Amar Sangbad
ঢাকা রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪,

বাস খাদে পড়ে ঝরল ২০ প্রাণ

মো. মাসুম বিল্লাহ

মার্চ ২০, ২০২৩, ১১:১১ এএম


বাস খাদে পড়ে ঝরল ২০ প্রাণ
  • ১৭ জনের পরিচয় শনাক্ত আহত ২৩
  • আফসানার শিক্ষাসনদ আনা হলো না
  • মায়ের বুকে অক্ষত অবস্থায় সন্তান
  • তদন্তে চার সদস্যের কমিটি গঠন

মাদারীপুরের শিবচরে এক্সপ্রেসওয়ের রেলিং ভেঙে ইমাদ পরিবহনের যাত্রীবাহী বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ২০ জন নিহত হয়েছেন। মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ২৩ জন। আহতরা শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এদিকে ২০ জনের মধ্যে ১৭ জনের পরিচয় জানা গেছে। গতকাল রোববার সকালে শিবচরের কুতুবপুরে যাত্রাবাড়ী-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে এ দুর্ঘটনা ঘটে।

স্থানীয় উদ্ধারকর্মীরা বলছেন, বাসটি ভরা যাত্রী ছিল। সড়ক থেকে বাসটি পড়ার সময় ডিগবাজি খায়। এ কারণে এত প্রাণহানি। মাদারীপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রত্যেক মৃত ব্যক্তির মরদেহ দাফনের জন্য ২৫ হাজার টাকা করে দেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা খরচের জন্য পাঁচ হাজার টাকা করে দেয়া হচ্ছে।

নিহতরা হলেন— ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার হিতোডাঙ্গা গ্রামের সৈয়দ মুরাদ আলীর ছেলে মো. ইসমাইল (৩৮), গোপালগঞ্জের গোপিনাথপুর গ্রামের হেদায়েত মিয়া বাহার (৪২), নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার কালনা গ্রামের বকু সিকদারের ছেলে ফরহাদ সিকদার (৩০), গোপালগঞ্জের পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক অনাদী রঞ্জন মণ্ডল (৪২), গোপালগঞ্জ সদরের বনগাঁও এলাকার সামছুল শেখের ছেলে মোস্তাক শেখ (৩০), গোপালগঞ্জ সদরের ছুটকা গ্রামের নশর আলী শেখের ছেলে সজিব শেখ (২৬), গোপালগঞ্জ সরদরের পাঁচুরিয়া গ্রামের মাসুদ মিয়ার মেয়ে সুইটি আক্তার (২২), গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার নিলফা গ্রামের কাঞ্চন শেখের ছেলে কবির শেখ, গোপালগঞ্জ সদরের আবু হেনা মোস্তফার মেয়ে আফসানা মিমি (২০), গোপালগঞ্জ মুকসুদপুরের আদমপুরের আমজাদ আলী খানের ছেলে মাসুদ খান (৩২), খুলনার সোনাডাঙার শেখ আহমেদ আলী খানের ছেলে শেখ আব্দুল্লাহ আল মামুন (৪২), খুলনার চিত্তরঞ্জন মণ্ডলের ছেলে চিন্ময় প্রসন্ন মণ্ডল, খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার পরিমল সাধুর ছেলে মহাদেব কুমার সাধু, খুলনার টুটপাড়ার শাজাহান মোল্লার ছেলে আশরাফুল আলম লিংকন, সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার সখীপুর গ্রামের আমজেদ আলী সরদারের ছেলে রাশেদ সরদার, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার অনন্তপুর গ্রামের আলী আকবরের ছেলে জাহিদ ও গোপালগঞ্জ সদরের পুরান মানিকদি গ্রামের ইমাদ বাসের সুপারভাইজার মিনহাজ বিশ্বাস (২২)।

পুলিশ জানায়, গতকাল সকালে খুলনা থেকে যাত্রী নিয়ে ইমাদ পরিবহনের একটি বাস ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে। পদ্মা সেতুর আগে ঢাকা-খুলনা এক্সপ্রেসওয়ের মাদারীপুরের শিবচরের কুতুবপুর এলাকায় বাসটির সামনের একটি চাকা ফেটে যায় এবং নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নিচে পড়ে দুমড়ে-মুচড়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই ১৪ জন নিহত হন। এ দুর্ঘটনায় অন্তত ২৯ জনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, পাঁচ্চর রয়েল হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুজন ও শিবচরের বিভিন্ন হাসপাতালে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

দুর্ঘটনার সময় ওই বাসে ছিলেন আনোয়ারা বেগম (২৫) ও তার শিশু সন্তান সাজ্জাদ। তাদের দুজনকেই অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করেছেন উদ্ধারকর্মীরা। মাদারীপুর রিজিওনের দায়িত্বপ্রাপ্ত হাইওয়ের ডিআইজি সালমা বেগম বলেন, এ দুর্ঘটনায় ২০ জন নিহত হয়েছেন। এতে ঘটনাস্থলেই ১৪ জন নিহত হন। এ দুর্ঘটনায় অন্তত ২৯ জনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, পাঁচ্চর রয়েল হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। জেলার ওসি আবু নাঈম মো. মোফাজ্জেল হক বলেন, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে কাজ চলছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, অতিরিক্ত গতির কারণে বাসটির চালক নিয়ন্ত্রণ হারালে সেটি খাদে পড়ে যায়।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ক্যাম্পের পরিদর্শক মো. বাচ্চু মিয়া বলেন, ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে ৯ জনকে আনা হয়েছিল। এর মধ্যে দুজন মারা গেছেন। বাকি সাতজন চিকিৎসাধীন। তিনি জানান, ঢামেকে চিকিৎসাধীন রয়েছেন— আব্দুল হামিম, শেখ ফয়সাল আহমেদ, বদরুদ্দোজা, পংকজ কান্তি ঘোষ, ঝুমা আক্তার, এনামুল ও বুলবুল আহমেদ। তবে নিহতদের নাম-পরিচয় জানা যায়নি। পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া বলেন, দুজনের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মর্গে রাখা হয়েছে। তাদের নাম-ঠিকানা এখনও জানা যায়নি। বিস্তারিত জানার চেষ্টা চলছে।

আফসানার সার্টিফিকেট আনা হলো না : বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে এমএস সার্টিফিকেট আনতে যাচ্ছিলেন আফসানা মিমি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্টিকালচার বিভাগ থেকে আফসানা এমএস ডিগ্রি লাভ করেন। ইচ্ছে ছিল চাকরি করে পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর। সেই স্বপ্ন কেড়ে নিল সড়ক দুর্ঘটনা। গতকাল সকালে মা কানিজ ফাতেমা ও ছোট বোন রুকাইয়া ইসলাম রূপা গোপালগঞ্জ শহরের বঙ্গবন্ধু কলেজের সামনে থেকে আফসানাকে ইমাদ পরিবহনের বাসে উঠিয়ে দেন। তার ঢাকা হয়ে ময়মনসিংহ যাওয়ার কথা ছিল। তবে মাদারীপুরের শিবচরে এক্সপ্রেসওয়ের রেলিং ভেঙে বাসটি খাদে পড়ে আফসানাসহ ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আফসানা গোপালগঞ্জ শহরের হীরাবাড়ী রোড এলাকার বাসিন্দা। তার বাড়িতে এখন শোকের মাতম। আফসানার মায়ের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে পরিবেশ। আফসানার বাবা আবু হেনা মোস্তফা কামাল সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। ছোটবেলায়ই আফসানার বাবা মারা যান। অনেক কষ্টে আফসানা ও তার বোন রুকাইয়ার লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছিলেন মা কানিজ ফাতেমা।

তদন্তে ৪ সদস্যের কমিটি : মাদারীপুরের শিবচরে এক্সপ্রেসওয়ের কুতুবপুর এলাকায় ইমাদ পরিবহেনর বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে ১৯ জনের প্রাণহানির ঘটনা তদন্তে চার সদস্যের কমিটি করেছে জেলা প্রশাসন।  মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক রহিমা খাতুন তদন্ত কমিটি গঠনের কথা নিশ্চিত করেছেন। জেলা প্রশাসক রহিমা খাতুন  বলেন, ‘অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিএম) পল্লব কুমার হাজরাকে প্রধান করে চার সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিতে জেলা পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন বিভাগের প্রতিনিধিরা থাকবে।’ আগামী দুই কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত কমিটিকে দুর্ঘটনার কারণ, কাদের গাফিলতি ছিল এসবসহ বিস্তারিত অনুসন্ধান করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।

মায়ের বুকে সন্তান অক্ষত : মাদারীপুরের শিবচরে পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনায় ইমাদ পরিবহনে থাকা সাত বছরের শিশু সাজ্জাদ ও আনোয়ারা (২৮) সম্পূর্ণ অক্ষত রয়েছেন। এই দুর্ঘটনায় তাদের অক্ষত থাকা সাধারণ মানুষের কাছে অনেকটাই কাল্পনিক মনে হচ্ছে। মরদেহের নিচ থেকে যখন আনোয়ারা ও তার সন্তানকে উদ্ধার করা হয় তখন তিনি তার ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলেন। তাদেরকে দেখার জন্য বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসছেন অনেক মানুষ। আনোয়ারা বাগেরহাটের মোল্লার হাট উপজেলার গারবা গ্রামের ব্যবসায়ী শাহিন মোল্লার স্ত্রী। আনোয়ারা বলেন, চালকের বাম পাশের আসনে বসেছিলাম, আমার ছেলে আমার কোলে ছিল।

বাসের বাম পাশের টায়ার পাংচার হয়ে যায়। এরপর গাড়িটি খাদে পড়ে যায়। আল্লাহ আমাদের দ্বিতীয় জীবন দিয়েছেন। আমার আর ছেলের গায়ে একটুও আঁচড় লাগেনি। তিনি বলেন, গাড়ি ছাড়ার শুরু থেকেই অনেক বেশি গতিতে চলছিল। আনোয়ারা ও তার ছেলে সাজ্জাদকে উদ্ধার করা মাহাবুব আলম জানান, আমরা বাস থেকে প্রথমে মরদেহ বের করছিলাম। এরপর দেখি মরদেহের নিচে পড়ে থাকা আনোয়ারা তার সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। এরপর মা ও সন্তানকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করি। আনোয়ারার স্বামী শহিদুল মোল্লা বলেন, বিধাতার কাছ থেকে আমার সন্তান ও স্ত্রীকে নতুন করে আবার ফিরে পেয়েছি। বিধাতা আমাকে এত বড় উপহার দিবে কখনো বুঝতে পারিনি। আমি বিধাতার কাছে চিরকৃতজ্ঞ।

মেয়ের মৃত্যু, বাঁচল বাবা : ঢাকা এক্সপ্রেসওয়ের রেলিং ভেঙে যাত্রীবাহী বাস খাদে পড়ে যাওয়ার ঘটনায় ২০ জন নিহতের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সুইটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) পড়ুয়া মেয়েকে ঢাকায় পৌঁছে দিতে যাচ্ছিলেন বাবা মাসুদ মিয়া। তিনি গোপালগঞ্জ শহরের পাচুরিয়া এলাকার বাসিন্দা। ভোরে গোপালগঞ্জ থেকে বাসে ওঠেন বাবা-মেয়ে। মাদারীপুরের শিবচরের কুতুবপুর এলাকায় পৌঁছালে পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়ে থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাসটি প্রায় পঞ্চাশ ফুট নিচে পড়ে যায়। এতে সুইটি ঘটনাস্থলেই মারা যান। আহত হন মাসুদ মিয়া। তাকে উদ্ধার করে শিবচরের পাঁচ্চর এলাকার ইসলামিয়া হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভর্তি করা হয়। চোখের সামনে মেয়েকে হারিয়ে নির্বাক তিনি। সুইটি ঢাবির ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি ঢাকার মিরপুরে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। মাসুদ মিয়া মেয়েকে সেখানে পৌঁছে দিতে যাচ্ছিলেন।

Link copied!