Amar Sangbad
ঢাকা রবিবার, ১১ মে, ২০২৫,

ধ্বংস নয় সৃষ্টিই বেঁচে থাকার পথ

রাশিদুল হাসান

রাশিদুল হাসান

জুলাই ৮, ২০২৩, ১১:৩৯ এএম


ধ্বংস নয় সৃষ্টিই বেঁচে থাকার পথ

আমাদের জীবন ধারণের জন্য খাদ্য অপরিহার্য। তার চেয়েও বেশি অপরিহার্য অক্সিজেন। খাবার গ্রহণ না করেও কয়েকদিন বেঁচে থাকা যায়। কিন্তু অক্সিজেন ছাড়া প্রাণ বাঁচতে পারে না কয়েকটি মিনিট! আর সে কারণেই, অক্সিজেনের পর্যাপ্ত উৎপাদন ধরে রাখতে, অর্থাৎ পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বৃক্ষের গুরুত্বও তুলনাহীন। এক কথায় বৃক্ষ হলো মানবজাতির সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও পরীক্ষিত বন্ধু। বৃক্ষ অতিরিক্ত শব্দদূষণ ও তাপমাত্রা শোষণপূর্বক পরিবেশকে শুদ্ধ ও নির্মল রাখে। আমাদের প্রশ্বাসের সঙ্গে নির্গত কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণপূর্বক মানব তথা, অন্য প্রাণীর বেঁচে থাকার মূল উপাদান অক্সিজেন নির্গমন করে।  
বৃক্ষ ব্যতিরেকে পৃথিবীতে মানবজাতি ও অন্য প্রাণীর অস্তিত্ব অকল্পনীয়। মাতৃস্নেহে বৃক্ষ, ফুল, ফল ও ছায়া দেয় এবং পশুপাখি ও অনুজীবনের আশ্রয়স্থল হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। একজন সুস্থ, প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি প্রতি মিনিটে ৭২ বার শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়, অর্থাৎ অক্সিজেন গ্রহণ এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গমন করে।

বাংলাদেশে নির্বিচারে বৃক্ষনিধন ও বনাঞ্চল ধ্বংসের প্রতিবাদে আমাদের সবাইকে আরও সোচ্চার হতে হবে। প্রতিটি নাগরিকের বৃক্ষায়ন তথা সবুজায়নে সামাজিকভাবে আন্দোলনকে গতিশীল ও বেগবানের মাধ্যমে বর্তমান এবং আগামী প্রজন্মের জন্য রেখে যেতে পারব একটি সুন্দর ও বাসযোগ্য পৃথিবী

বিশেষজ্ঞদের মতে, আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ দেশের বনাঞ্চল সংকুচিত হয়ে যাওয়া। কিছু প্রভাবশালী নির্বোধ-অর্বাচীন ও অর্থলিপ্সু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নির্বিচারে সুন্দরবন, ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান, মধুপুরের বন ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চল উজাড়করত ঢাকা, চট্টগ্রাম ও অন্য বড় বড় শহরের ফার্নিচারের দোকানগুলোতে বনের কাঠ সরবরাহ করা হয় এবং হাজার হাজার ব্রিক ফিল্ডে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

ঢাকা মহানগরের রাস্তা উন্নয়ন ও সৌন্দর্য বৃদ্ধির অজুহাতে ঢাকার সিটি কর্পোরেশন ও অন্য উন্নয়ন সংস্থা প্রায়শই বৃক্ষ নিধন করে। বৃক্ষনিধনের ফলে বায়ুদূষণ ও দাবদাহ প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পায়। ঢাকা শহরের প্রায় সব মাঠ ও পার্ক সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন। পার্ক ও মাঠগুলো পরিকল্পিতভাবে লাখ লাখ বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যা করে ঢাকা শহরকে সবুজায়নের মাধ্যমে দূষণমুক্ত ও অপরূপ সবুজ ঢাকা রূপান্তর করতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। আমরা যদি প্রত্যেকেই নিজ নিজ বাড়ির আঙিনায় ও ছাদে বৃক্ষ রোপণ এবং নিয়মিত পরিচর্যা করি, তাহলে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি ভয়াবহ বায়ুদূষণ এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে পারে।

২০১৯ সালে ১৫ মে ‘ফিলিপাইনে গ্র্যাজুয়েশন লিগ্যাসি ফর দি এনভায়রনমেন্ট অ্যাক্ট’ প্রণীত হয়। নতুন এই আইনে কোনো শিক্ষার্থীকে মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পাস করতে হলে কমপক্ষে ১০টি করে গাছ লাগাতে হবে। তবে এ গাছ লাগাতে হবে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত স্থানে। বাংলাদেশেও অনুরূপ আইন প্রণয়ন করা অতীব জরুরি বলে পরিবেশবিদরা মনে করেন। বাংলাদেশে বৃক্ষ রোপণে বিশেষ অবদানের জন্য ‘প্রধানমন্ত্রী জাতীয় পুরস্কার’ পরিধি ও সম্মানির পরিমাণ আকর্ষণীয় হওয়া বাঞ্ছনীয়।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের মতে, ভালোমানের বায়ুর ক্ষেত্রে স্কোর শূন্য থেকে ৫০। ৫১ থেকে ১০০ হলে তাকে ‘মধ্যম’ বা ‘গ্রহণযোগ্য’ মানের বায়ু হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

১০১ থেকে ১৫০ স্কোরকে ‘সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর’ ধরা হয়। স্কোর ১৫১ থেকে ২০০ হলে তাকে ‘অস্বাস্থ্যকর’ বায়ু বলে মনে করা হয়। আর স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে তাকে ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ বায়ু বলে মনে করা হয়। ৩০১ থেকে তার ওপরের স্কোরকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ধরা হয়। জানুয়ারি ২০২৩, বায়ুদূষণে বিশ্বে ছয়দিন ছিল ঢাকা শীর্ষে। ২৬ জানুয়ারি একিউআইয়ের প্রতিবেদন মোতাবেক প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ২৭৬ মাইক্রোগ্রাম দূষণে ঢাকা শীর্ষে অবস্থান করে। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল ১৯৭ স্কোর নিয়ে করাচি এবং তাসখন্দ ১৯৪ স্কোর নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে। আইকিউএয়ার ৩১ মে ২০২৩ প্রতিবেদনে বিশ্বের ৯৯ শহরের মধ্যে বায়ুদূষণে ১৬৪ স্কোর নিয়ে জাকার্তার অবস্থান প্রথম। ১৬১ স্কোর নিয়ে ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। ১৫৬ স্কোর নিয়ে কুয়েত সিটি তৃতীয় এবং চিলির মান্টিয়াগোর অবস্থান চতুর্থ। ৯ মে ২০২৩, বায়ুদূষণের শীর্ষে ছিল ২৪৮ স্কোর নিয়ে নয়াদিল্লি। দ্বিতীয় অবস্থানে ১৭৬ স্কোর নিয়ে বায়ুদূষণে ছিল লাহোর। ১৭০ স্কোর নিয়ে ঢাকা তৃতীয় অবস্থানে।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের নিরিখে মহানগরে ২৫ শতাংশ এলাকা বৃক্ষ ও তরুলতা আচ্ছাদিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। ২০১৯-এ স্যাটেলাইটের জরিপ অনুযায়ী, ঢাকা মহানগরের মাত্র ৮ শতাংশ এলাকাকে গ্রিন জোন এরিয়া হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বৃক্ষ পরিবেশরক্ষায় সহায়তা করে এবং শব্দদূষণ রোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। পরিবেশবিদদের মতে, এক হেক্টর বন ১০ ডেসিমেল শব্দ হ্র্রাস করতে পারে।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রতিটি দেশের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা বাঞ্ছনীয়। ২০১৮ সালে এফএওর প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে মোট ১৩ দশমিক ৫০ শতাংশ বনভূমি রয়েছে। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করছে। সিডর-আইলার ভয়াবহতা থেকে সুন্দরবন লাখ লাখ মানুষের জীবন এবং হাজার হাজার ঘরবাড়ি রক্ষা করে। এক্ষেত্রে সুন্দরবনের আত্মত্যাগ অকল্পনীয়। প্রায় ৫ লাখ মানুষের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন এই সুন্দরবন। রামপাল, পায়রা ও মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প সুন্দরবন এবং পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারের ভয়াবহ ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় সুন্দরবনকে অন্তর্ভুক্তের পর ৩০ আগস্ট ১৯৯৯ পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় থেকে ১০ কিলোমিটার বিস্তৃত সুন্দরবন রিজার্ভ ফরেস্টের চারদিক এলাকাকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে। সুন্দরবনের পরিবেশদূষণের মাত্রা যাতে ভয়াবহ রূপ নিয়ে অত্র অঞ্চলের জীববৈচিত্র্যে কোনোরকম নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে, তার জন্য সরকার এই ঘোষণা দেয়।

আমাজন বন পৃথিবীর ফুসফুস হিসেবে পরিচিত। ইহা দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদী বিধৌত বিশাল বনাঞ্চল। আমাজন বন ৭০ লাখ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত। তন্মধ্যে ৫৫ লাখ বর্গকিলোমিটার বনাঞ্চল মূলত আর্দ্র জলবায়ু দ্বারা প্রভাবিত। আয়তন বিবেচনায় আমাজন বাংলাদেশের তুলনায় ৩৮ গুণ এবং ভারতের চেয়ে গুণ বড়। পৃথিবীতে যত রেইন ফরেস্ট আছে তার ৫০ শতাংশ শতাংশই আমাজনের এই বিচিত্র বনভূমিতে। পৃথিবীতে মোট উৎপাদিত অক্সিজেনের ২০ শতাংশ উৎপাদিত হয় আমাজন বন থেকে। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ও গভীরতম দীর্ঘ নদী (৬৪৩৭ কিলোমিটার)। আমাজন নদীই পৃথিবীর বৃহত্তম বনাঞ্চল আমাজনের জীবনীশক্তি। আমাজন বনের ৬০ শতাংশ ব্রাজিলে, ১৩ শতাংশ পেরোতে এবং ১০ শতাংশ কলম্বিয়াতে অবস্থিত।

ব্রাজিলের কট্টর ডানপন্থি প্রেসিডেন্ট জইর বলসনারের শাসন আমলে ২০১৯-২০২২ পর্যন্ত আমাজনের ৩৫ হাজার ১৯৩ বর্গকিলোমিটার বন পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হয়। প্রেসিডেন্টের মূল লক্ষ্য ছিল আমাজনের বনাঞ্চল ধ্বংস করে খনিজ সম্পদ আহরণ করা, সয়াবিন তেল চাষের জন্য কৃষিজমি সমপ্রসারণ এবং গোচারণ ভূমি বৃদ্ধি করা। অদ্যাবধি প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার বর্গকিলোমিটার গোচারণ ভূমিতে পরিণত করা হয়েছে। বামপন্থি প্রেসিডেন্ট লুলা আমাজন রক্ষায় দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। জাতীয় মহাকাশ সংস্থার স্যাটেলাইট পর্যবেক্ষণে ২০২৩-এর জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ১৯৮৬ বর্গকিলোমিটার বনভূমি ধ্বংস করা হয়েছে, যা গত বছরে একই সময়ে ধ্বংসের তুলনায় অর্ধেক এবং বিশ্ববাসীর জন্য সুখবর বলা যায়। 

সর্বোপরি, বাংলাদেশে নির্বিচারে বৃক্ষনিধন ও বনাঞ্চল ধ্বংসের প্রতিবাদে আমাদের সবাইকে আরও সোচ্চার হতে হবে। প্রতিটি নাগরিকের বৃক্ষায়ন তথা, সবুজায়নে সামাজিকভাবে আন্দোলনকে গতিশীল ও বেগবানের মাধ্যমে বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের জন্য রেখে যেতে পারব, একটি সুন্দর ও বাসযোগ্য পৃথিবী।

লেখক : প্রাক্তন সাংগঠনিক সম্পাদক, জাতীয় চার নেতা পরিষদ।
 

Link copied!