Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২০ মে, ২০২৪,

ডেঙ্গু চিকিৎসা

ব্যয় ছাড়াবে হাজার কোটি টাকা

মো. মাসুম বিল্লাহ

আগস্ট ১৮, ২০২৩, ১০:১৮ পিএম


ব্যয় ছাড়াবে হাজার কোটি টাকা
  • ডেঙ্গু চিকিৎসাসহায়ক সব পণ্যের দাম বেড়েছে দেড় থেকে দ্বিগুণ
  • নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর ডেঙ্গুর চিকিৎসা  ব্যয় বাড়তি চাপ
     

২০১৯ সালের গবেষণা বলছে ওই বছর ৪৫০ কোটি টাকা চিকিৎসা বাবদ খরচ হয়েছে। এ বছর আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যু আগের চেয়ে বেশি
— ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

চলতি বছর দেশে ডেঙ্গু রোগে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা বিগত বছরগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের সংখ্যা যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসাব্যয়। ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে ডেঙ্গু চিকিৎসা। জনস্বাস্থ্য অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বছর ডেঙ্গু চিকিৎসাব্যয় ছাড়িয়ে যাবে এক হাজার কোটি টাকা। ডেঙ্গু চিকিৎসায় সরকারি হাসপাতালগুলোতে স্যালাইন ও ওষুধ ফ্রি। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য গুনতে হয় টাকা। সব পরীক্ষা করানো যায় না সরকারি হাসপাতালে। বাইরে করাতে হয় কিছু পরীক্ষা। এতে গুনতে হয় বাড়তি খরচ। ডেঙ্গু রোগীর প্লাটিলেট ঠিক রাখতে প্রচুর তরল খাবার খাওয়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়। তার মধ্যে পেঁপে, ডাব, মাল্টা জাতীয় ফল অন্যতম। 

বলা হয় এসব ফল ডেঙ্গু রোগীর রক্তের প্লাটিলেট বাড়াতে ও ঠিক রাখতে সহায়তা করে। বাজার ঘুরে দেখা যায়, দেশে ডেঙ্গু প্রকোপ বাড়ার সাথে সাথে এসব ফলের দাম বেড়েছে দেড় থেকে দ্বিগুণ হারে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে বাসায় চিকিৎসা নিতে হলে তাকে স্যালাইন, ওষুধ কিনতে গুনতে হয় আরও বাড়তি টাকা। সরকারি হাসপাতাল থেকে প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে  দাঁড়ায় সরকারি হাসপাতালের চেয়ে ১০-১৫ গুণ বেশি।

ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে জানতে কয়েকজন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীও স্বজনদের সাথে কথা হয় আমার সংবাদের। রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন নাজমুন নাহার। তার বড় বোন সায়েরা খাতুম তিন ধরে আছেন তার সাথে। সায়েরা খাতুনের কাছে তাদের চিকিৎসা ব্যয় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি আমার সংবাদকে বলেন, ‘হাসপাতাল থেকে স্যালাইন ও ওষুধ দেয়া হচ্ছে। তা ছাড়া খাবার-দাবার সব কিনে আনছি বাইরে থেকে। সব কিছুর দাম বেশি। ডাক্তার বলেছে ডাবের পানি খাওয়াতে। হাসপাতালের বাইরে একটা ডাব ২০০-২২০ টাকার কমে পাওয়া যায় না। তা ছাড়া নিয়মিত আমাদের দুজনের খাবার ও অন্যান্য খরচ বাবদ দুই হাজার টাকা ব্যয় হচ্ছে। আমাদের বাবা একজন বাস ড্রাইভার। আমাদের এই ব্যয় বহন করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।’

ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে নিজের বাসায় থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন তৌহিদুল ইসলাম। তিনি এখন সুস্থ। তার সাথে আমার সংবাদের প্রতিনিধির কথা হয়।  তিনি  ঢাকায় একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন বলে জানান। তিনি বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর ডাক্তারের পরামর্শে বাসায় থেকে পাঁচ দিন চিকিৎসা নিয়েছেন। প্রতিদিন প্লাটিলেট পরীক্ষা করতে সিভিসি টেস্ট করাতে হয়েছে। একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সিভিসি ও ডেঙ্গু টেস্ট করাতে প্রতিদিন ৭০০ টাকা করে খরচ হয়েছে। তা ছাড়া ডাক্তারের পরামর্শের জন্য ভিজিট বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাবদ আমার খরচ হয়েছে ছয় হাজার টাকা। ওষুধ, স্যালাইন কিনতে খরচ হয়েছে দুই হাজার টাকার মতো। তরল জাতীয় খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন ডাক্তার। ডাব, পেপে, স্যুপ— এসব জাতীয় খাবার খেতে খরচ হয়েছে দুই হাজার টাকা। সব মিলিয়ে আমি পাঁচ দিন বাসায় থেকে চিকিৎসা নিয়েছি আমার খরচ হয়েছে প্রায় ১৪ হাজার টাকা। তিনি চিকিৎসার পুরো টাকাই ধার করে নিয়েছেন বলে জানান।

রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত স্ত্রী তানজিলা আলমের চিকিৎসা করাচ্ছেন বেসরকারি ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা রিফাত আলম। তিনি চিকিৎসাব্যয় সম্পর্কে বলেন, ‘আমার স্ত্রীকে নিয়ে গত চারদিন হাসপাতালে আছি এখানে প্রতিদিন ডাক্তার ভিজিট বেড ফি ওষুধ আমাদের দুই জনের খাবার বাবদ প্রায় ১৫ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। ডেঙ্গু টেস্ট রিপোর্ট বলছে তার প্লাটিলেট প্রতিদিন কমছে। ডাক্তার বলছে অবস্থা অবনতি হলে আইসিইউতে স্থনান্তর করতে হবে। এই ব্যয় বহন করতে হিমশিম খাচ্ছি।’ চলতি বছরের ডেঙ্গু চিকিৎসার ব্যয় নিয়ে আমার সংবাদের কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদের সাথে। 

তিনি বলেন, আমরা চলতি বছর এখনো মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ শুরু করেনি। আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। তবে ২০১৯ সালে আমাদের গবেষণা বলছে ওই বছর ৪৫০ কোটি টাকা ডেঙ্গু চিকিৎসা ব্যয়ে খরচ হয়েছে। চলতি বছর আনুমানিক হিসাব এক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। কারণ এ বছরে আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা সেই সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। তা ছাড়া চিকিৎসা সহায়ক সকল পণ্যের দাম বেড়েছে। ডেঙ্গু চিকিৎসার ব্যয়ের হিসাব নির্ণয় পদ্ধতি সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা সাধারণত ডেঙ্গু চিকিৎসার ব্যয়ে মেডিকেল ও নন মেডিকেল ব্যয় ভিন্নভাবে হিসাব করি।  মেডিকেল ব্যয়ে ধরা হয় রোগীর সাথে সরাসরি যুক্ত যেমন রোগী হাসপাতালে থাকা বেড ভাড়া, ডাক্তার, ওষুধ, খাবার প্রভৃতি খরচ। আর নন-মেডিকেল ব্যয় হিসাবে ধরা হয় রোগীর সাথে থাকা স্বজনদের দৈনন্দিন খরচ।

২০১৯ সালের তাদের গবেষণা বলছে, ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নেয়া ঢাকার রোগীদের গড় ব্যয় ছিল ১১ হাজার টাকা। আর ঢাকার বাইরে থেকে এসে যারা চিকিৎসা নিয়েছে তাদের গড় ব্যয় ছিল ২০ হাজার টাকা। এসব গবেষণা শুধু সেই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের ওপর চালানো হয়েছিল। এ ছাড়া ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বাসায় চিকিৎসা নেয়া রোগীদের বিষয়ে আমরা বিভিন্ন সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা থেকে তথ্য নিয়েছিলাম। ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া রোগীদের কাজের ভ্যালু হিসাব করা হয়। একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ কাজ করলে অবশ্যই সে কিছু না কিছু ভ্যালু উৎপাদন করত। কিন্তু সে মারা যাওয়ায় সে ভ্যালু উৎপাদন হচ্ছে না। এতে তার পরিবার ও রাষ্ট্রের লোকসান হচ্ছে। আমরা গবেষণায় সেই হিসাবটিও যুক্ত করেছিলাম।

বর্তমান পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, ডেঙ্গু ইতোমধ্যে সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে। এখন প্রয়োজন কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়া। সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ব্যক্তিপর্যায়ে উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা কিছু কিছু উদ্যোগ নিতে দেখেছি, কিন্তু এসব উদ্যোগ খুব বেশি কার্যকরী ফলাফল দিচ্ছে না। তাই সঠিক ব্যবস্থাপনায় ডেঙ্গু প্রতিরোধের বিষয়টি নিয়ে সামাজিকভাবে কাজ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ সেবাদানকারী সংস্থা চাইলেই সব জায়গায় পৌঁছাতে পারবে না। তাই প্রয়োজন নিজের সচেতন হওয়া। এডিস মশার লার্ভা জন্মাতে পারে এমন জায়গাগুলোকে সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। তাহলেই সম্ভব হবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ রাখা। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায় কেউ ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে চিকিৎসা ব্যয় তার পারিবারিক অর্থ কাঠামোতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। তাই সবার সচেতনতা জরুরি।

 

Link copied!