Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪,

৪০ লাখ ছাড়িয়েছে এলপিজি ব্যবহারকারী

ক্রমেই বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকি

মহিউদ্দিন রাব্বানি

মার্চ ২০, ২০২৪, ০৩:০২ পিএম


ক্রমেই বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকি
  • সিলিন্ডার মান নিয়ন্ত্রণে নেই কোনো সংস্থা
  • প্রতিদিন গড়ে দুটির বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে
  • বিস্ফোরণ নয়, লিকেজ থেকেই ঘটছে দুর্ঘটনা
  • গত বছর সিলিন্ডার থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ১২৫টি
  • পান, মুদি ও ওষুধের দোকানেও বিক্রি হচ্ছে এলপিজি

লিকেজ থেকে আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে  ব্যবহারকারীদের সচেতন হতে হবে
—মো. নূরুল আমিন, চেয়ারম্যান, বিইআরসি

ভঙ্গুর ও ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাসসিলিন্ডার সরবরাহের ফলে ঘটছে দুর্ঘটনা
—এম শামসুল আলম, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, ক্যাব

রান্নার কাজে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এলপি গ্যাস। তবে অসাবধানতা ও ত্রুটিপূর্ণ ব্যবহারে বাড়ছে দুর্ঘটনা। বেশ কয়েকটি বড় দুর্ঘটনার পরও যত্রতত্র গ্যাসসিলিন্ডার বিক্রি ও ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। আবাসিক খাতে চাহিদা অনুযায়ী কোম্পানিগুলো গ্যাস সরবরাহ করতে না পারায় অনেকে বাধ্য হয়ে সিলিন্ডার গ্যাসে ঝুঁকছেন। তাই দিন দিন বাড়ছে এলপিজি-নির্ভরতা। বর্তমানে দেশে এলপি গ্যাসসিলিন্ডার ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪০ লাখেরও বেশি। এই গ্যাসের ৮৪ শতাংশ ব্যবহূত হয় রান্নার কাজে। কিন্তু ব্যবহারবিধি না মানায় এবং অসচেতনতায় বারবার ঘটছে দুর্ঘটনা।

প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে আসছে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশে গ্যাসসিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ৮৯৪টি। অর্থাৎ দিনে গড়ে দুটির বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ দুর্ঘটনাগুলো মূলত গ্যাস লিকেজ থেকেই ঘটে। সিলিন্ডারের হোসপাইপ, রেগুলেটর, গ্যাস ভালভের মতো গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশের ত্রুটির কারণে গ্যাস লিক হয়। সেই লিকেজ থেকে গ্যাস বেরিয়ে বাইরে কোথাও জমতে থাকে। পরে তা সামান্য আগুন, এমনকি স্ফুলিঙ্গের সংস্পর্শে আসতেই জমে থাকা সেই গ্যাস ভয়াবহ বিস্ফোরণ সৃষ্টি করে।
বিস্ফোরক অধিদপ্তরসহ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্ঘটনা এড়াতে সচেতনতার বিকল্প নেই। 

সিলিন্ডারের মধ্যে এলপি গ্যাস যে চাপ তৈরি করে, মানসম্পন্ন সিলিন্ডারে তারচেয়ে চারগুণ বেশি চাপ সহ্য করার সক্ষমতা রয়েছে। ফলে  সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কম। নজিরও তেমন নেই। গাজীপুরে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়নি। লিকেজ থেকে গ্যাস বের হয়ে আগুন ধরে যায়। এ জন্য সিলিন্ডারের সঙ্গে যে রেগুলেটর, হোসপাইপ, চুলাসহ অন্যান্য জিনিস ব্যবহূত হয়, সেগুলো মানসম্মত হতে হবে। এই অনুষঙ্গগুলো সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করায় লিকেজ থেকে গ্যাস বেরিয়ে অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটছে। গ্যাসসিলিন্ডার ব্যবহারে ‘রুলস অ্যান্ড রেগুলেশন’ কঠোরভাবে মানার বিকল্প নেই।

সম্প্রতি গাজীপুরের কালিয়াকৈরে গ্যাসসিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১০ জনে। এর আগে ১৩ মার্চ সন্ধ্যায় কালিয়াকৈর উপজেলার তেলিচালা এলাকায় গ্যাসসিলিন্ডার লিকেজের আগুন থেকে দগ্ধ হয়ে নারী-শিশুসহ ৩৪ জন হাসপাতালে ভর্তি হন। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) বলছে, ২০০৯ সালে দেশে এলপিজির চাহিদা ছিল ৬৫ হাজার টন। বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ১৪ লাখ টন। ২০০৯ সালে এলপিজি ব্যবহারকারী ছিল দুই লাখ ২৫ হাজার, বর্তমানে তা ৪০ লাখ। এসব এলপিজির ৮৪ শতাংশ রান্নার কাজে, ১২ শতাংশ শিল্পে এবং চার শতাংশ গাড়িতে ব্যবহূত হচ্ছে। এতে তিন কোটি মানুষ উপকৃত হচ্ছে।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালে চুলার (ইলেকট্রিক, গ্যাস ও মাটি) মাধ্যমে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে আট হাজার ১৭৫টি। বিস্ফোরণের (সিলিন্ডার ও বয়লার) ঘটনা ঘটেছে ১২৫টি। এ ছাড়া অজ্ঞাত কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে চার হাজার ৭৯৬টি।
জানা যায়, ২০০৯ সালে পাইপলাইনে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো নতুন সংযোগ বন্ধ করে দেয়। ফলে বেড়েছে এলপি-নির্ভরতা। এলপিজি গ্রাহকের একটি বড় অংশই গ্রামাঞ্চলের। এ মুহূর্তে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট ৩০টি কোম্পানির অন্তত দুই কোটি সিলিন্ডার বাজারে রয়েছে। বিস্ফোরক পরিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত এক বছরে এলপিজি সিলিন্ডার আমদানি করা হয়েছে ছয় লাখের বেশি। এলপিজি ছাড়া অন্যান্য সিলিন্ডার আমদানি করা হয়েছে তিন লাখের বেশি। পাশাপাশি দেশেও সিলিন্ডার নির্মাণের জন্য তিনটি প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দেয়া হয়েছে। অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান বাজারজাত করেছে দেশে নির্মিত সিলিন্ডার। কিন্তু এসব সিলিন্ডারের মান পরীক্ষার জন্য অনুমোদিত কোনো পরীক্ষা কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের এক ব্যবসায়ী নাম গোপন রাখার শর্তে আমার সংবাদকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে লাইসেন্স করে ব্যবসা পরিচালনা করছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় বর্তমানে পানদোকান, মুদিদোকান, ওষুধের দোকানসহ বিভিন্ন অনিরাপদ স্থানে গ্যাসসিলিন্ডার ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের তদারকি না থাকায় লাইসেন্স ছাড়া নিয়মনীতিকে তোয়াক্কা না করে দেদার গ্যাসসিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে। 

এ বিষয়ে বিইআরসি চেয়ারম্যান মো. নূরুল আমিন বলেন, এলপিজি গ্যাসসিলিন্ডার বিস্ফোরণ নয়, লিকেজ থেকে গ্যাস বের হয়ে আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে। এ জন্য ব্যবহারকারীদের সচেতন হতে হবে। 

কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, এসব দুর্ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, দেশের গ্যাস সরবরাহ ও সংযোগ কতটা ভঙ্গুর ও ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে ঘটছে দুর্ঘটনা-প্রাণহানি।
 

Link copied!