওয়ারেন্টসমূহ প্রত্যাহারের আদেশসমূহ সব ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেয়ার পর বিকেলে মুক্তি পেলেন বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা।

জাতীয় নির্বাচনের আগে ‘সরকার পতনের’ এক দফা দাবিতে ২৮ অক্টোবর সমাবেশ ডেকেছিল বিএনপি। সেদিন দুপুরের আগে নয়াপল্টন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ শুরুর পর কাছেই কাকরাইল মোড়ে দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হয়। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে শান্তিনগর, নয়াপল্টন, বিজয়নগর, ফকিরাপুল, আরামবাগ ও দৈনিক বাংলা মোড় এলাকা রণক্ষেত্রে রূপ নেয়। সংঘর্ষের মধ্যে পুলিশ বক্সে আগুন দেয়া হয়। পুলিশ হাসপাতালে ঢুকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে আগুন দেয়া হয়, ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ করা হয় আরও ডজনখানেক যানবাহন। হামলা করা হয় প্রধান বিচারপতির বাসভবনে। দৈনিক বাংলা মোড়ে পুলিশ কনস্টেবল আমিরুল ইসলাম পারভেজকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সংঘাতে প্রাণ যায় যুবদলের মুগদা থানার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের নেতা শামীম মোল্লার।
 

Link copied!