Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

চাঁদায় কোটিপতি দালালচক্র

নুর মোহাম্মদ মিঠু

মার্চ ৬, ২০২৩, ১১:৫৮ পিএম


চাঁদায় কোটিপতি দালালচক্র
  • ঢাকার সড়কে অবৈধ সিএনজি চালিত অটোরিকশার দাপট 
  • ২০ হাজার অবৈধ সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মহানগরীতে চলছে রঙ পরিবর্তন করে, নেয়া হচ্ছে না ব্যবস্থা 
  • সড়কে বিশৃঙ্খলা, চুরি-ছিনতাইসহ ঘটছে বহুমুখী অপরাধ
  • রিকশাপ্রতি মাসিক ছয় হাজার টাকা চাঁদা নিচ্ছে দালালচক্র
  • স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ডিএমপি কমিশনারের দপ্তরে অভিযোগ

অবৈধ গাড়ির বিরুদ্ধে প্রতিটি গ্যারেজে অভিযান চালাতে হবে, অন্যথায় সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব নয়

   —হানিফ খোকন, সভাপতি, সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগ 

মিটার নেই, নেই রুট পারমিট, এমনকি বাণিজ্যিকভাবে চলাচলের অনুমতিও নেই— এমন ২০ হাজার অবৈধ সিএনজি চালিত অটোরিকশা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ঢাকার সড়ক। ঢাকা মহানগরীর বৈধ সিএনজিচালিত অটোরিকশাগুলো মিটারে না চললে শাস্তির মুখোমুখি হলেও অবৈধ এসব অটোরিকশার মালিকরা বিভিন্ন মহলকে ম্যানেজ করে চলছে বহাল তবিয়তে। দীর্ঘদিন ধরেই এর নেপথ্যে রয়েছে শক্তিশালী একটি দালালচক্র। যে চক্রের মাধ্যমে অবৈধ সেসব সিএনজি অটোরিকশায় নগরীতে বাড়ছে বিশৃঙ্খলা, যানজট, চুরি, ছিনতাই ও রাহাজানি। জানা গেছে, মেট্রোর কালার পরিবর্তন করেই ঢাকা মহানগরীতে চলছে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী ও মুন্সিগঞ্জ জেলার ২০ হাজার অবৈধ সিএনজি অটোরিকশা। 

এদের দাপটে অনেকটাই কোণঠাঁসা ঢাকায় বাণিজ্যিকভাবে চলাচলের জন্য অনুমোদিত ১৫ হাজার সিএনজি অটোরিকশার মালিক-চালকরা। যদিও রহস্যজনক কারণে সেই দালাল চক্রের বিরুদ্ধেও নেয়া হচ্ছে না কোনো ব্যবস্থা। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন বৈধ চালক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। গত দুদিন ধরে এ বিষয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের কোনো বক্তব্যই পাওয়া যায়নি। অন্য কর্মকর্তাদেরও ফোন করা হলে তারা বলছেন, বিআরটিএর চেয়ারম্যান গণমাধ্যমে কথা বলবেন। অন্য কারও কথা বলার সুযোগ নেই।

সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের দপ্তরে পৃথক দুটি অভিযোগ করে নিবন্ধিত শ্রমিক সংগঠন ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন। অভিযোগ সূত্র আর অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের বেশ কটি জেলার সিএনজি অটোরিকশা ঢাকা মহানগরীতে চলাচলের জন্য অনুমোদিত নয়। অননুমোদিত হলেও এমন ২০ হাজার সিএনজি অটোরিকশা ঢাকায় চলাচল করছে শুধু দালালচক্রের নেতৃত্বে। যে চক্রের নেতৃত্ব দিচ্ছেন যাত্রাবাড়ী এলাকার বিদ্যুৎ গলির তাছলি। চক্রের সক্রিয় সদস্য রয়েছেন বাড্ডার ৩৯৫ স্বাধীনতা স্বরনীর জাহাঙ্গীর আলম, জয়নাল আবেদীন বাবু ও বাড্ডার বাগানবাড়ি এলাকার তোফাজ্জাল। 

এ ছাড়াও ওই চক্রে রয়েছেন আনোয়ার ভাণ্ডারী, আকাশ, শাহিন, বাড্ডার স্বপন চৌধুরী, রনি, রুবেল, বাড্ডার গোলাম মোয়াজ্জেম ও একই এলাকার বিল্লাল হোসেন। চক্রটির যোগসাজশেই ঢাকার বাইরের সিএনজি অটোরিকশায় ঢাকা মেট্রোর রং করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মহানগরীর সড়ক। জানা গেছে, অবৈধভাবে চলাচল করা ২০ হাজার সিএনজি অটোরিকশার কারণে ঢাকা মহানগরীতে প্রাণহানিসহ অসংখ্য ঘটনাও ঘটেছে। তবুও ঢাকার সড়ক থেকে অবৈধ সেসব সিএনজি অটোরিকশা উৎখাতে নেই কোনো উদ্যোগ।

জানা গেছে, অবৈধ এসব সিএনজি অটোরিকশা থেকে মাসিক পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা করে চাঁদাও আদায় করছে দালালচক্রটি। বিনিময়ে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার মামলা, জরিমানার বিষয়গুলো সমাধানের দায়িত্ব নিয়েছে তারা। সূত্র বলছে, চক্রটির আঁতাত রয়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার সাথেও। এসব গাড়ি আটক করা মাত্রই তদবির বাণিজ্য শুরু হয়ে যায় তাদের। কখনো কখনো নিজেদের পেশাদার চালক হিসেবেও পরিচয় দেয়। বিভিন্ন  কৌশলে আইনি জটিলতা মোকাবিলার পরও ওই চক্রের সদস্যরা সিএনজি চুরির নাটক সাজিয়ে সহজ সরল চালকদের কাছ থেকেও হাতিয়ে নিচ্ছে অর্থ। 

সূত্র বলছে, ওই চক্রের সদস্যদের গোপন আঁতাত রয়েছে সিএনজি অটোরিকশা চোর সিন্ডিকেটের সঙ্গেও। কোন এলাকা থেকে কারা সিএনজি চুরি করে সেই তথ্যও তাদের কাছে থাকে। গত ৫ জানুয়ারি এমনই একটি ঘটনা ঘটে। সেদিন ঢাকায় (ঢাকা মেট্রো থ ১৩-৭৫৯২) নম্বরের একটি সিএনজি চুরির ঘটনা ঘটে। কিন্তু সিএনজির চালক হান্নান গ্যারেজ পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই দালাল চক্রের সদস্য এবং ওই সিএনজির মালিক জাহাঙ্গীর চোরের সাথে যোগাযোগ করে সিএনজি ফেরত নিয়ে আসে। যদিও চালক হান্নানের কাছ থেকে এই ঘটনায় জরিমানা হিসেবে ১১ হাজার টাকা আদায় করে জাহাঙ্গীর। শুধু তাই নয়, এ চক্রের সদস্যরা সরাসরি সিএনজি চুরির সঙ্গেও জড়িত। ঢাকায় দাপিয়ে বেড়ানো ওই দালাল চক্রের একজন তফাজ্জল। যার নামে টাঙ্গাইলসহ দেশের একাধিক থানায় সিএনজি চুরির মামলা রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ চক্রের বিরুদ্ধে এখনই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ঢাকায় চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা বন্ধ হবে না।

সূত্র জানায়, মিটারে চালিত সিএনজি অটোরিকশা চালকদের কাছ থেকে মাসিক এক হাজার টাকা করেও চাঁদা আদায় করছে চক্রটি। চালকদের বলা হচ্ছে, ঢাকায় মিটার ছাড়া গাড়ি চালানো, নো-পার্কিংসহ অন্য কোনো মামলার সম্মুখীন হতে হবে না তাদের। এক হাজার টাকা মাসোহারায় এসব ঝক্কিঝামেলা মেটানোর দায়িত্বও নিয়েছে তারা। এ ছাড়াও নগরীতে সিএনজির দরজা লাগানোর বিধান না থাকলেও ওই দালালচক্রের দাপটেই দরজা লাগিয়ে ভাড়ায় চলাচল করছে অবৈধ সেসব সিএনজি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০ হাজার অবৈধ সিএনজিকে কেন্দ্র করে দালালচক্রের অনেকেই ইতোমধ্যে কোটিপতি বনে গেছেন। গড়ে তুলেছেন বাড়ি-গাড়ি। এই চক্রের অন্যতম সদস্য জাহাঙ্গীর, যার ২৫টি সিএনজি অটোরিকশা রয়েছে বলে জানা গেছে। এসবের বর্তমান বাজারমূল্য আনুমানিক ৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া নামে বেনামে জমি কিনেছেন দালালদের অনেকেই।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সভাপতি মোহাম্মদ হানিফ খোকন আমার সংবাদকে বলেন, সিএনজি অটোরিকশা সেক্টরে যদি শৃঙ্খলা ফেরাতে হয় তাহলে দালালচক্রের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। বিগত ২০০২ সালে ঢাকার সড়ক থেকে ৩৭ হাজার বেবিট্যাক্সি উচ্ছেদ করা হয়। এর স্থলে নিবন্ধন দেয়া হয় ভাড়ায় চালিত ১৫ হাজার সিএনজি অটোরিকশা। অথচ এতদিনে ঢাকার পরিধি বেড়েছে চারগুণ, জনসংখ্যাও বেড়েছে কয়েকগুণ। এ বিবেচনায় ২০০৭ সালে সরকার ঢাকায় চলাচলের জন্য বৈধ পাঁচ হাজার থ্রি-হুইলারের রেজিস্ট্রেশন ও বিলিবণ্টনের সিদ্ধান্ত চালকদের মধ্যে বিতরণের জন্য বরাদ্দ দেয়। 

তিন হাজার ১৯৬ জন চালক সে সময় আবেদন করেন। এ সংক্রান্তে একটি মামলাও করে ঢাকা অটোরিকশা মালিক সমিতি। মালিক সমিতির সেই মামলা খারিজ হলে পরে আপিলও করা হয়, সেখান থেকেও খারিজ হয়ে যায় মামলা। রিভিউও খারিজ হয়। সেসব থ্রি-হুইলার বরাদ্দের কার্যক্রম আজও আলোর মুখ দেখেনি।’ হানিফ খোকন আরও বলেন, ‘ঢাকায় চলাচলরত অবৈধ এসব গাড়ি উচ্ছেদ করলে বৈধ গাড়িগুলোও মিটারে চালাতে আর কোনো সমস্যা থাকবে না। যদিও ইতোমধ্যে গ্যাস, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির উচ্চমূল্যের প্রভাবে বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়। এ ক্ষেত্রে মিটারের ভাড়াও না বাড়ায় দিন শেষে খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে চালকদের। 

কারণ ভাড়ায় চালিত গাড়ির মালিকরা দুই শিফটে দৈনিক জমা নিচ্ছে এক হাজার ৬০০ টাকা। দিন শেষে চালকদের কিছুই থাকছে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘এসব অবৈধ গাড়ির বিরুদ্ধে গ্যারেজে গ্যারেজে অভিযান পরিচালনা করতে হবে। অন্যথায় এদের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় এবং ঢাকায়ও শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব নয়।’

Link copied!