আরিফ হোসেন, বরিশাল ব্যুরো
জুন ২৩, ২০২৫, ০৭:৪৭ পিএম
দলের সুদিন দেখার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করে কেটেছে জীবনের অর্ধেক সময়। ফ্যাসিস্টের হাত থেকে জীবন বাঁচাতে বছরের পর বছর নিজ দেশ অথবা বাড়ী ঘর ছেড়ে থাকতে হয়েছে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে আত্মগোপনে। হয়েছেন নির্যাতন আর জেল-জুলুমের শিকার। তবু রাজপথ ছাড়েনি অধিকাংশ নেতাকর্মীরা।
ফ্যাসিস্টের সাথে যুদ্ধ করে রাজপথে থেকে দিয়েছেন স্বৈরাচারবিরোধী লড়াইয়ের নেতৃত্ব। কিন্তু সেই জনপ্রিয় দলের নেতাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারনে দলের শীর্ষ নেতারা আজ বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হওয়ায় দিন দিন নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়েছে বরিশাল জেলা ও মহানগর বিএনপি।
আলাদা আলাদা গ্রুপে নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তিকে কেউ মানছেন। আবার কাউকে মানছেনা। যে যার মতা নিজস্ব বলয় তৈরি করে বরিশাল নগরীতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন। এতে নেতাকর্মীদের মধ্যে একে অপরের প্রতি বাড়ছে ক্ষোভ, হিংসা আর বিদ্বেষ। তাই দলের কর্মীরা কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে দাবি জানিয়েছেন অভ্যন্তরীণ কোন্দলের মধ্যে থাকা আলাদা আলাদা গ্রুপে নেতৃত্ব দেওয়া সবাইকে এক করে ক্ষোভ, হিংসা বন্ধ করে সুন্দর ভাবে বরিশাল বিএনপিকে সাজানোর।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গত ৩০ বছরে এমন করুণ হাল কখনোই দেখেনি বরিশাল জেলা ও মহানগর বিএনপির নেতাকর্মীরা। এই দুরবস্থার অবসান চান দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা। এ ক্ষেত্রে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন তারা।
বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, দীর্ঘ ১৭ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে থাকায় নেতাকর্মীরা বিভিন্ন সময় হামলা মামলায় জর্জরিত হওয়ায় অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে জেলা ও মহানগর বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম। ফলে দীর্ঘদিন কোনো কমিটিও গঠন করা যায়নি। ভারপ্রাপ্ত কিংবা আহ্বায়ক কমিটির উপর ভরসা করেই চলছে বিএনপির দলীয় কার্যক্রম।
তবে গত ৫ আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরপরই সক্রিয় হয়ে ওঠেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। এতদিন যারা মাঠে ছিলেন না কিংবা দলীয় কোনো কর্মসূচিতে অংশ গ্রহন করেনি তারাই এখন বিএনপি কিংবা এর অঙ্গ সংগঠনের বড় নেতা বনে দাবি করছেন। আর সেই সুবিধাবাদী নেতাদের দাপটে অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরাও। জেলা ও মহানগরে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব রূপ নিয়েছে চরম বিশৃঙ্খলায়। দিন দিন পরিণীত হচ্ছে আলাদা গ্রুপে।
অন্যদিকে দীর্ঘ ৩০ বছর বরিশাল বিএনপির নেতৃত্বে ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার। এ সময় সরোয়ার অনুসারী একটি বৃহৎ নেতাকর্মী-সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি হয়। ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলে সরোয়ার কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব হলে বরিশালে বিএনপির রাজনীতিতে ক্রমান্বয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়েন তিনি। ২০২১ ও ২০২৪ সালে বরিশাল মহানগর বিএনপির দুটি আহ্বায়ক কমিটি হলেও তাতে সরোয়ারের অনুসারীদের বাদ দেওয়া হয়।
সূত্র মতে, বর্তমানে বরিশাল মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন মনিরুজ্জামান খান ফারুক, ১ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা খানম নাসরিন ও সদস্য সচিব জিয়াউদ্দিন সিকদার। এর মধ্যে মনিরুজ্জামান ফারুক ও জিয়াউদ্দিন সিকদার মহানগর বিএনপির একাংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
অন্যদিকে মহানগর বিএনপির ১ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা খানম নাসরিন বিএনপি নেতা হক মাস্টার ও লিটুসহ ছাত্রদল-যুবদলের কিছু নেতাদের নিয়ে আরেক অংশের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন বেশ কিছু দিন ধরে।
একইভাবে মহানগর বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব এ্যাড.মীর জাহিদুল কবির জাহিদও কিছু নেতাকর্মীদের নিয়ে আরেক অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার পর থেকে । এছাড়া বিএনপি যে-সব নেতাদের বর্তমান মহানগর কমিটিতে জায়গা হয়নি সেই পদবঞ্চিত নেতারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার।
মহানগর বিএনপির নেতাদের চতুর্মুখী কর্মকাণ্ডে হযবরল ও নৈরাজ্যকর অবস্থা দেখা দিয়েছে মহানগর বিএনপিতে। এদিকে শুধু মহানগর বিএনপিই নয়, জেলা ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির কমিটি নিয়েও বিরোধে জড়িয়ে পড়ছেন নেতাকর্মীরা। সেখানেও হচ্ছে গ্রুপিং। নেতৃত্ব দিতে দেখা যাচ্ছে আলাদা আলাদা ভাবে।
সূত্র জানায়, বরিশাল জেলা দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য ও কমিটির আহ্বায়ক আবুল হোসেন খান এবং সদস্য সচিব আবুল কালাম শাহীন। তারও গত রোববার (২২ জুন) রাতে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বাকেরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্তকে কেন্দ্রীয় নির্দেশনা হিসেবে উল্লেখ করলেও অনেক নেতা মনে করছেন, এটি বিএনপি দলীয় সাবেক এমপি ও বরিশাল দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবুল হোসেন খানের সমর্থিত কমিটির পরাজয়।
বাকেরগঞ্জে পদবঞ্চিত অধিকাংশ নেতারা জানিয়েছেন, সাবেক এমপি আবুল হোসেন খান ক্ষমতার অপব্যবহার করে বাকেরগঞ্জের বিলুপ্ত ইউনিয়ন কমিটিগুলো পুনরায় সক্রিয় করে নতুন ইউনিয়ন ও উপজেলা কমিটির নামে বিভিন্ন ওয়ার্ডে পকেট কমিটি গঠন করেন। এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত শেষে কেন্দ্রীয় দলীয় সিদ্ধান্তে উপজেলা কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগপন্থীদের পুনর্বাসনের অভিযোগও রয়েছে।
২২ জুন রোববার রাতে রুহুল কবির রিজভীর স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, বরিশাল দক্ষিণ জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির গঠিত কমিটির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগে তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছিল। তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে উপজেলা আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। একইসঙ্গে ফ্যাসিস্টবিরোধীদের নিয়ে নতুন কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, আগের কমিটির সদস্য সচিব নাসির হাওলাদারকে নতুন কমিটিতে আহ্বায়ক, সদস্য সচিব বা যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে না রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। একই নির্দেশনা দেওয়া হয় অভিযোগকারী দুই নেতা আবদুল মালেক সিকদার ও শওকত হোসেন হাওলাদারকে নিয়েও।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও সাবেক এমপি আবুল হোসেন খান বলেন, কেন্দ্র থেকে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে শুনেছেন, তবে এখনো সেটি হাতে পাননি। জেলা বিএনপির কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
দলীয় একাধিক নেতারাকর্মীরা জানিয়েছেন, বরিশাল জেলা ও মহানগর বিএনপিতে গ্রুপিং ভাঙতে কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে বরিশাল ও ঢাকায় একাধিক বৈঠক হয়েছে। তবে উভয় পক্ষই তাদের দাবির বিষয়ে অনড় থাকায় প্রতিটি বৈঠকই ভেস্তে গেছে। শুধু তাই নয় তার সঙ্গে হয়েছে গ্রুপিং।
এ বিষয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির অন্যতম সদস্য ও বরিশাল সদর-৫ আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী আবু নাছের মোহাম্মদ রহমতুল্লাহ জানিয়েছেন, নেতৃত্বে প্রতিযোগিতা থাকা ভালো কিন্তু নোংরামি করে পরস্পরের বিরুদ্ধে কাদা ছোড়াছুড়ি করা দলের জন্য মঙ্গলজনক নয়।
বরিশাল জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম খান রাজন বলেন, এতদিন যারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে রাজনীতি করেছেন, এখন তারা অর্থের বিনিময়ে আওয়ামী লীগকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের লোকজনকে নিজের কর্মী বানাচ্ছেন।
মহানগর বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব মীর জাহিদুল কবির জাহিদ বলেন, ছাত্রদল, যুবদল ও বিএনপির ত্যাগী নেতাকর্মীরা বর্তমান কমিটির কার্যক্রমে হতাশ ও ক্ষুব্ধ। তিনি বলেন, বর্তমানে ত্যাগী নেতাদের অবমূল্যায়ন করে হাইব্রিড ও অনুপ্রবেশকারীদের নানাভাবে পদ-পদবি দেওয়া হচ্ছে। ফলে মহানগর বিএনপিতে নেতৃত্ব সংকট দেখা দিয়েছে। সেজন্য সাবেক ও বর্তমান ত্যাগী নেতারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন।
সার্বিক বিষয় নিয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির বরিশাল বিভাগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমানের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল। এখানে অভ্যন্তরীণ বিরোধ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে। কিন্তু বরিশাল মহানগর কমিটিতে যা হচ্ছে, তা মেনে নেওয়া যায় না। বিষয়টি নিয়ে হাইকমান্ড অবগত। তারা বিষয়টি দেখবেন।
এ বিষয়ে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, আমরা লক্ষ্য করছি বরিশাল জেলা ও মহানগর বিএনপির নেতারা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়েছেন। এতে করে দলের ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু দলের স্বার্থে ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।
আরএস