শ্রীপুর (গাজীপুর) প্রতিনিধি
জুন ৯, ২০২৪, ০৪:৪৯ পিএম
নদীর মতো বড় একটি খাল কীভাবে দিনে দিনে তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলছে, এর প্রকৃত উদাহরণ হচ্ছে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া লবলং খাল। শিল্পকারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে খালটি এখন মৃত প্রায়।
জনশ্রুতি আছে লবলং সাগর হিসেবে। একসময় লবলং নদী দিয়ে পালতোলা নৌকা চলত, শোনা যেত মাঝির আকুল করা গান। দখল, দূষণ ও আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে গাজীপুর শ্রীপুরের এক সময়ের খরস্রোতা লবলং নদী। অনাবাদি হয়ে পড়েছে নদীর দুই পাশের ফসলি জমি। বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে নদীর তীরবর্তী মানুষেরা।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের তথ্য মতে শ্রীপুরে ৪৩৮টি শিল্প কারখানা সক্রিয় রয়েছে। তার মধ্যে মাওনা ইউনিয়নেই রয়েছে ৭৩টি। লবলং খালটি ময়মনসিংহের ভালুকার খিরু নদী থেকে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা হয়ে তুরাগ নদীতে এসে যুক্ত হয়েছে। নদীটি স্থানীয় মানুষ ও পরিবেশের জন্য আশীর্বাদ হওয়ার কথা থাকলেও উল্টো অভিশাপে পরিণত হয়েছে। খালের গাজীপুর অংশের শিল্প-কারখানাগুলোর বর্জ্যে সরাসরি খালে পড়ছে।
রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) গবেষণায় খালে ১৫টি পয়নিষ্কাশন লাইন এবং ১১টি ডাম্পিং স্টেশন গড়ে উঠেছে। ওই সংস্থাটির গবেষণায় সবচেয়ে দূষিতের তালিকায় লবলং অন্যতম।
এই নদী বা খালকে কেন্দ্র করে এলাকার কৃষিনির্ভর অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল। নব্বই দশকে শ্রীপুরে শিল্প কারখানা গড়ে উঠলে খাল দূষণ শুরু হয়। এক সময়ের লবলং এখন মৃত প্রায়। শুধু লবলং নয়, দূষণ-দখলে একই অবস্থা শ্রীপুরের হল— ধাউর, টেংরার খাল, কাটার খাল, সেরার খাল, বৈরাগীরচালার খাল, তরুণের খাল ও সালদহ খাল। গাজীপুরের শ্রীপুরে রাথুরা শালবনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত প্রাকৃতিক এক জলাভূমির নাম লবলং সাগর বা লবণদহ নদী।
লবলং খালের মাওনা ইউনিয়নের মাওনা-ফুলবাড়িয় সড়কের দুই পাশে ক্রাউন কারখানা, তেলিহাটি ইউনিয়নের অংশে দখলে অস্তিত্ব হারিয়েছে ধাউরের খাল। শ্রীপুর পৌরসভার বৈরাগীরচালা খালটি শিল্পবর্জ্য ও দখলে সংকুচিত হয়ে পড়েছে। ওই খালের গড়গড়িয়া মাস্টারবাড়ি অংশে কয়েক মাস ধরে বর্জ্য ফেলায় পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে পড়ছে। গোসিঙ্গা ও রাজাবাড়ি ইউনিয়নের তরুণের খালটির বিভিন্ন অংশ দখল-দূষণে এখন মৃত।
স্থানীয়দের অভিযোগ, নদী বা খালের দুই পাশ দখল করে শিল্পকারখানা গড়ে তোলায় নদীর গতিপথ সরু হয়ে গেছে। ওইসব কারখানার রাসায়নিক মিশ্রিত পানি নদীতে পড়ে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হওয়ায় নদীর তীরবর্তী নীচু ফসলি জমিগুলো পানিতে তলিয়ে থাকার কারণে অনাবাদি হয়ে রয়েছে কয়েক বছর যাবত। নদী দখলমুক্ত ও ফসলি জমি রক্ষার জন্য বিভিন্ন দপ্তরে ধরনা দিয়েও কোনো ফল পায়নি বলে অভিযোগ তাদের। পরিবেশ দূষণকারীরা প্রভাবশালী হওয়ায় প্রশাসন ব্যবস্থা নিতে চাইলে সহজে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। স্থানীয় পরিবেশ অধিদপ্তরে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে তারা ছাড়পত্র বা সনদ নবায়ন করছেন। কারখানার বর্জ্যে পানির রঙ কালো ও দুর্গন্ধযুক্ত। তারা আগামী কয়েক বছর জমিতে চাষ করতে পারবেন না। তাদের অভিযোগ কেউ গুরুত্ব দেয় না। গাজীপুর সদর উপজেলার বাঘের বাজার থেকে সাফারি পার্ক যাওয়ার পথে লবলং খালে নির্মিত সেতুর গোড়ায় মাঝরাতে বাঘের বাজার থেকে ট্রাক ভরে বর্জ্য ফেলা হয়। আমরা এসব নিয়ে অভিযোগ দিলে কারখানার মালিকেরা স্থানীয় প্রতিনিধিদের ম্যানেজ করেন।
মাওনা ইউনিয়নের চকপাড়ার গ্রামের সত্তোরোর্ধ কৃষক আব্দুল জব্বার জানান, লবলং খালে একসময় দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন মাছ পাওয়া যেত। আমরা এ খালের পানি দিয়েই চাষাবাদ করতাম। এখন খালে কোনো জলজ প্রাণি খুঁজে পাওয়া যায় না।
বিলাইঘাটা এলাকার কৃষি জমির মালিক আলতাব হোসে বলেন, আমার ৫ বিঘা ধানের জমির পাশ দিয়েই কারখানার বর্জ্যের পানি চলে গেছে। আমরা বছরের পর বছর ধরে ভুগছি নষ্ট হচ্ছে কৃষিজমি। মূলত জমিগুলো কিনে নেয়ার জন্যই কারখানাগুলো তাদের দূষিত পানি সরবরাহের কোনো স্থায়ী সমাধান করছে না। বিভিন্ন মাধ্যমে কারখানা কর্তৃপক্ষকে বললেও তারা কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
বাংলাদেশ রিভার এন্ড নেচার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম বলেন, বেশিরভাগ শিল্প কারখানায় ইটিপি সংযোগ কেবলই লোক দেখানো। পরিবেশ দূষণের প্রতিবাদে এবং দূষণকারীদের শাস্তির দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেও কোনো লাভ হয়নি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থাও নেয়নি।
শ্রীপুর উপজেলা আওয়ামীলী গের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হারুন অর রশিদ ফরিদ বলেন, শ্রীপুরের ঐতিহ্যবাহী লবনদহ নদীর পাশে ছোট বড় শিল্পকারখানা গড়ে তুলে নদীটি দখল করে ও নদীর পানি দূষিত করেছে। এতে করে নদীর আশপাশের কৃষি জমিতে কোনো ফসল উৎপাদন হয় না। কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। তিনি নদী রক্ষা, খালের সীমানা নির্ধারণ এবং পরিবেশ দূষণরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে।
শ্রীপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুমাইয়া সুলতানা বন্যা বলেন, লবলং খাল দূষণ নিয়ে আমরা অনেকবারই নদীরক্ষা কমিশন, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বসেছি। শিল্পকারখানা প্রয়োজন আছে। কিন্তু পরিবেশ দূষণ ঠেকাতে ইটিপি মানা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
গাজীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রফিকুল ইসলাম খান বলেন, জেলায় কারখানার বর্জ্যের কারণে ৩৮০ হেক্টর জমি আক্রান্ত হয়েছে। তবে পরিবেশ নিয়ে কাজ করেন এমন সংগঠন ও পরিবেশবিদদের দাবি, নষ্ট হওয়া জমির পরিমাণ আরও অনেক বেশি।
গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নয়ন মিয়া বলেন, খাল, বিল ও নদী দখল-দূষণের অভিযোগে বিভিন্ন সময় কারখানায় অভিযান চালিয়ে ক্ষতিপূরণ বা জরিমানা করা হয়েছে। এ ধরনের অভিযান অব্যাহত আছে। বর্জ্য পরিশোধনে ইটিপি ব্যবহার না করলে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি।
গাজীপুর জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবুল ফাতে মো. সফিকুল ইসলাম জানান, খালগুলোর তালিকা তৈরি করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে তা দখলমুক্ত করে দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসন সবসময় তৎপর রয়েছেন।
ইএইচ