Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

মাগুরায় পর্যাপ্ত পানির অভাবে পাট নিয়ে বিপাকে চাষিরা

শ্রীপুর (মাগুরা) প্রতিনিধি

শ্রীপুর (মাগুরা) প্রতিনিধি

আগস্ট ১৩, ২০২২, ০৭:৩৭ পিএম


মাগুরায় পর্যাপ্ত পানির অভাবে পাট নিয়ে বিপাকে চাষিরা

মাগুরায়  প্রচন্ড খড়ায় পানির অভাবে পাট পঁচাতে না পেরে দুশ্চিন্তায় পড়েছে চাষিরা। ক্ষেতেই শুকিয়ে মরে যাচ্ছে পাট। খালে বিলে পানি না থাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছে তারা। বর্ষার ভরা মৌসুমেও পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃষ্টি না হওয়ায় চরম বিপাকে পড়েছে কৃষকেরা।

কৃষি অফিসের তথ্য মতে মাগুরায় এ বছর চলতি মৌসুমে মাগুরা সদর  উপজেলায় ১১ হাজার ৪ শ ৪৫ হেক্টর, শ্রীপুর উপজেলায় ১১ হাজার ১ শ ৫০ হেক্টর, মহম্মদপুর উপজেলায় ১২ হাজার ৮০০ হেক্টর এবং শালিখা উপজেলায় ৩ হাজার ৯ শ ৩৫ হেক্টর মোট ৩৯ হাজার ৩ শ ৩০ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। শ্রীপুর উপজেলায় গত বছরের তুলনায় এ বছর ১ এক হাজার ৬৫ হেক্টর এবং শালিখা উপজেলায় ৪৫ হেক্টর  জমিতে বেশি পাটের আবাদ হয়েছে।  

জেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, বিশেষ করে শ্রীপুর উপজেলার কুমার নদ, মাছ চাষের পুকুর, খালে - বিলে কোথাও পর্যাপ্ত পানি না থাকায় পাট পঁচাতে পারছে না তারা। কোনো উপায় না পেয়ে কৃষকরা পাট কেটে ক্ষেতেই ফেলে রাখছেন। অনেকে বৃষ্টির আশায় পাট না কেটে রেখে দিচ্ছে।

এছাড়া মাছ চাষের পুুকুরে ও ডোবায় গাদাগাদি করে পাট জাগ দিচ্ছেন। দুর দুরান্ত থেকে গরু, মহিষ ও ঘোড়ার গাড়ির পাশাপাশি নছিমন, ভ্যানসহ বিভিন্ন উপায়ে কুমার নদে পাট জাগ দিচ্ছেন। এতে করে শ্রমিকের চড়া দাম ও পরিবহন খরচ বেশি হওয়ায় উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় লোকসানের আশঙ্কায় রয়েছে পাট চাষিরা। অন্যদিকে পাটের পচা পানিতে দেশীয় প্রজাতির মাছ মরে যাচ্ছে।

শ্রীপুর উপজেলার হোগলডাঙ্গা গ্রামের পাট চাষি সাইফুল ইসলাম বলেন, এ বছর বৃষ্টির পরিমাণ খুবই কম, আষাঢ় মাস শেষ হয়ে গেছে এখনো খালে বিলে কোথায়ও পানি নেই। বাড়ির পাশে ডোবা এবং মাছ চাষের পুকুরে সেচ মেশিনের মাধ্যমে পানি তুলে সামান্য পানিতে গাদাগাদি করে পাট জাগ দিতে হচ্ছে। কম পানিতে পাট জাগ দেওয়ায় পাটের আঁশ কালো হয় বলে তা কম দামে বিক্রি করতে হয়। পাটের ফলন এবার ভালো হলেও পর্যাপ্ত পানির অভাবে আঁশ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। গতবছর যে জমিতে পাট কেটেছিলাম সেই জমিতেই পাট জাগ দিতে পেরেছিলাম।  

মদনপুর গ্রামের পাট চাষি নবুওয়াত মোল্লা বলেন, এ বছর আমি ৩‍‍`শ শতাংশের মত জমি পাট চাষ করেছি। খরায় পাট মরে যাচ্ছে, পানির অভাবে কাটা পাট শুকিয়ে যাচ্ছে। খালে-বিলে কোন পানি নেই, তাই বাধ্য হয়েই সব পাট কুমার নদে নিতে হচ্ছে। পাট চাষে কোন লাভ নেই। প্রথম থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত হিসেব করলে বরং লোকসানই হয়। আর পাট চাষে তো প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়।

শ্রীপুর উপজেলা পাট অধিদপ্তরের উন্নয়ন কর্মকর্তা মোঃ সাদ্দাম হোসেন বলেন, বর্তমানে পাট পঁচানোর আধুনিক কোনো ব্যবস্থা হাতে নেই। উন্নত প্রযুক্তি নির্ভর পাট ও পাট বীজ উৎপাদন এবং সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় উপজেলায় (২০২২-২০২৩ ) অর্থ বছরে ৩ হাজার আর্দশ আঁশ পাট উৎপাদনকারী চাষিদের বিনামূল্যে পাট বীজ ও রাসায়নিক সার প্রদান করা হয়েছে।

পাট উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও পর্যাপ্ত পরিমান পানি না পাওয়ায় পাট জাগ দেওয়া নিয়ে পাট চাষিরা দূচিন্তায় আছে। পাট চাষিরা পানির অভাবে পাট কাটতে পারছে না। যদি সরকারি খাস জমিতে জলাধার তৈরি করে কষকের পাট জাগ দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায় তাহলে উপজেলার পাট উৎপাদনকারী চাষিদের উপকার হয়।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ সালমা জাহান নিপা বলেন, খালে বিলে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় কৃষকেরা পাট জাগ দেওয়া নিয়ে কিছুটা সমস্যায় পড়েছেন। পাট কাটা দেরিতে হওয়ায় আমন আবাদ নিয়ে এখন কৃষকেরা বিড়ম্বনায় পড়ছেন। আশেপাশে পানি না পাওয়ায় অনেক দূরে বহন করে নিয়ে পাট জাগে ফেলতে হচ্ছে বলে কৃষকদের পাট উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। পাটের ভালো দাম না পেলে কৃষকদের লোকসান গুনতে হবে।

মহম্মদপুর উপজেলায় পানির অভাবে মাটি খুঁড়ে পাট জাগ দিচ্ছেন চাষিরা। আবার কেউ কেউ নিজস্ব পুকুরে শ্যালো মেশিনে পানি দিয়ে পাট জাগ দিচ্ছেন। আর্থিক সচ্ছল কৃষক নছিমন অথবা ট্রলি দিয়ে নিয়ে পাট ১০-১২ কিলোমিটার দ‚রে বিনোদপুরের নবগঙ্গা নদী ও রাজাপুরের রাজপাট খালে জাগ দিয়েছেন। এতে পাটের মান নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি উৎপাদনের ব্যয় বাড়ছে। অন্যদিকে বীজতলা প্রস্তুত থাকলে আমনের আবাদ করতে পারছেন না কৃষকরা।

মহম্মদপুর উপজেলার কৃষক আবুল বাশার বলেন, অতিরিক্ত পাট জাগ দেওয়ায় নবগঙ্গার পানি এতটাই বিষাক্ত হয়ে গেছে যে, পাট জাগ দিতে গিয়ে তাঁর শরীরে ঘা শুরু হয়ে গেছে। এ কারণে দুই সপ্তাহ ধরে পানিতে নামতে পারছেন না তিনি।

গোপালনগর গ্রামের কৃষক মেজর ও শাহাজান মিয়া জানান, রোদে পুড়ে লালচে হয়ে মরে যাচ্ছে পাটগাছ। জমি থেকে পাট কাটতে গত বছরের তুলনায় এবার দ্বিগুণ টাকা গুনতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে পাট নিয়ে দুর্ভোগের শেষ নেই তাঁদের। দুই বিঘা জমির পাট মাটি খুঁড়ে জাগ দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন তাঁরা।

কৃষকরা জানায়, অনাবৃষ্টি, আর নদ-নদীর অব্যবস্থাপনার কারণে চরম পানি সংকটে পড়েছেন তারা। ফলে কিছুটা রেটিং পদ্ধতিতে (কাঁচা পাটের আঁশ ছাড়িয়ে জাগ দেওয়া) মাটি খুঁড়ে গর্ত করে পাট জাগ দিচ্ছেন।

আওনাড়া গ্রামের ধান চাষি আকরাম বলেন, ‍‍`আমি দুই বিঘা জমির পাট কেটে ফেলেছি আমন ধান লাগাব বলে। বীজতলা প্রস্তুত থাকলেও বৃষ্টির অভাবে জমি চাষ করতে পারছি না। দু-এক দিন দেখার পরে সেচের ব্যবস্থা করে ধান লাগাব। কিন্তু এত খরচ করে আবাদ করেছি এখন পাট কী করবও তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছি। উপজেলার আড়পাড়া গ্রামের কৃষক শফিকুল ইসলাম জানান, এ বছর পাটের বাম্পার ফলন হয়েছে। কিন্তু পানির অভাবে মাঠ-ঘাট ফেঁটে প্রায় চৌচির।

কৃষকেরা পাট কেটে মাঠে ফেলে রেখেছেন। পাট ক্ষেতেই অনেকটা শুকিয়ে যাচ্ছে। পাট জাগ দিতে ৮-১০ হাত পানির দরকার। আমার ১০ বিঘা জমি, পাটের বাম্পার ফলন হয়েছে। কিন্তুু পাট কেটে ক্ষেতে ফেলে রেখেছি ।কোথাও পানি নেই। কৃষকেরা সময় মতো যদি পাট জাগ দিতে না পারে, তাহলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুস সোবহান বলেন, গত মৌসুমে পাটের দাম ভালো হওয়ায় এবার উপজেলায় পাটের চাষ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে। অতিরিক্ত খরার কারণে রোগে আক্রান্ত হয়ে পাটগাছ শুকিয়ে যাচ্ছে। সেচসুবিধা অব্যাহত রাখতে গভীর নলক‚পগুলো চালু করার পরামর্শ দিচ্ছেন। শালিখা উপজেলার কৃষকেরাও পাট নিয়ে পড়েছে মহা সমস্যায়। খাল-বিল- ডোবা শুকিয়ে যাওয়ার কারণে পাট কেটে ক্ষেতে বা রাস্তার ধারে ফেলে রাখা হয়েছে। বৃষ্টির দেখা না পেয়ে পাট জাগ দেয়া নিয়ে অনেক চিন্তায় পড়েছেন কৃষকেরা।

আষাঢ়ের মাঝামাঝি হালকা বৃষ্টিপাত ও আকাশ বেশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের পাট চাষিরা তাদের পার্ট কাটেছেন। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমান বৃষ্টি না হওয়ায় পানির অভাবে পাট কেটে জমিতে ফেলে রেখেছেন তারা। জাগ না দিতে পারলে প্রান্তিক চাষিরা ক্ষতির সম্মুখিন হবেন ।

শালিখা উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা আলঙ্গীর হোসেন জানান, চলতি মৌসুমে শালিখা উপজেলায় ৩ হাজার ৯ শ ৩৫ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। যেখানে গত বছর ছিলো ৩ হাজার ৮ শ ৯০ হেক্টর জমিতে আবাদ। গত বছরের তুলনায় এ বছর ৪৫ হেক্টর বেশি জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী বৃষ্টি না হওয়ার কারণে প্রান্তিক কৃষকেরা বিপাকে পড়েছেন।

তিনি আরো বলেন, শালিখাতে অধিকাংশ ডোবা-নালা ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে পানি অনেকটা কম তাছাড়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের রিবন রিডিং পদ্ধতিতে পাট জাগ দেওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। মাটিতে গর্ত খুঁড়ে পাট পচানোর পদ্ধতি বেশ জটিল, আঁশ ছাড়ানো কঠিন। তাই এখনো এ পদ্ধতিতে কৃষকরা যেতে চান না। পানিতে পাট কেটে কয়েক দিন ভিজিয়ে রাখার পর আঁশ নরম হয়ে যায়। একে বলে জাগ দেয়া। জাগ দেয়ার পর সহজেই পাটকাঠি থেকে পাটের আঁশ ছড়ানো যায়।

এআই

Link copied!