Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ১৭ জুন, ২০২৫,

ইরান-ইসরাইল সংঘাতের শেষ কোথায়

আমার সংবাদ ডেস্ক

আমার সংবাদ ডেস্ক

জুন ১৭, ২০২৫, ১২:০৯ এএম


ইরান-ইসরাইল সংঘাতের শেষ কোথায়
  • পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে ইরান

ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে টানা চার দিন ধরে পাল্টাপাল্টি হামলা চলছে। এতে ইরানে দুই শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে দেশটির সামরিক বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক সদস্য রয়েছেন, রয়েছেন বেশ কয়েকজন পরমাণু বিজ্ঞানীও। ইরান ইসরাইলের হামলায় এমনভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, যা দেশটি এর আগে কখনো দেখেনি। 

ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র তেল আবিব ও হাইফার মতো বড় শহরগুলোতে ভয়াবহ ক্ষতি করেছে। গ্যালিলি, বাত ইয়াম শহরেও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে কয়েকজন করে নিহতের খবরও সামনে আসছে। কিন্তু ঠিক কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। কারণ একদিকে রণক্ষেত্র, আর অন্যদিকে তথ্যযুদ্ধ। দুই পক্ষই প্রচারণার অংশ হিসেবে তথ্য গোপন বা বিকৃত করছে। ফলে কারা কোথায় আঘাত করেছে, কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা নির্ভরযোগ্যভাবে জানা যাচ্ছে না।

একইভাবে অজানা থেকে গেছে উভয় দেশের অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্রের মজুত কতটুকু রয়েছে এবং তারা কতদিন এ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে। তবে জানা যায়, ইরান বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ক্ষেপণাস্ত্রের অধিকারী। তাদের হাতে কয়েক হাজার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যেগুলোর পাল্লা ও গতি ভিন্ন ভিন্ন। এসব ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইরান আরও কয়েক সপ্তাহ ইসরাইলে আঘাত হানতে সক্ষম, যা ইসরাইলিদের জন্য হতে পারে এক ভীতিকর অভিজ্ঞতা। 

কারণ, তারা এতদিন কেবল গাজা, লেবানন বা ইয়েমেন থেকে সীমিত শক্তির ক্ষেপণাস্ত্র বা রকেটে হামলার মুখোমুখি হয়েছে। ইরান এবার তার উন্নত প্রযুক্তির ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের ক্ষমতাও প্রদর্শন করেছে। রোববার ইসরাইলের ওপর প্রথমবারের মতো ‘হাজ কাসেম’ নামের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহূত হয়, যা ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়। এর গতি ও ধ্বংসক্ষমতা আগের ব্যবহূত ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর চেয়ে অনেক বেশি বলে ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে। তবে ইরানের এসব উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র সীমিত পরিমাণে আছে। ফলে এদের ব্যবহারে কৌশলগত সংযম বজায় রাখতে হবে।

তবে প্রচুর সংখ্যক সাধারণ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন থাকায় ইরান এখনো উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি করতে সক্ষম এবং এ যুদ্ধে টিকে থাকার মতো শক্তি তার রয়েছে, যা অনেকেই ধারণা করেননি। ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা তজাচি হানেগবি স্বীকার করেছেন, তাদের অনুমানের চেয়ে বেশি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে ইরানের হাতে। 

ইসরাইলি আর্মি রেডিওতে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, এই বাস্তবতা ইরানের হুমকি মোকাবিলায় বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদে এই লড়াইয়ের মাধ্যমে ইরানের হুমকি দূর করা সম্ভব নয়। ইসরাইলের অনুমান ছিল, ইরানের হাতে দেড় থেকে দুই হাজারের মতো ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র থাকতে পারে। অথচ গত শুক্র ও শনিবার ইরান ইসরাইলের দিকে দুই শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে, যার অনেকগুলো ইসরাইলের বিখ্যাত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে ঢুকে পড়ে। ইসরাইলের আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় চরমভাবে চাপে রয়েছে। তবে তারা তাদের প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করছে, যারা কিছু হামলা প্রতিহত করতে সাহায্য করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অবশ্য ঘোষণা দিয়েছেন, তার দেশ এই যুদ্ধে সরাসরি জড়িত নয়। 

তবে তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, যদি ইরান যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ঘাঁটি বা স্বার্থে আঘাত হানে, তবে চড়া মূল্য দিতে হবে। কানাডায় জি-৭ সম্মেলনে যাওয়ার আগে রোববার হোয়াইট হাউসের বাইরে কথা বলতে বলতে তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি সমঝোতার ভালো সম্ভাবনা আছে। ট্রাম্প বলেন, ইরানের সঙ্গে আমাদের খুব ভালো সম্পর্ক আছে। 

তিনি মনে করেন, ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে পরস্পরের প্রতি যথেষ্ট সম্মান আছে। তবে ট্রাম্প জানাননি তিনি ইসরাইলকে ইরানে বিমান হামলা বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন কি না। তিনি বলেন, আমি সেটা বলতে চাই না। 

রোববার ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি দাবি করেন, ইসরাইলের সামরিক অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা ও ঘাঁটিগুলোর সরাসরি সহযোগিতার প্রমাণ তেহরানের কাছে রয়েছে। বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি বলেন, আমাদের কাছে জোরালো প্রমাণ রয়েছে যে, এই অঞ্চলে থাকা মার্কিন বাহিনী ও ঘাঁটিগুলো ইসরাইলের হামলায় সহায়তা করেছে। ইরানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে আক্রমণ করা সর্বশেষ বিকল্প, যা তারা এড়িয়ে চলতে চায়। 

দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি সবসময়ই তুলনামূলকভাবে সংযত পন্থা অনুসরণ করেছেন। তিনি চান না, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে জড়াক বা তাদের ওপর হামলার অজুহাত পেয়ে যাক। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল মিলে একযোগে হামলা চালালে ইরানের সবচেয়ে সুরক্ষিত পরমাণু স্থাপনাগুলো ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এতে ইসরাইলের অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক ঘাঁটিগুলোর মাধ্যমে এমন হামলা হতে পারে, যেগুলো কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব ও তুরস্কের মতো দেশগুলো থেকে পরিচালিত হবে, যারা ইরানের শত্রু নয় এবং যাদের সঙ্গে ইরানের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। ফলে এসব দেশকে যুদ্ধে জড়াতে ইরান চাইবে না। তবে ইরানের হাতে আরও একটি প্রভাবশালী বিকল্প রয়েছে, তা হলো হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয়া। এই প্রণালী দিয়ে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণে তেল পরিবহন হয়। 

যদি ইরান তা সাময়িক বন্ধ করে দেয়, তবে তেলের দাম অনেক বেশি বেড়ে যাবে। শুক্রবারও তেলের দাম বেড়ে ৭৮ ডলারে পৌঁছে গিয়েছিল, যা কয়েকশ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। 

তবে সবশেষ কথা হলো, ইরান যুদ্ধ থামাতে চায়। কারণ এই সংঘাত আরও বড় আকার ধারণ করে দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে আঞ্চলিক যুদ্ধ হয়ে উঠতে পারে। এতে ইরানের অর্থনীতি ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং দেশে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। ইসরাইলও যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে না অনন্তকাল, তবে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় তাদের অস্ত্রভাণ্ডার পুনরায় পূরণ করা সহজ, যা ইরানের পক্ষে কঠিন। 

ইরান এরই মধ্যে জানিয়েছে, ইসরাইল হামলা বন্ধ করলে তারাও প্রতিক্রিয়া জানানো বন্ধ করবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারমাণবিক আলোচনায় ফিরতে প্রস্তুত। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি রোববার বলেছেন, ইসরাইলের হামলা বন্ধ হলেই আমরাও স্বাভাবিকভাবে প্রতিক্রিয়া দেখানো বন্ধ করব। ইরানের পক্ষ থেকে বারবার এ কথাই সামনে আসছে। তবে বিষয়টি নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার অস্থির নেতৃত্বের ওপর। ট্রাম্প কখনো ইসরাইলকে শান্ত থাকার আহ্বান জানাচ্ছেন, আবার কখনো ইরানকে হুমকি দিচ্ছেন। 

ইরান জানে, ট্রাম্পকে বিশ্বাস করা কঠিন। ইসরাইল আক্রমণের আগে যুক্তরাষ্ট্র তেহরানকে বুঝিয়েছে, পারমাণবিক আলোচনা হবে, যা ছিল একটি প্রতারণামূলক চাল। তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হওয়া কোনো চুক্তিই আপাতত ইরানের জন্য সবচেয়ে সম্ভাব্য ও কার্যকর পথ, যার মাধ্যমে ইসরাইলের হামলা বন্ধ করানো এবং যুদ্ধের ইতি টানা সম্ভব। কারণ যুদ্ধের শুরুর ধাপে ইরান তার শক্তির প্রমাণ দেখিয়েছে, তবে দীর্ঘমেয়াদে এই যুদ্ধ ধরে রাখা তাদের জন্য কঠিন হবে।
পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে ইরান : পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) থেকে বেরিয়ে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে ইরান। চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে ইরানের পার্লামেন্টের সদস্যরা একটি বিল তৈরি করছেন।

গতকাল সোমবার ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ খবর জানিয়েছে। তবে একই সঙ্গে মন্ত্রণালয় ইরান সরকারের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে বলেছে, তারা ধ্বংসের জন্য পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর বিরোধী। ইরানের এনপিটি চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়া নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইসমাইল বাঘাঈ বলেন, ‘সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা একটি যথাযথ সিদ্ধান্ত নেব। সরকার পার্লামেন্টের বিল বাস্তবায়ন করতে বাধ্য, তবে এই প্রস্তাব এখন কেবল প্রস্তুতির পর্যায়ে রয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ে আমরা এটি পার্লামেন্টের সঙ্গে সমন্বয় করব।’ ১৯৭০ সালে এনপিটি চুক্তি অনুমোদন করেছিল ইরান। এই চুক্তি অনুযায়ী, দেশগুলো বেসামরিক পরমাণু শক্তি কাজে লাগাতে পারে। বিনিময়ে তাদেরকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত থাকতে হয় এবং আন্তর্জাতিক আনবিক শক্তি সংস্থা আইএইএ-র সঙ্গে সহযোগিতা করতে হয়। গত সপ্তাহে ইসরাইল ইরানে হামলা চালায়। 

তারা দাবি করে, তেহরান পারমাণবিক বোমা তৈরির দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। তবে ইরান বরাবরই বলে আসছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ। যদিও আইএইএ গত সপ্তাহে এক ঘোষণায় জানিয়েছে যে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির (এনপিটি) শর্ত লঙ্ঘন করছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান কয়েকদিন আগেই জানিয়েছিলেন, ইরান পরমাণু অস্ত্র বানাতে চায় না। তারপরই তেহরানের এনপিটি চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতির খবর এল। 

তবে সোমবার পেজেশকিয়ান আবারও তার আগের অবস্থান জানান দিয়ে বলেছেন, পারমাণবিক অস্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির ধর্মীয় ফরমানের বিরুদ্ধে যায়। ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম বলছে, এনপিটি থেকে সরে যাওয়ার বিষয়ে এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি পার্লামেন্ট। প্রস্তাবটি আইনি প্রক্রিয়ার কেবল প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।

Link copied!