নিজস্ব প্রতিবেদক
জুন ১৩, ২০২৫, ১২:১১ এএম
নিজস্ব প্রতিবেদক
জুন ১৩, ২০২৫, ১২:১১ এএম
চলতি বছরের প্রথম ৩ মাসে ব্যাংক খাতে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা আমানত বেড়েছে। তাতে গত মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে আমানতের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ২৩ হাজার ৫০৬ কোটি টাকায়।
গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে আমানতের পরিমাণ ছিল ১৮ লাখ ৮৩ হাজার ৭১১ কোটি টাকা। সেই হিসাবে ৩ মাসের ব্যবধানে ব্যাংক খাতে সুদসহ আমানত বেড়েছে ৩৯ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা বা ২ শতাংশের বেশি। দেশের ব্যাংক খাতের ঋণ-আমানত পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি হালনাগাদ এক পরিসংখ্যান থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিক শেষে ব্যাংক খাতে মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ ৬২ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংক খাতে গ্রাহকের আমানত বেড়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার ২০২ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে ব্যাংক খাতে আমানতের যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তাতে বেশি প্রবৃদ্ধি ছিল গ্রামীণ এলাকার আমানতের। গত অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকের তুলনায় চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে গ্রামীণ এলাকায় আমানতের ৩ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। একই সময়ে শহরাঞ্চলের আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১ দশমিক ৯৪ শতাংশ। তবে সার্বিকভাবে ব্যাংকে গ্রামের চেয়ে শহরের আমানতই বেশি। মার্চ শেষে ব্যাংক খাতের ১৯ লাখ ২৩ হাজার ৫০৬ কোটি টাকার আমানতের মধ্যে শহরাঞ্চলের আমানতের পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ২২ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা। আর গ্রামাঞ্চলের আমানতের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ১ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, মার্চ শেষে দেশের ব্যাংক খাতে যত আমানত ছিল, তার ৮৪ শতাংশের বেশি শহরাঞ্চলের। বাকি প্রায় ১৬ শতাংশ আমানত গ্রামীণ এলাকার। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আমানত বৃদ্ধির পাশাপাশি আমানতের সুদ হারও বেড়েছে। গত অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংক খাতে আমানতের গড় সুদহার ছিল ৬ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। মার্চ প্রান্তিক শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় সোয়া ৬ শতাংশে। সুদহার বৃদ্ধির কারণে ব্যাংক খাতে ৩ মাসের ব্যবধানে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা আমানত বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে করছেন খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
তারা বলছেন, বিগত আওয়ামী সরকারের সময় দেশের ব্যাংক খাতে বড় ধরনের অনিয়মের ঘটনা ঘটে। কিছু কিছু ব্যাংক থেকে নানা অনিয়মের মাধ্যমে ঋণের নামে বড় অঙ্কের অর্থ বের করে নেন আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা। তাতে কিছু ব্যাংকের অবস্থা নড়বড়ে হয়ে পড়ে। এসব ব্যাংকে বড় ধরনের তারল্যসংকট দেখা দেয়। ফলে কয়েকটি ব্যাংক গ্রাহকের আমানতের অর্থও সময়মতো ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়। তাতে ব্যাংক খাতের ওপর গ্রাহকের চরম আস্থাহীনতা দেখা দেয়। এ সময় অনেকে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেন। পাশাপাশি সরকারও অর্থ সংকটে পড়ে। এ কারণে ট্রেজারি বিল-বন্ডের মাধ্যমে সরকার ব্যাংক খাত থেকে অর্থ ধার করা বাড়িয়ে দেয়। তাতে বেড়ে যায় ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদের হার। এতেও ব্যাংক খাতের আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে গিয়েছিল।
এ ছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষকে জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতেই হিমশিম খেতে হয়। তাতে কমে যায় সঞ্চয় প্রবণতা। ব্যাংক খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গত আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এক ডজনের বেশি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়। এসব ব্যাংকের বড় অংশই ছিল এস আলমের নিয়ন্ত্রণে। আগস্টের পটপরিবর্তনের পর বিভিন্ন ব্যাংকের পর্ষদ বদল করায় নতুন পর্ষদ সংকট কাটাতে নতুন করে আমানত সংগ্রহে উদ্যোগী হয়। আমানতের সুদ বাড়িয়ে অনেকে নতুন নতুন আমানত সংগ্রহ করেছে।
আবার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্যাংক খাতের ওপর মানুষের আস্থাও ফিরতে শুরু করে। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে সামগ্রিক আমানত প্রবৃদ্ধিতে।
ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মারুফ বলেন, ‘আমানতের এই প্রবৃদ্ধি সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতের জন্য খুবই ইতিবাচক।
আমার ধারণা, আমানতের এই প্রবৃদ্ধির পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। ছয় মাস ধরে আমরা প্রবাসী আয়ে ভালো প্রবৃদ্ধি দেখতে পাচ্ছি। বিদেশ থেকে আসা এই অর্থের বড় অংশই ঘুরে ফিরে ব্যাংকে আমানত হিসেবে জমা হচ্ছে। এ ছাড়া পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্যাংক খাতের ওপর গ্রাহকের আস্থাও কিছুটা বাড়তে শুরু করেছে। তাতে মানুষের হাতে চলে যাওয়া অর্থেরও একটি অংশ ব্যাংকে ফিরে এসেছে। কিছু ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠনের পর নতুন পর্ষদও আমানত সংগ্রহে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। সব মিলিয়ে তার ইতিবাচক প্রভাব আমানতে দেখা যাচ্ছে।’
এদিকে ৩ মাসের ব্যবধানে ব্যাংক খাতে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা আমানত বাড়লেও এ সময়ের ব্যবধানে ঋণ বেড়েছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। গত জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিক শেষে ব্যাংক খাতে মোট ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ১২ হাজার ৬১৮ কোটি টাকায়।
গত অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে যার পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা। সেই হিসাবে ৩ মাসের ব্যবধানে ব্যাংক খাতে ঋণ বেড়েছে ২৯ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা বা ১ দশমিক ৭৭ শতাংশ। মার্চ শেষে বিতরণ করা ব্যাংকঋণের মধ্যে ১৫ লাখ ৭৫ হাজার ৮৯৮ কোটি টাকা বা ৯২ শতাংশই বিতরণ করা হয়েছে শহরাঞ্চলে। গ্রামীণ অঞ্চলে গেছে মোট ঋণের মাত্র ১ লাখ ৩৬ হাজার ৭২১ কোটি টাকা বা ৮ শতাংশ।