Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২০ মে, ২০২৪,

রক্তের সব উদ্যোগ শহরমুখী

মাহমুদুল হাসান

নভেম্বর ২, ২০২২, ০১:২৩ এএম


রক্তের সব উদ্যোগ শহরমুখী

রক্ত! যার কোনো বিকল্প তৈরি হয়নি। একের রক্তে বাঁচে অন্যের প্রাণ। প্রতি বছর দেশে প্রায় ১০ লাখ ব্যাগ রক্তের চাহিদা। কিন্তু বেশিরভাগ রক্তের জোগান দেয় পরিবার। মাত্র ৩৪ শতাংশ রক্তের উৎস এখনো স্বেচ্ছাসেবক। বৃহৎ জনগোষ্ঠীর দেশে স্বেচ্ছায় শতভাগ রক্তের জোগান সম্ভব হয়নি। অথচ প্রতিবেশী থাইল্যান্ডে এই সংখ্যা শতভাগ।

এদিকে রক্তপরিসঞ্চালন সংক্রান্ত সরকারি-বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী অধিংকাংশ উদ্যোগ শহরমুখী। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উপজেলাপর্যায়েও স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারিত হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক সন্তান জন্মদান, সড়ক দুর্ঘটনা ও ছোটবড় বিভিন্ন অপারেশনের জন্য প্রান্তিকেও প্রতিদিন রক্তের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু এসব চাহিদা মেটাতে সরকারি উদ্যোগ খুবই নগণ্য।

এক জরিপে দেখা গেছে, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের বেশি মৃত্যু হয়। যাদের অধিকাংশ শহুরে জীবনের বাইরে মৃত্যুবরণ করেন। কারণ ঠিক সময়ে তাকে পর্যাপ্ত রক্ত দেয়া সম্ভব হয় না। জেলা ও উপজেলাপর্যায়ে রক্তের চাহিদা মেটাতে একমাত্র ভরসা সোশ্যাল মিডিয়া। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আসাদুল ইসলাম বলেন, গ্রামে চিকিৎসাসেবার পরিধি বেড়েছে। রক্তের চাহিদাও বেড়েছে। কিন্তু সেই অনুপাতে সরকারি উদ্যোগ বাড়েনি। এক্ষেত্রে তরুণদের অংশগ্রহণ বেড়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) সাথে আমরা ৩০টি জেলায় প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থী ও যুবকের রক্তের গ্রুপ নির্ণয় শেষে সংশ্লিষ্ট জেলা সদর হাসপাতালে তালিকা দিয়েছি। যাতে প্রয়োজনে সেই স্বেচ্ছাসেবীদের ফোন করে রক্তের জোগান দিতে পারে। এটা কোনো স্থায়ী উদ্যোগ নয়। দেশের প্রতিটি উপজেলায় কার্যকর সরকারি ব্লাডব্যাংক থাকা প্রয়োজন।

আশার দিক হলো, পাল্টেছে প্রেক্ষাপট। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে দেশের প্রান্তিকপর্যায়ে এখন স্বেচ্ছাসেবীদের ব্লাডব্যাংক গড়ে ওঠেছে। এমনই একটি সংগঠন জাজিরা ব্লাডব্যাংক। গত পাঁচ বছর আগে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবীদের উদ্যোগে ফেসবুকভিক্তিক এই রক্তদাতাদের সংগঠনটি যাত্রা শুরু করে। অল্প সময়ে প্রায় তিন হাজারের বেশি ব্যাগ রক্তের জোগান দিয়েছে সংগঠনটি। এসব ছোট সংগঠন সাধ্যমতো রক্তের জোগান দিচ্ছে। যদিও এই চেষ্টা পর্যাপ্ত নয়।

সংগঠনের উপদেষ্টা জোবায়ের আহমেদ সজীব জানান, গ্রামে পর্যাপ্ত রক্তদাতা না থাকায় বছরে অনেক প্রাণহানি ঘটে। গ্রামের  মানুষের মধ্যে রক্তদান নিয়ে ভীতি আছে। তাদের এই ভীতি দূর করা গেলেই স্বেচ্ছায় রক্তদান নিশ্চিত হবে। আমরা পাঁচ বছর কাজ করতে গিয়ে যেটা দেখেছি, এ সমস্যা নিরসনে উপজেলাপর্যায়ের কলেজগুলোতে স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ফ্রি ব্লাডগ্রুপিং কর্মসূচি হাতে নিয়ে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের ডাটা সংগ্রহ করতে পারে। রোগীর প্রয়োজনে সেই ডাটা মনিটরিং করলে প্রাথমিকভাবে চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে।

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রতিবছর দেশে রক্তের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। চাহিদার সাথে রক্তদাতার সংখ্যা বাড়ছে না। সরকারের নিরাপদ রক্তপরিসঞ্চালন কর্মসূচি, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, বাঁধন, সন্ধানী ও রেড ক্রিসেন্টসহ অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান শহরমুখী। কিন্তু উপজেলাপর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার পরিধি বৃদ্ধির কারণে সেখানেও রক্তের চাহিদা তৈরি হচ্ছে। 

এক জরিপে দেখা গেছে, চিকিৎসায় রোগীর সুস্থতার জন্য স্বেচ্ছায় আরও রক্তদাতা প্রয়োজন। চাহিদার অনুপাতে রক্তের সরবরাহ নিশ্চিতে একটি কেন্দ্রীয় ব্লাড ম্যানেজমেন্ট সেন্টার প্রয়োজন। যারা সারা দেশে স্বেচ্ছায় রক্তদাতা তৈরি করে। রক্তের সরবরাহ ও বিভিন্ন উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করবে। এছাড়া স্বেচ্ছায় রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব নয়। সেই সাথে দেশ থেকে অন্ধত্ব দূর করতে মরণোত্তর চক্ষুদান বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তোলা দরকার।

বিএসএমএমইউর অধ্যাপক ডা. আসাদুল ইসলাম বলেন,  থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ও ভিয়েতনামে কেন্দ্রীয় ব্লাড ম্যানেজমেন্ট সেন্টার রয়েছে। আমাদের দেশেও এমন একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবনা রয়েছে। কিন্তু এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। সরকারি উদ্যোগে কেন্দ্রীয় ব্লাড ম্যানেজমেন্ট সেন্টার গড়ে তোলা সম্ভব হলে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের একটি ডাটা গড়ে তোলা সম্ভব হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রক্তের গ্রুপ নির্ণয় শেষে একটি তালিকা তৈরি করা সম্ভব হতো। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যদের এক্ষেত্রে কাজে লাগানো সম্ভব হতো। জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব হলে কোন জেলায় বছরে কত ব্যাগ রক্ত দরকার সেটার একটি তালিকা করে সেই অনুপাতে স্বেচ্ছায় রক্তদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি করা সম্ভব হতো।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, একজন সুস্থ ব্যক্তি বছরে তিনবার রক্ত দিতে পারেন। উন্নত বিশ্বে প্রতি হাজারে স্বেচ্ছায় রক্ত দেয় ৪৫০ জন বা শতকরা ৪৫ ভাগ মানুষ। আর বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রতি হাজারে মাত্র তিনজন রক্ত দেয়। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সেফ ব্লাড ট্রান্সফিউশন প্রোগ্রাম সূত্রে জানা গেছে, অসুস্থ ব্যক্তিদের চিকিৎসায় প্রতি বছর প্রায় সাড়ে ৯ লাখ থেকে ১০ লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন। সারা দেশে সরকারিভাবে ২২৩টি ব্লাডব্যাংক বা রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র রয়েছে।

এর মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কর্মসূচির মাধ্যমে বিভাগ ও জেলাপর্যায়ে ৯৯টি, ইউএইচসি তথা উপজেলা হেলথ কেয়ারের ১২৪টি সরকারি ব্লাডব্যাংক রয়েছে। গত তিন বছরে বিভাগ ও জেলা সরকারি হাসপাতালের রক্তপরিসঞ্চালন কেন্দ্রে (ব্লাড ব্যাংক) ২৩ লাখ ৭৫ হাজার ৬৩৭ জন স্বেচ্ছায় রক্তদাতার রক্ত পরিসঞ্চালন করা হয়েছে। সরকারি হাসপাতালের বাইরে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, কোয়ান্টাম, সন্ধানী, বাঁধন, থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন ও থ্যালাসেমিয়া সমিতিসহ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অনুমোদিত ১৬২টি বৈধ বেসরকারি ব্লাডব্যাংক রয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত বছর সাত লাখ ৭১ হাজার ৭০৮ ব্যাগ রক্তপরিসঞ্চলন করা হয়েছে। তার মধ্যে সরকারি ব্লাডব্যাংকে রক্তদাতাদের মধ্যে ২৭ দশমিক ১৯ শতাংশ স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন। বাকি ৭২ দশমিক ৮১ শতাংশ রক্তদাতা রোগীর স্বজন। অধ্যাপক. ডা. আসাদুল ইসলাম জানান, চিকিৎসা ব্যবস্থা আধুনিক হচ্ছে। রোগ নির্ণয়ের হার বেড়েছে। হাসপাতালও বেড়েছে। এতে প্রচুর রক্তের চাহিদা তৈরি হয়েছে। প্রতি বছর দেশে ৯ থেকে ১০ লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন। কিন্তু সেই হিসাবে স্বেচ্ছায় রক্তদাতার সংখ্যা বাড়ছে না। এখন মাত্র ৩২ থেকে ৩৪ শতাংশ স্বেচ্ছায় রক্তদাতা থেকে পূরণ হয়। বাকি ৬৪ থেকে ৬৬ শতাংশ রক্ত পরিবারের সদস্য ও অন্যান্য মাধ্যমে জোগাড় হয়। এটা হওয়ার কথা নয়। অথচ থাইল্যান্ডে শতভাগ রক্ত স্বেচ্ছাসেবী থেকে আসে।

স্বেচ্ছায় রক্তদাতা বাড়লেও বাড়েনি মরণোত্তর চক্ষুদান : অন্ধত্ব বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা। কর্নিয়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও সরবরাহকারী দেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতির তথ্য বলছে, দেশে প্রায় ১৪ লাখ মানুষ অন্ধ। এর মধ্যে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ কর্নিয়াজনিত অন্ধ। প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার মানুষ কর্নিয়াজনিত অন্ধত্ব বরণ করছেন। গত বছরের তথ্য বলছে, সংগঠনটি ১৯৮৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত চার হাজার ১০৪টি কর্নিয়া সংগ্রহ করেছে। এসব কর্নিয়া তিন হাজার ৪৫৯ জন মানুষের চোখের আলো ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। এই গতি অত্যন্ত ধীর। এভাবে চললে দেশের কর্নিয়াজনিত অন্ধত্ব মোকাবিলায় অন্তত ছয় হাজার বছর লেগে যাবে। মাত্র ২ শতাংশ মানুষ মরণোত্তর চক্ষুদান নিশ্চিত করলে অন্ধত্ব মোকাবিলা আরও সহজ হবে।

কর্মসূচি : ১৯৭২ সালে জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম দেশের প্রথম স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচিতে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে রক্তদান করেন। তারপর ১৯৭৮ সাল থেকে বাংলাদেশে স্বেচ্ছায় রক্তদান কার্যক্রমকে উৎসাহিত করতে প্রতিবছর ২ নভেম্বর জাতীয় স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান দিবস পালন করা হয়। দিবসটি ঘিরে এবারও বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হবে। আজ বুধবার দুপুরে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক উপস্থিত থেকে স্বেচ্ছায় রক্ত ও মরণোত্তর চক্ষুদানে উদ্বুদ্ধ করবেন।

Link copied!