Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪,

আধিপত্য ও নির্বাচনি উত্তাপ

নুর মোহাম্মদ মিঠু

ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২৩, ১২:১৪ এএম


আধিপত্য ও নির্বাচনি উত্তাপ
  • সপ্তাহের ব্যবধানে আওয়ামী লীগ নেতা খুন
  • উপজেলা চেয়ারম্যানকে গুলি করে হত্যাচেষ্টা 
  • ইউপি চেয়ারম্যানের অস্ত্রের অবৈধ প্রদর্শনী

 

  • রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টিতে অবৈধ অস্ত্র ব্যবহারের শঙ্কা, অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযানে গুরুত্বারোপ
  • সন্ত্রাসী, জঙ্গি, ডাকাত, কিশোর অপরাধী ও ছিনতাইকারী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতাদের হাতেও অবৈধ অস্ত্র

      

প্রত্যেকটি ক্রাইম কনফারেন্সে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের তাগিদ দেয়া হয়, বিশেষ অভিযানও পরিচালিত হচ্ছে

            —হায়দার আলী খান, ডিআইজি, পুলিশ সদর দপ্তর

দেশে অবৈধ অস্ত্রের সংখ্যা নিয়ে কোনো গবেষণা নেই, তবে উদ্ধার অভিযান থেকে ধারণা করা যায় এখানে অবৈধ অস্ত্র আছে

            —মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ, নিরাপত্তা বিশ্লেষক

 

দেশে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার নতুন নয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে উদ্বেগজনকহারে বেড়ে গেছে এসব অস্ত্রের ঝনঝনানি। সাথে বেড়েছে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারও। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অবৈধ এসব অস্ত্রের সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও মেয়াদোত্তীর্ণ বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা এখন প্রায় দেড় লাখ। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক মেয়াদোত্তীর্ণ এসব অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন স্থানে গুলি চালানোর ঘটনাও ঘটছে। দেশের একাধিক স্থানে ঘটছে সরাসরি হত্যা, হত্যাচেষ্টা কিংবা অস্ত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে ভীতি সৃষ্টির ঘটনা। অবৈধ অস্ত্রের গুলি ছোড়াছুড়িও হচ্ছে প্রকাশ্যেই। এতে খুনোখুনিসহ বাড়ছে অপরাধ। এসব অস্ত্রের উৎস নিয়ে বিস্মিত অনেকেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজধানীসহ সারা দেশে রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়ছে। নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে আর বাকি মাত্র মাস কয়েক মাস। এই সময়ের মধ্যেই নিজেদের শক্তি-সামর্থ্যের জানান দিতেও অস্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের একটি অংশের মধ্যে এখন বৈধ-অবৈধ অস্ত্র ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্র বলছে, সন্ত্রাসী, জঙ্গি, ডাকাত, কিশোর অপরাধী ও ছিনতাইকারী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতাদের হাতেও ছড়িয়ে যাচ্ছে অবৈধ অস্ত্র। রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টিতে কিংবা অপ্রীতিকর ঘটনায় এসব অবৈধ অস্ত্র ব্যবহারের আশঙ্কা করছেন গোয়েন্দারাও। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে আসায় শিগগিরই অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযানও চলবে বলে জানা গেছে। চোরাকারবারি বা সন্দেহভাজনদের ঘিরেই অভিযান চালানো হবে। সাধারণ মানুষকে ভীতসন্ত্রস্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত না করতে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। এ সংক্রান্ত নির্দেশনা মাঠ পর্যায়ে গত সপ্তাহে দেয়া হয়েছে বলেও জানায় সূত্রটি।

গত শনিবার হাট ইজারাকে কেন্দ্র নরসিংদীর শিবপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সাবেক উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুনুর রশীদকে গুলি করে হত্যাচেষ্টা করে দুর্বৃত্তরা। কাকডাকা ভোরে হারুনুর রশীদের বাসার ড্রয়িং রুমে ঢুকে তাকে হত্যার উদ্দেশে গুলি করা হয়। জানা গেছে, চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি তিন কোটি ২৫ লাখ এক হাজার টাকায় পুটিয়ার হাটের ইজারা পান খোরশেদ হাজী। তবে গত বছর এই হাটের ইজারা যৌথভাবে পেয়েছিলেন খোরশেদ হাজী ও আরিফ সরকার। এবার ইজারা না পেয়ে হারুনুর রশীদের ওপর ক্ষুব্ধ হন আরিফ সরকার। ছক করেই হারুনকে হত্যা করতে শনিবার ভোরে ঘনিষ্ঠ সহযোগী মহসিন মিয়াসহ তিনজনকে নিয়ে মোটরসাইকেলে আওয়ামী লীগ নেতার বাসায় যান আরিফ। 

এরপর বাসায় ঢুকে গুলি করে সেখান থেকে পালান তারা। আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান এই নেতা বর্তমানে সংকটাপন্ন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে রয়েছেন। এ ঘটনায় ফরিদ, সাব্বির, সুমিত মোল্লা ও রানা নামে চারজনকে আটক করেছে শিবপুর থানা পুলিশ। আটক চারজন এ ঘটনার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত কি-না এমন প্রশ্নে শিবপুর থানার ওসি ফিরোজ তালুকদার আমার সংবাদকে বলেন, ‘এ ঘটনার সাথে আটক চারজনের কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ততা রয়েছে। তবে পুলিশ এখন পর্যন্ত ঘটনার সাথে সরাসরি জড়িতদের আটক করতে পারেনি। চেয়ারম্যানকে হত্যাচেষ্টায় ব্যবহূত অস্ত্রও উদ্ধার করতে পারেনি।’ তবে ওসি বলছেন, চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ওসি আরও বলেন, ‘এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়নি। 

আমরা আহত উপজেলা চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলেছি, তিনি সুস্থ হয়ে অভিযোগ দায়ের করবেন। ভাগ্যক্রমে চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ প্রাণে বাঁচলেও বাঁচতে পারেননি সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার দেশীগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল কুদ্দুস সরকার। এর আগের শনিবারে তাকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। কুদ্দুস সরকার দেশীগ্রাম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও ভোগলমান চারমাথা গ্রামের বাসিন্দা। তার ছেলে রুহুল আমীন বলেন, ‘দুর্বৃত্তরা উপর্যুপরি গুলি চালিয়ে আমার বাবাকে হত্যা করেছে।’ প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সন্ধ্যার দিকে ২০-২৫ জন অস্ত্রধারী ভোগলমান চারমাথা বাজারে আসে। 

তারা হ্যান্ডমাইকে বাজারের লোকজনকে বাজার ত্যাগ করার নির্দেশ দেয় এবং কয়েকটি ফাঁকা গুলি ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এরপর সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল কুদ্দুস সরকারের ছেলের কীটনাশকের দোকানে ঢুকে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার (কুদ্দুস) ওপর কয়েকটি গুলি চালিয়ে এলাকা ত্যাগ করে। এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার, অস্ত্র উদ্ধারসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করলে তাড়াশ থানার ওসি শহিদুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, ‘এখনো তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ হলে বলতে পারব। তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’ তবে অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়টিও তিনি তদন্ত শেষে বলতে পারবেন বলে জানান। এদিকে সরাসরি গুলির ঘটনার পাশপাশি বৈধ অস্ত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে এলাকায় ভীতি সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন কুমিল্লার এক ইউপি চেয়ারম্যান। 

জানা গেছে, বড়ুরা উপজেলার ভবানীপুর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান শুভেচ্ছা বিনিময়কালে কোমরে পিস্তল ঝুলিয়ে রাখেন। কোমরে থাকা সেই পিস্তলের ছবিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। তার এই অস্ত্রের লাইসেন্স থাকলেও এর অবৈধ ব্যবহার করেছেন তিনি। তার এই অস্ত্র প্রদর্শনের বিষয়ে জনমনে নেতিবাচক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও ব্যবহার নীতিমালা-২০১৬-এর ২৫ নম্বরের ‘ক’ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে— ‘কোনো ব্যক্তি স্বীয় লাইসেন্স এন্ট্রিকৃত অস্ত্র আত্মরক্ষা নিজে বহন/ব্যবহার করতে পারবেন। তবে অন্যের ভীতি/বিরক্তি উদ্রেক করতে পারে এরূপ প্রদর্শন করতে পারবেন না।’ কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম জানান, তিনি কিভাবে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছেন সেটি তদন্ত করে দেখা হবে। তা ছাড়া একজন বৈধ অস্ত্র ব্যবহারকারী জনসম্মুখে এভাবে অস্ত্র প্রদর্শন করতে পারেন না। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।’

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, যারা অস্ত্রের নিবন্ধন নিয়ে থাকেন তারা অনেকেই সঠিক নিয়ম মানেন না। অনেক ক্ষেত্রেই অনৈতিক কাজে ব্যবহার করছেন লাইসেন্সধারীরা। পুলিশ সদর দপ্তরে এ সংক্রান্ত যেসব অভিযোগ জমা পড়েছে সেগুলো খতিয়ে দেখছে পুলিশ। কারণ এসব অবৈধ অস্ত্র দিয়ে চাঁদাবাজি, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ভয়ভীতি দেখানো, জমিজমার বিরোধ, আধিপত্য বিস্তার ও পূর্ব-শত্রুতার জেরে ব্যবহার করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, সারা দেশে প্রায় এক লাখ ৯০ হাজার ৩১২টি অস্ত্রের নিবন্ধন দেয়া আছে। তবে মাত্র ৪৩ হাজার ৩১২টি অস্ত্রের হালনাগাদ তথ্য পুলিশ সদর দপ্তর, পুলিশের বিশেষ শাখা-এসবি ও সিআইডির কাছে রয়েছে। বাকিগুলোর কোনো হালনাগাদ তথ্য নেই। সেগুলো কী নিবন্ধনকৃত ব্যক্তির হাতে রয়েছে না অবৈধভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে— তা নিয়ে সংশয়ের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দীর্ঘদিন সেই অস্ত্রগুলোর হালনাগাদ তথ্য না থাকায় হাতবদল হতে পারে। কেউবা আবার কাউকে ভাড়া হিসেবে ব্যবহার করতে দিতে পারেন। সেগুলোকে দ্রুত হালনাগাদের আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ।

জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (প্রশাসন) হায়দার আলী খান আমার সংবাদকে বলেন, ‘প্রত্যেকটি ক্রাইম কনফারেন্সে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের তাগিদ দেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় রয়েছে— একটি অবৈধ অস্ত্র অপরটি বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার। দুটি বিষয়েই আমরা সবসময় তৎপর, অভিযান পরিচালনা করছি। এ ছাড়া এটি পুলিশের রুটিনওয়ার্কের মধ্যেই পড়ে। বিশেষ বিশেষ সময়েও বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। সর্বশেষ মাতৃভাষা দিবসেও অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। আসন্ন স্বাধীনতা দিবসেও এ অভিযান পরিচালনা করা হবে। এ ছাড়া নির্দেশনা অনুযায়ী মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন।’ 

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ বলেন, ‘অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি নিয়মিত কাজ। বাংলাদেশে অবৈধ অস্ত্রের সংখ্যা কেমন তা নিয়ে কোনো গবেষণা নেই। তবে উদ্ধার অভিযান থেকে ধারণা করা যায়, এখানে অবৈধ অস্ত্র আছে। অবৈধ অস্ত্রবিরোধী বিশেষ অভিযান বিশেষ বিশেষ সময়ই চালানো হয়। অন্য সময় ব্লক রেইড বা বিকল্প অভিযান চালিয়ে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। মিয়ানমার সীমান্তে কিছু অবৈধ ভারী আগ্নেয়াস্ত্রের তথ্য জানা যায়। কিন্তু সার্বিকভাবে দেশে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো পর্যায়ে গেছে বলে মনে হয় না।’ 

Link copied!