নিজস্ব প্রতিবেদক
আগস্ট ৯, ২০২৫, ১১:৪৪ পিএম
অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। এই সময়ে শুধু রাজধানী ঢাকাতেই রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও পেশাজীবী গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে মোট এক হাজার ৪৯৮টি আন্দোলন কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়েছে। গড়ে প্রতিদিন চারটি করে। আন্দোলনের কারণে রাজধানীবাসীর দৈনন্দিন জীবন যেমন বিপর্যস্ত হয়েছে, তেমনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও পড়তে হয়েছে অতিরিক্ত চাপে।
শুধু বিরোধী দলই নয়, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছেন। এতে নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব ব্যাহত হয়েছে, মামলা তদন্তেও বিলম্ব ঘটেছে। নাগরিক ভোগান্তি ছিল অসহনীয়। গত এক বছরে রাজধানীতে ১১৭টি রাজনৈতিক দল, সংগঠন, পেশাজীবী ও গোষ্ঠী আন্দোলন করেছে। এর মধ্যে ১১টি প্রতিষ্ঠানের দাবি-দাওয়া মেনে নিয়েছে সরকার।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের পতন ঘটে। এরপর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। কিন্তু দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই সরকারকে নানাবিধ যৌক্তিক ও অযৌক্তিক দাবির মুখে পড়তে হয়েছে, যা এখনো অব্যাহত।
নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, সড়ক অবরোধ ও যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটানো আন্দোলনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, যা বিপুল কর্মঘণ্টা নষ্ট করছে। গত এক বছরে আন্দোলনের মাঠপর্যায়ের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি আন্দোলন হয়েছে শাহবাগ এলাকায়। প্রায় প্রতিটি আন্দোলনে রাজধানীর প্রধান সড়ক অবরোধ করা হয়, যার ফলে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ভোগান্তিতে পড়েন। বেশির ভাগ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয় কর্মদিবসে, ফলে যানজট ও বিশৃঙ্খলা বেড়ে যায়।
৩০ জুলাই নিজেদের ‘জুলাইযোদ্ধা’ পরিচয়ে একদল মানুষ শাহবাগ অবরোধ করে। পরদিন সন্ধ্যায় আরেকদল ‘আসল জুলাইযোদ্ধা’ দাবি করে তাদের ওপর হামলা চালায়। দুপক্ষের সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ও সচিবালয় এলাকা আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিল। সরকারি চাকরি আইন সংশোধনের দাবিতে মে, জুন ও জুলাই মাসে সচিবালয়ে ২৫টি আন্দোলন হয়। চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে আগস্টে আনসার সদস্যরা সচিবালয়ের সামনে অবস্থান নেয়।
১৫ জুন নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ১৭তম শিক্ষক নিবন্ধনধারীরা সচিবালয় অভিমুখে মিছিলের চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। জলকামান, সাউন্ড গ্রেনেড ও লাঠিচার্জের ঘটনা ঘটে। ডিএমপির তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে চাকরি-সংক্রান্ত আন্দোলনের সংখ্যা ছিল ৫৯১টি, যা করেছে ৪৬টি সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। তাদের দাবির মধ্যে ছিল জাতীয়করণ, পুনর্বহাল, বেতন বৃদ্ধি, গ্রেড পরিবর্তন ও বকেয়া পরিশোধ। শুধু চাকরি জাতীয়করণের দাবিতেই ১০টি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা ১৮৯টি আন্দোলন করেছে। পোশাকশিল্পের ৯টি কারখানার শ্রমিকরা বকেয়া বেতন-ভাতা ও অন্যান্য দাবিতে ৭০টি আন্দোলন করেছে।
বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও গণঅধিকার পরিষদসহ অন্তত ১২টি রাজনৈতিক দল গত এক বছরে ২৭৭টি আন্দোলন করেছে। তাদের মূল দাবি ছিল দ্রুত ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা, শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচার, এবং গুম-খুনের দায় নিরূপণ। আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ ঘোষিত ১০৯টি ঝটিকা মিছিলেরও তথ্য দিয়েছে ডিএমপি। বিএনপি একা ৮৭ দিন আন্দোলন করেছে, যার মধ্যে ছিল নির্বাচন ত্বরান্বিত করা, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার, ভারতীয় পণ্য বর্জন ইত্যাদি। ইশরাক হোসেনকে মেয়র হিসেবে শপথের দাবিতে তার অনুসারীরা ২২ দিন নগর ভবনে অবস্থান নেন, এতে নাগরিক সেবা বন্ধ হয়ে যায়।
জামায়াতে ইসলামী ৬০ দিন আন্দোলন করেছে। তাদের দাবির মধ্যে ছিল ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের ‘লগি-বৈঠা’ হত্যার বিচার, গুম-খুনের তদন্ত ও জুলাই গণহত্যার দায় নিরূপণ। ছাত্রশিবির গুম-খুনের বিচারের দাবিতে ১৩ দিন আন্দোলন করেছে। ইনকিলাব মঞ্চ আগরতলায় বাংলাদেশ উপহাইকমিশনে হামলার প্রতিবাদসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ৫৪টি আন্দোলন করেছে। যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলও একই ইস্যুতে কর্মসূচি পালন করেছে।
পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা ৩৩ দিন আন্দোলন করেছে। রিকশা-ভ্যান শ্রমিকরা রুট পারমিট ও হাইকোর্টের আদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে ১২ দিন আন্দোলন করেছেন। ১৯৯৪ সালে চাকরিচ্যুত ব্যাটালিয়ন আনসারের সদস্যরা ২৫ জুন থেকে আন্দোলনে আছেন। ‘তথ্য আপা’ প্রকল্পের কর্মীরাও ২৯ মে থেকে চার দফা দাবিতে টানা আন্দোলন করছেন। সরকার কিছু দাবির প্রেক্ষিতে সাত কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর, ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ, জুলাই আন্দোলনে আহতদের ভাতা প্রদান এবং স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা জাতীয়করণসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে।
ডিএমপির উপকমিশনার (মিডিয়া) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানিয়েছেন, অনেক সংগঠন হঠাৎ রাস্তা অবরোধ করে, যা ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। অযৌক্তিক আন্দোলন মোকাবিলায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করতে হয়, এতে স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। তিনি জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে এমন কর্মসূচি থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান।