সাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া
সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২৩, ১২:৩৯ এএম
সাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া
সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২৩, ১২:৩৯ এএম
বাসায় থেকে চিকিৎসা নেয়া হিসাব করলে রোগী কয়েকগুণ বেশি হবে
—অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম
পরিচালক, রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
স্থানীয় পর্যায়ে জরিপ ও সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ আইন প্রয়োগে রোগীর প্রকৃত সংখ্যা জানা সম্ভব
—অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ জনস্বাস্থ্যবিদ
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো তথ্য বলছে চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যু সংখ্যা ইতোমধ্যে দেশের ডেঙ্গু রোগের ইতিহাসের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বছরের প্রথম দিকে ডেঙ্গু ঢাকায় ছড়িয়ে পড়লেও জুন থেকে জুলাই মাসে ডেঙ্গু সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। জুন মাসের রোগীর সংখ্যার চেয়ে জুলাই মাসে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় সাতগুণ বেশি। পরবর্তীতে আগস্ট মাস জুলাই মাসের আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়ে যায়। চলতি মাস সেপ্টেম্বর শঙ্কা উদ্বেগ নিয়ে শুরু হয়ে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা আগস্টের চেয়ে ঊর্ধ্বমুখী। সর্বশেষ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে দেশে চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন এক লাখ ৬১ হাজার ৯৬৪ জন। হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন এক লাখ ৫১ হাজার ২৮৩ জন। বর্তমানে চিকিৎসাধীন ৯ হাজার ৮৯১ জন। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৭৯০ জন।
তবে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর সঠিক তথ্য জানা যাচ্ছে না। কারণ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রতিদিন পাঠানো তথ্যে জানানো হয় ঢাকার সরকারি ও বেসরকারি ৭৬টি হাসপাতাল ও ঢাকার বাইরে সার দেশের বিভাগ, জেলা, উপজেলা পর্যায়ের সমন্বিত ৮১টি তথ্য জানানো হয়। তথ্যে দেখা যায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যু হওয়া রোগীদের সংখ্যা জানানো হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে জানানো হয় যতজন রোগী আক্রান্ত ততজন রোগী হাসপাতালে ভর্তি। ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে প্রতিদিন ডেঙ্গু পরীক্ষা করা রোগী ও চিকিৎসা নেয়া রোগীদের তথ্য বাদ পড়ছে। অনেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ডাক্তারের পরামর্শে বাসায় থেকে চিকিৎসা নেন। এমন বহু সংখ্যক রোগীদের তথ্য উঠে আসছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয়া রোগীর চেয়ে বাসায় থেকে ডাক্তারের পরামর্শে চিকিৎসা নেয়া রোগীর সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। সংক্রামক রোগে আক্রান্তের সঠিক তথ্য না জানা কঠিন। তবে বেশির ভাগ আক্রান্তের তথ্য সংগ্রহ না করা গেলে রোগটি নিয়ন্ত্রণ জটিল হয়ে পড়বে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাঠানো তথ্যে নেই এমন কয়েকটি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডেঙ্গু পরীক্ষা ও আক্রান্ত হয়ে বাসায় থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন এমন কয়েকজনের সাথে কথা বলেন আমার সংবাদের এ প্রতিবেদক। তাদের মধ্যে একজন রাফিন আহমেদ। তিনি পড়াশোনা করছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। থাকছেন পুরান ঢাকার একটি মেসে। কয়েক দিন জ্বরে ভোগার পর ডেঙ্গু পরীক্ষা করান পুরান ঢাকার একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। তার ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। তিনি ডাক্তারের পরামর্শে বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। তিনি যে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডেঙ্গু টেস্ট করিয়েছেন ডায়াগনস্টিক সেন্টারটি নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ডেঙ্গু সম্পর্কিত তথ্য পাঠানোর তালিকায়। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ডাক্তারের পরামর্শে চিকিৎসা নিয়েছেন যাত্রবাড়ী এলাকার মাহিমা আক্তার। আমার সংবাদের এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, প্রথমে জ্বরে ভুগছিলাম কিছু দিন। শরীর ব্যথা ও মাথা ঘুরতে শুরু করল। বাসার পাশে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডেঙ্গু টেস্ট করাই পজিটিভ আসলে ডাক্তারের পরামর্শে বাসায় থেকে চিকিৎসা নিয়েছি। আমি এখন সুস্থ।
ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গাজীপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ডাক্তারের পরামর্শে চিকিৎসা নিয়েছেন আশিক রহমান। হাসপাতালটিতে যোগাযোগ করা হলে কর্তৃপক্ষ বলে, হাসপাতালটিতে আক্রান্ত কোনো রোগী ভর্তি হলেই তা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টদের জানানো হয়। আক্রান্ত হয়ে অনেকে আমাদের এখানে ডাক্তার দেখিয়ে বাসায় থেকে চিকিৎসা করান। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে না থাকা ঢাকার এমন কয়েকটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ঘুরে দেখেন আমার সংবাদের এ প্রতিবেদক। এসব ডায়াগনস্টিক সেন্টারে প্রতিদিন গড়ে ৮০ থেকে ১০০ জন ডেঙ্গু টেস্ট করান। তাদের অনেকের ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। ডায়াগনস্টিক সেন্টার গুলো জানায় যাদের ডেঙ্গু পজেটিভ আসে তাদের অনেকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শে বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সঠিক সংখ্যা ও হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগী সম্পর্কে তথ্য দেয়ার বিষয়ে এ প্রতিবেদক কথা বলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলামের সাথে। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতিটি জেলা, উপজেলা হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ, স্পেশালাইজড হাসপাতাল থেকে প্রতিদিন তথ্য পাই। আমরা সব সরকারি হাসপাতালের পশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর তথ্যও পেয়ে থাকি। এখানে কিছু বেসরকারি হাসপাতালের তথ্য বাদ পড়ছে। যে সব হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের তথ্য বাদ পড়ছে এ সব প্রতিষ্ঠানের তথ্যও নিয়ে আসার জন্য কাজ করা হচ্ছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর বেশি জায়গা থেকে তথ্য আসছে। হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে বাসায় থেকে চিকিৎসা নেয়া রোগী হিসাব করলে রোগীর সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি হবে।’
ডেঙ্গুতে আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা জানতে করণীয় সম্পর্কে কথা বলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদের সাথে। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি কোনো সমস্যা সম্পর্কে সঠিকভাবে জানতে না পারি তাহলে আমরা সমস্যা সমাধান করতে পারব না। আমরা যদি প্রকৃত রোগীর সংখ্যা জানতাম তাহলে আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থাও আরও জরুরিভাবে কাজ করত। রোগী কোথায় বেশি বা কোথায় কম এ তথ্য গুলো সঠিকভাবে আসলে ভবিষ্যতেও রোগটির প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থার পরিকল্পনা করা যেত। স্থানীয় পর্যায়ে জরিপের মাধ্যমে রোগীর প্রকৃত সংখ্যা জানা সম্ভব। এ ছাড়াও দেশে সংক্রামক রোগ প্রতিরোধমূলক আইন আছে। আইনটিতে বলা আছে কেউ যদি সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয় তাহলে তাকে সরকারি স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তা সরকারকে জানাতে হবে। এ আইনটি প্রয়োগ করা যেতে পারে।’
কীটতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার। রোগীর সঠিক সংখ্যা জানার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা যদি ডেঙ্গু পরীক্ষার আগে কোনো নিবন্ধন পদ্ধতির ব্যবস্থা করতে পারি। এতে রোগীদের প্রাথমিক তথ্য থাকবে। তাহলে আমরা সহজে জানতে পারব আমাদের কতজন রোগী আক্রান্ত। এ পদ্ধতি ব্যবহার করলে আরেকটি বিষয়ে কাজ করা সহজ হবে। সেটি হলো আমরা সহজে জানতে পারব কোন এলাকা থেকে রোগী বেশি বা কম। এতে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া যাবে।’