মিরাজ আহমেদ, মাগুরা
জুন ১২, ২০২৫, ০৮:২৮ পিএম
মিরাজ আহমেদ, মাগুরা
জুন ১২, ২০২৫, ০৮:২৮ পিএম
মাগুরায় সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় এক ধরনের নৈরাজ্য দেখা দিয়েছে। জেলার ৪৩টি ক্লিনিক ও ৩২টি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মধ্যে অধিকাংশই অনিবন্ধিতভাবে পরিচালিত হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয় প্রশাসনের তদারকি না থাকায় এসব প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে—কিছু ক্ষেত্রে তা পরিচালনা করছেন অবসরপ্রাপ্ত বা অন্য স্থানে কর্মরত চিকিৎসকরাও।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এসব ক্লিনিক ও ফার্মেসিতে পাওয়া যাচ্ছে সরকারি ওষুধ এবং বিক্রি হচ্ছে নিষিদ্ধ ওষুধ প্যাথেডিন, যা কেবল নির্দিষ্ট হাসপাতালের জন্য বরাদ্দ। এতে রোগীদের জীবন ঝুঁকিতে পড়ছে। মূল চিকিৎসাসেবা এখন চলছে বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে, সরকারি হাসপাতাল কার্যত নামেমাত্র চালু আছে।
মাগুরা সদর হাসপাতালের চিত্র আরও করুণ। নেই পর্যাপ্ত ডাক্তার ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। ফলে অনেকে বাধ্য হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন বেসরকারি ক্লিনিকে। কিন্তু সেখানেও চলছে নানা অনিয়ম। এক রোগীর অভিভাবক হাফিজুর রহমান বলেন, “হাসপাতালে গেলে বলে ডাক্তার নাই, অপারেশন করতে হবে, ক্লিনিকে যান। ক্লিনিকে গিয়ে দেখি, হাসপাতালের ডাক্তারই অপারেশন করছেন।”
প্রতিদিন জেলার ক্লিনিকগুলোতে গড়ে ৪০–৪২টি অস্ত্রোপচার হচ্ছে—এর মধ্যে সিজার, গলব্লাডার, হার্নিয়া, এপেন্ডিস, হিস্টেরেকটমি ও পাইলস অন্যতম। অথচ এসব ক্লিনিকের একটি বড় অংশ নিবন্ধনবিহীন।
জানা গেছে, মাগুরা সদর হাসপাতালের কয়েকজন চিকিৎসক নিয়মিত বেসরকারি ক্লিনিকে অস্ত্রোপচার করছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন—ডা. আলী আজম, ডা. শফিউর রহমান, ডা. আশরাফুজ্জামান লিটন, ডা. শহিদুর রহমান, ডা. শবনম মুস্তারি ও ডা. অপূর্ব বিশ্বাস। এমনকি অবসরপ্রাপ্ত ডা. অখিল রঞ্জন বিশ্বাস এবং ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের কর্মরত ডা. আজিজুর রহমানও মাগুরায় এসে বেসরকারি ক্লিনিকে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়াও বেসরকারি পর্যায়ে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন—ডা. দিলারা আকবর লাবনী, ডা. সৈয়দা সালিমা জিনান, ডা. রাকিবুল ইসলাম, ডা. সাব্বির এবং ডা. আব্দুল মান্নান প্রমুখ।
সরকারি ওষুধের অপব্যবহার এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগ বেশ কয়েকটি ক্লিনিক থেকে সরকারি ওষুধ উদ্ধার করেছে। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতাল থেকে সরাসরি এসব ওষুধ পাচার হয়ে যাচ্ছে ক্লিনিকে। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে।
জেলার সিভিল সার্জন ডা. শামীম কবির বলেন, “সরকারি ওষুধ কোথাও পাচার হলে আমরা তা কঠোরভাবে দেখছি। অনিবন্ধিত ক্লিনিকের তালিকা তৈরি হয়েছে, খুব শিগগিরই অভিযান জোরদার করা হবে।”
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মাগুরা কার্যালয়ের ইনস্পেক্টর এস এম জাফরুল আলম বলেন, “জেলায় প্যাথেডিন বিক্রির লাইসেন্স রয়েছে ১০–১১টি প্রতিষ্ঠানের। কিন্তু অনেকে লাইসেন্স ছাড়াই বিক্রি করছেন। এটা বন্ধে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছি।”
মাগুরা ক্লিনিক মালিক সমিতির সভাপতি হাসান বলেন, “আমরা চাই, যেসব ক্লিনিক অনিবন্ধিতভাবে চলছে, সেগুলো বন্ধ হোক। বৈধ প্রতিষ্ঠানের সম্মান ও নিরাপদ চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতেই আমাদের এই উদ্যোগ।” তিনি জানান, জেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে একটি সুনির্দিষ্ট তালিকা তৈরি করে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে সহায়তা করছে সমিতি।
মাগুরা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মহসিন ফকির বলেন, “সদর হাসপাতালের জনবল সংকট রয়েছে। অনেক ডাক্তার ক্লিনিকেও প্র্যাকটিস করছেন। নিয়মের বাইরে কিছু হলে আমরা তদন্ত করছি।”
রোগীদের ভোগান্তি দিন দিন বাড়ছে। কেউ সরকারি হাসপাতালে সেবা না পেয়ে, কেউ ক্লিনিকে অতিরিক্ত খরচ করে সমস্যায় পড়ছেন। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আস্থা কমে যাচ্ছে।
স্থানীয় সচেতন নাগরিক আমিনুর রহমান বলেন, “চিকিৎসা সেবা এখন ব্যবসা হয়ে গেছে। সরকারি চিকিৎসকেরা ক্লিনিকে গিয়ে হাজার হাজার টাকা নেন, অথচ হাসপাতাল ফাঁকা পড়ে থাকে। এটা বন্ধ হওয়া দরকার।”
স্বাস্থ্যসেবার নামে বাণিজ্য, প্রশাসনের নিরবতা এবং অনিয়ন্ত্রিত ক্লিনিক ব্যবসা মিলে মাগুরার স্বাস্থ্যব্যবস্থা আজ চরম দুরবস্থার মুখে। অনিবন্ধিত ক্লিনিক, সরকারি ওষুধের অপব্যবহার এবং নিষিদ্ধ ওষুধ বিক্রির বিষয়গুলোতে দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে বড় ধরনের স্বাস্থ্য সংকট দেখা দিতে পারে—এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ইএইচ