Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ০৩ মে, ২০২৪,

বন্যাদুর্গতদের কলেরার ঝুঁকি

মাহমুদুল হাসান

জুলাই ৪, ২০২২, ০২:৫৯ এএম


বন্যাদুর্গতদের কলেরার ঝুঁকি

১৬ দিনের বন্যায় ১০২ জনের মৃত্যু। মৃত্যুর পরিসংখ্যান বলছে, সবচেয়ে বেশি মারা গেছে পানিতে ডুবে। দুর্গত এলাকায় পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়েছে ৭৫ জনের। এদের মধ্যে অধিকাংশ শিশু। ২৮ জেলায়  সাড়ে ১১ হাজারের বেশি পানিবাহিত রোগ, চর্মরোগ, সাপে কাটা এবং চোখের সমস্যায় ভুগছেন।

বন্যার পানি নামতে শুরু করলেও দুর্গত মানুষের জন্য নেই সুখবর। বর্ষা মৌসুম শেষ হয়নি। আবারও রয়েছে বন্যার ঝুঁকি। পানি নেমে গেলে দেখা দিতে পারে কলেরার প্রাদুর্ভাব। এ যেন উভয় সঙ্কট। ইতোমধ্যে সুপেয় পানির উৎসগুলোও দূষণের শিকার। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ১৬ দিনের বন্যায় দেশের পাঁচ বিভাগের ২৮ জেলার ৬৯ উপজেলা প্লাবিত হয়েছে। শুধু সুনামগঞ্জে বন্যার প্রকোপে ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। সিলেটে দুই হাজার ৬২৩ জন বিভিন্ন রোগে ভুগছেন। এ পর্যন্ত এ দুটো সংখ্যা বন্যায় আক্রান্ত-মৃতে সর্বোচ্চ।

এদিকে বন্যার্তদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুই হাজার ৪৭টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। 

জনস্বাস্থ্য ও সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্যায় প্লাবিত এলাকায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। সুপেয় পানি, খাদ্য-পুষ্টি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যু ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। সেই সাথে পানি নেমে যাওয়ার পর দুর্গত এলাকায় ব্যাপকভাবে কলেরা ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। এ জন্য আগে থেকেই বন্যাদুর্গত এলাকায় কলেরা, ডায়রিয়াসহ অন্যান্য পানিবাহিত রোগ মোকাবিলায় পর্যাপ্ত ওষুধ মজুত রাখতে হয়। দ্রুত সময়ে কলেরার টিকা খাওয়ানো গেলে সুফল বেশি পাওয়া যায়। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যমতে, সিলেট, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, রংপুর ও ঢাকা বিভাগে ১৭ জুন থেকে গতকাল পর্যন্ত ১৬ দিনের বন্যায় ডায়রিয়া, সর্প দংশন, পানিতে ডুবা ও আঘাতজনিত কারণসহ নানা রোগে ১০২ জনের মৃত্যু হয়েছে। 

এরমধ্যে সিলেট বিভাগে ৫৬ জন,  ময়মনসিংহ বিভাগে ৩৫ জন, রংপুর বিভাগে ১০ জন এবং ঢাকায় একজনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া বন্যাকবলিত ২৮ জেলায় চোখের রোগ, সাপের ছোবল, ডায়রিয়া ও চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছেন বন্যাদুর্গত এলাকার ১১ হাজার ৬৬২ জন। 

এর মধ্যে শুধু গতকাল আগের ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন সাতজন ও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ৮৮৮ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত ১৬ দিনে ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়েছে সাত হাজার ৪৮৬ জন। ডায়রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে একজনের। আরটিআই (চোখের রোগ) রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ৪৭৯ জন, বজ্রপাতে ১৫ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন, তারা সবাই মারা গেছে। সর্প দংশনে ১৪ জন আক্রান্ত হয়ে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে, পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়েছে ৭৫ জনের।  

অন্যান্য কারণে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতের হিসাবে তালিকার শীর্ষে রয়েছে সুনামগঞ্জ। সেখানে বন্যায় ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। সিলেটে ১৮ জন, নেত্রকোনায় ১৩, জামালপুর ৯, শেরপুর সাত, ময়মনসিংহ ছয়, লালমনিরহাট ছয়, হবিগঞ্জ পাঁচ, মৌলভীবাজার পাঁচ, কুড়িগ্রাম চার ও টাঙ্গাইলে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। 

দুর্গত এলাকার বিভাগীয় তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিভিন্ন রোগাক্রান্তের হিসেবেও সিলেটে সবচেয়ে বেশি রোগী। সিলেটের চার জেলায় সাত হাজার ৭৪৪ জন ডায়রিয়া, চোখের রোগ, চর্মরোগ ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত। ময়মনসিংহের চার জেলায় আক্রান্ত এক হাজার ৯৪৫ জন, রংপুরের আট জেলায় এক হাজার ৩২২ জন, চট্টগ্রামের ১১ জেলায় ৫২৩ জন এবং ঢাকার একটি জেলায় ১২৮ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হয়েছেন সিলেটে। সেখানে দুই হাজার ৬২৩ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। 

এবারের বন্যায় ময়মনসিংহ বিভাগের চার জেলা, চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জেলা, রংপুর বিভাগের আট জেলা, সিলেট বিভাগের চার ও ঢাকার একমাত্র জেলা টাঙ্গাইলসহ ২৮ জেলার ১৮৫টি উপজেলার মধ্যে ৬৯টি দুর্গত। এসব জায়গায় সেবা দিতে দুই হাজার ৪৭টি মেডিকেল টিম কাজ করছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। 

সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, ‘বন্যায় স্বাস্থ্যের দুই থেকে তিনটি বড় ক্ষতি হয়। এক নম্বরে জীবন রক্ষাকারী পানি দূষিত হয়ে পড়ে। ছড়িয়ে পড়ে পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব। দ্বিতীয়ত বানের পানিতে সব যেহেতু তলিয়ে যায় তাই খাদ্যের সংকট সৃষ্টি হয়। এতে গর্ভবতী মা, বয়স্ক নারী-পুরুষ ও শিশুরা অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়। অপুষ্টি হলে সংক্রমণ চক্রে পড়ে যায়। 

ধরুন গর্ভবতী মায়ের অপুষ্টি দেখা দিলে বাচ্চা আন্ডার ওয়েট জন্ম নেবে। এ জন্য আপদকালীন সময়ে পুষ্টির দিকে নজর দিতে হবে। তৃতীয়ত, বন্যা মানেই শিশুমৃত্যু। আমরা তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছি বন্যায় সবচেয়ে বেশি শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। বাচ্চারা যাতে ঢুবে মারা না যায় এ জন্য আমরা বলছি, বন্যার প্রকোপ শুরু হলে স্থানীয় পর্যায়ে বানানো যায় এমন খাঁচায় শিশুকে মায়ের পাশে রাখুন।’ 

তিনি বলেন, ‘আরেকটি ভয়ের বিষয় হলো সাপে কাটা। বানের পানিতে সাপের বাসস্থান ডুবে গেলে সাপ মানুষ ও গরুর পাশে আশ্রয় নেয়। সেখানে সাপে কাটার ঝুঁকিতে পড়তে হয়। পানি নামতে শুরু করলে কলেরার প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। এবারও সেই ঝুঁকি আছে। এ জন্য জরুরি টিম সক্রিয় রাখতে হবে। আপদকালীন ওষুধ মজুত রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে বন্যাপ্রবণ এলাকায় কলেরার টিকা দেয়া যেতে পারে।’

Link copied!