Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪,

বহির্বিভাগে সেবাবঞ্চিত কর্মজীবীরা

মাহমুদুল হাসান

আগস্ট ৪, ২০২২, ০৩:৪৫ পিএম


বহির্বিভাগে সেবাবঞ্চিত কর্মজীবীরা

সাফায়েত হাসান (২৭) রাজধানীর পান্থপথ এলাকায় একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। কর্মস্থল থেকে ছুটি নিয়ে গতকাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) এসেছেন বহিঃবিভাগে চিকিৎসা নিতে। চিকিৎসকের চেম্বারের সামনে কথা হয় এই ব্যস্ত মানুষের সঙ্গে।

কথায় কথায় জানালেন দুঃখের কথা। কর্মজীবী মানুষের জন্য বহিঃবিভাগে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ নাকি মোটেও সহজ নয়। সাফায়েত বলেন, আমাদের জন্য সরকারি হাসপাতালে বহিঃবিভাগের সেবা গ্রহণ অনেকটা যুদ্ধের মতো। কর্মস্থলে ছুটি না পাওয়া গেলে এই সেবা মিলে না।

অথচ জরুরি সেবা তো এমন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সীমাবদ্ধ হওয়ার কথা নয়। ওয়ার্কিং ডেতে আমাদের চিকিৎসা গ্রহণ করা দুরূহ হয়ে ওঠে। কিন্তু শুক্রবার কিংবা চব্বিশ ঘণ্টা সরকারি হাসপাতালে বহিঃবিভাগ চালু থাকলে সাধারণ কর্মজীবী মানুষ সেবা গ্রহণ করতে পারবে। এতে সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা হবে। একই সঙ্গে মধ্যবিত্ত কর্মজীবী মানুষের চিকিৎসা ব্যয় কিছুটা হলেও কমে আসবে।

গত রোববার ঢাকা কলেজের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী নাসরুল্লাহর সঙ্গে কথা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহিঃবিভাগের সামনে। চিকিৎসা নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় এই শিক্ষার্থী বলেন, সপ্তাহে ছয়দিন ক্লাস থাকে। ইচ্ছে থাকলেও বহিঃবিভাগে চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ হয় না। এজন্য বাধ্য হয়েই আমাদের প্রাইভেট চেম্বারে চিকিৎসকের দারস্থ হতে হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেন, ছুটি সবারই প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের যেহেতু চিকিৎসক কম এবং চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেশি এজন্য রোস্টার পদ্ধতিতে সরকারি হাসপাতালের বহিঃবিভাগ চালু থাকলে আমাদের সেবা গ্রহণের সুযোগ হয়।

কারণ জরুরি সেবার অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যেমন পুলিশ স্টেশন, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন রোস্টার পদ্ধতিতেই কিন্তু সপ্তাহে সাতদিন সেবা দিয়ে আসছে। বহিঃবিভাগের ক্ষেত্রে রোস্টার পদ্ধতি চালু করা সম্ভব হলে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন সহজ হবে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, ওয়ার্ক ডেতে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আউটডোর খোলা থাকে। যারা কর্মজীবী মানুষ, যারা স্কুলে যায় বা যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ে তারা এই সময়ে আসতে পারছে না। তার মানে আমরা তাদের স্বাস্থ্যসেবার প্রাপ্যতা বন্ধ করে দিচ্ছি। তাকে আসতে হলে ছুটি নিয়ে আসতে হবে।

এ ছাড়াও আমরা এসডিজিতে স্বাক্ষর করেছি, সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করব বলে। সেটা যদি আমরা করতে চাই, তাহলে অবশ্যই স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ করতে হবে। এজন্য আমাদের আউটডোর, ইনডোর ও ইমার্জেন্সি সব ধরনের সেবাই সমপ্রসারণ করতে হবে।

এজন্য অনেক দেশ সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবায় এগিয়ে গিয়েছে। আমারদের সরকারকে চিন্তা করতে হবে। এটা যদি আমরা না করি তাহলে কয়েকটি ঘটনা ঘটবে, আমাদের স্বাস্থ্যসেবায় খরচ বেড়ে যাবে। এটা যদি নিশ্চিত না করা যায় তাহলে মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে আরও বঞ্চিত হবে। আমাদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে আরও দারিদ্র্য সীমার মধ্যে ঢুকে পড়বে।

সুতরাং এগুলো বিবেচনা করে আমাদের উচিত সাপ্তাহিক দিন বলে কথা না, ২৪ ঘণ্টা আউটডোর-ইনডোর-ইমার্জেন্সি খোলা রাখতে হবে। এগুলো শিফট অনুযায়ী চালাতে হবে। সংবিধানে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। যখন অসুস্থতা হবে, তখনই যেন আমি স্বাস্থ্যসেবাটা পাই।

এগুলো করতে না পারলে স্বাস্থ্যসেবায় আমরা খুব বেশি আগাতে পারব না। শিফট অনুযায়ী করলে আমাদের এসডিজি বাস্তবায়নে সহায়ক হবে। রোস্টার বা শিফট ডিউটি হলে কারো কাজ বেশি করার প্রয়োজন পড়ছে না। আমরা যদি আউটডোরটাকে ভোর ৬টা থেকে খুলি তাহলে এটা তিন শিফটে চালাতে পারব। সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবার প্রাপ্যতা বেড়ে যাবে।

যেকোনো মানুষ তার স্বাস্থ্যসেবাটা তার সুবিধাজনক সময়ে নিতে পারবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমরা এটা চাই কি-না? মুখে বা লিখিত বলি স্বাস্থ্যসেবা সমপ্রারণ বাড়াতে চাই, কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি সংকুচিত করছি। আমরা জুজুর মতো ভয় পাই, আউটডোর বাড়ালে আমাদের চিকিৎসকদের ডিউটি আওয়ার বেড়ে যাবে।

এদিকে ২০২১ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এক হাজার মানুষের জন্য যেখানে একজন ডাক্তার থাকার কথা। কিন্তু ২৩ হাজার মানুষের জন্য রয়েছে মাত্র একজন ডাক্তার। স্বাস্থ্যসেবা পেতে মানুষকে এমনিতেই সবচেয়ে বেশি ব্যয় করতে হয়। বিশেষায়িত চিকিৎসা পেতে মানুষকে ৬৮ শতাংশেরও বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়। ১২ শতাংশ মানুষ অসুস্থ হলে আনুষ্ঠানিক চিকিৎসা গ্রহণ করেন না।

১৭ শতাংশ নাগরিক সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন আর ৪০ শতাংশকে নির্ভর করতে হয় বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের ওপর। ছুটির দিনে বহিঃবিভাগ চালু করা সম্ভব হলে ব্যক্তির ব্যয় কিছুটা হলেও সংকোচন করা সম্ভব হবে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, আমাদের দেশে এটা একটা ট্র্যাডিশন। বছরের পর বছর আমরা হাসপাতালের সার্ভিস এভাবে দিয়ে যাচ্ছি। তবে ইমাজেন্সি সার্ভিস চলমান থাকে। আমি আমাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজের কথা বলতে পারি, এখানে প্রতিদিন এক হাজারের বেশি রোগীকে চিকিৎসা দেয়া হয়। সব ধরনের রোগীকে এখানে চিকিৎসা দেয়া হয়।  কেউ এসে ফেরত চলে গেছে এমনটা না, সবাইকেই চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়।

শিফটিং ডিউটির বিষয়ে তিনি বলেন, এটা আসলে নীতি নির্ধারকদের বিষয়। এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নাই। সরকার থেকে আমাদের যে আদেশ আসে, সেটা আমরা পালন করে থাকি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, সারা পৃথিবীতে আউটডোর ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে না। কোথাও নাই। ইমার্জেন্সি যেটা সেটা ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকে। তবে, ইমার্জেন্সিতে সেভাবে কনসালটেন্সি এভেলএবল নাই। তবে, আমরা একটা প্ল্যান করছিলাম ৮টা-৫টা করা যায় কি-না। এবং শুক্র-শনি দুদিন ছুটি করে বাকি দিন রোস্টারে চালানো যায় কি-না। এ রকম একট নির্দেশনা মন্ত্রী মহোদয় আমাদের দিয়েছিলেন।

এসডিজি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এটাকে নতুন করে ভাবার সুযোগ আছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেটা তো অবশ্যই রয়েছে। তবে কথা হচ্ছে রুটিন সেবা অর্থাৎ আউটডোর সেবা পৃথিবীর কোথাও খোলা থাকে না। এটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। তবে মন্ত্রী মহোদয় এ বিষয়ে আমাদের টাচ দিয়েছেন।

এ বিষয়ে আমরা পরিকল্পনা তৈরি করছি। একটা পরিবর্তন আমরা আনতে যাচ্ছি। আমরা সবার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলছি। হুট করে আনলেই এটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব না। ধীরে ধীরে এটা বাস্তবায়ন করতে হবে। তাহলেই এটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
 

Link copied!