সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৩, ০৮:০৪ পিএম
- নীতিনির্ধারণে নারীর অংশগ্রহণ কমেছে
- ছয় মাসে নারীকর্মী বেড়েছে ২ শতাংশ
ব্যাংকিং পেশায় নারীদের কর্মপরিবেশ দিন দিন উন্নত হচ্ছে। দেশে কার্যরত সব ব্যাংক যাতায়াতের জন্য নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে। রয়েছে ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটির ব্যবস্থা। এছাড়া শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র স্থাপন করেছে বেশিরভাগ ব্যাংক। ফলে বর্তমানে নারীরা ব্যাংকে ক্যারিয়ার গড়তে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও ভালো বেতন কাঠামোর ফলে এ খাতে নারীর অংশগ্রহণ দিন দিন বাড়ছে। বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে বসে নেতৃত্বও দিচ্ছেন তারা। আবার ব্যাংকের নীতিনির্ধারণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন অনেক নারী।
তবে গত ছয় মাসে এ খাতে নতুন কর্মী বৃদ্ধি পেলেও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ কিছুটা কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের জেন্ডার ইকোয়ালিটি বিষয়ক ষান্মাসিক প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুন শেষে দেশের ব্যাংক খাতে নারীকর্মীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ৫৬৭ জনে। ২০২২ সাল শেষে সংখ্যাটি ছিল ৩১ হাজার ৯৩৯ জনে। সে হিসাবে ছয় মাসের ব্যবধানে ব্যাংক খাতে নারীকর্মী বেড়েছে ৬২৮ জন বা ২ শতাংশ। বর্তমানে ব্যাংকে নারীকর্মীর হার ১৬ দশমিক ৩২ শতাংশ, যা ২০২২ সাল শেষে ছিল ১৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। অর্থাৎ গত ছয় মাসে পুরো ব্যাংক খাতে নারীকর্মীর হার সামান্য বেড়েছে (দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ)। ব্যাংকে নারীর প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা হিসেবেও নারীদের দেখা যাচ্ছে। যেমন বর্তমানে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন হুমায়রা আজম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত ২০২২ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের পরিসংখ্যান বলছে, ব্যাংকে যারা ক্যারিয়ার শুরু করছেন, তাদের মধ্যে ১৬ দশমিক ৯৯ শতাংশ নারী। ছয় মাস আগে যা ছিল ১৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ। ব্যবস্থাপনার মধ্যম স্তরে নারীদের অংশগ্রহণ ১৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ; ছয় মাস আগে ছিল ১৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ। আর ব্যাংকের উচ্চপর্যায়ে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের মধ্যে ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ নারী। ২০২২ সাল শেষে এ হার ছিল ৯ দশমিক ২২ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতিটি পর্যায়ে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। যদিও বৃদ্ধির হার সন্তোষজনক নয়।
তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২৩ সালের জুন শেষে দেশের ব্যাংক খাতে বোর্ড সদস্য বা পরিচালক হিসেবে নারীদের অংশগ্রহণ ১৪ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। ২০২২ সালের ডিসেম্বর নাগাদ ছিল ১৪ দশমিক ২২ শতাংশ। অর্থাৎ নীতিনির্ধারণে নারীদের অংশগ্রহণ গত ষান্মাষিকে কমেছে। সরকারি ব্যাংকগুলোয় নীতিনির্ধারণের জন্য পরিচালক নিয়োগ দেয় সরকার। নারী উদ্যোক্তা, সাবেক নারী ব্যাংকার, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের এই পদে নিয়োগ দেয়া হয়। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় মালিকদের স্ত্রী, কন্যা, পুত্রবধূ ও ঘনিষ্ঠজনদের পরিচালক হিসেবে দেখা যায়।
সরকার রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও পরিচালক নিয়োগ-সংক্রান্ত নতুন নীতিমালা করেছে। এতে বলা হয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের এক-তৃতীয়াংশই থাকবেন নারী। এ ছাড়া সরকারের শেয়ার রয়েছে, এমন বেসরকারি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও এ নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করেন, এটা শুধু দেশের ব্যাংক খাতের জন্য নয়, সার্বিকভাবে নারীর ক্ষমতায়নের জন্যও ইতিবাচক একটি সিদ্ধান্ত। তবে খেয়াল রাখতে হবে, শুধু কোটা পূরণের জন্যই যেন যে কাউকে বোর্ডে বসানো না হয়। সদিচ্ছা থাকলে নেতৃত্ব দেয়ার মতো দক্ষ নারী খুঁজে পাওয়া কঠিন নয় বলে মনে করেন তারা।
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ব্যাংকে নারীদের কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় অংশীদার হলো দেশের বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। এ খাতের ব্যাংক সংখ্যাও সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে সাড়ে ৩২ হাজার নারী ব্যাংক খাতে কর্মরত আছেন। এর মধ্যে প্রায় ২২ হাজার নারী কাজ করছেন দেশের বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয়। বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যা ৪৩টি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা সংকট ও পরবর্তী সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশের অর্থনীতি সামগ্রিকভাবে চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই সময়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি কমে এসেছে। সরকারি ব্যাংকের নিয়োগপ্রক্রিয়াও চলছে ধীরগতিতে। তা না হলে পরিস্থিতির আরও পরিবর্তন হতো।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, পড়ালেখা শেষ করে ব্যাংকগুলোয় প্রচুর নারীকর্মী যোগ দেন। কিন্তু পরে তাদের একটা অংশ চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। মূলত কাজের চাপ সামলাতে না পারা ও সন্তান লালন-পালনের জন্য ব্যাংকের চাকরি ছাড়েন তারা। সে জন্য উচ্চপর্যায়ে নারীদের অংশগ্রহণ যেভাবে এগোনোর কথা ছিল, ঠিক সেভাবে এগোচ্ছে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, নারীদের জন্য দেশের ৬১টি তফসিলি ব্যাংকে ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি কার্যকর হচ্ছে। এসব ব্যাংকে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে নীতিমালা আছে। ৩৬টি তফসিলি ব্যাংক তাদের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র স্থাপন করেছে। নারীকর্মী কম থাকায় পাঁচটি ব্যাংক শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র স্থাপন করছে না। বাকি ব্যাংকগুলোর এ সংক্রান্ত কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। নারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে দেশে কার্যরত সব ব্যাংকের নিজস্ব পরিবহন সুবিধা রয়েছে।
নারীদের অংশগ্রহণ ব্যাংকিংয়ের বৈচিত্র্য বাড়িয়েছে উল্লেখ করে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান জানান, ১০ থেকে ১৫ বছর আগে এই যাত্রা শুরু হয়। তখন এমন হয়েছে, অনেক নারীকে ডেকে এনে ব্যাংকে বসানো হয়েছে। শুরুতে এটা প্রয়োজন ছিল। না হলে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও যে সমানতালে ব্যাংকের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, এই পরিস্থিতি দেখা যেত না। সমান সুযোগ-সুবিধা ও প্রশিক্ষণ পাওয়ার ফলে সামনের দিনে নারীরা আরও ভালো করবেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক আমার সংবাদকে বলেন, ‘দেশে শিক্ষিত নারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। প্রতিযোগিতামূলক সব কাজে উল্লেখযোগ্য হারে নারীর অংশগ্রহণ ও সাফল্য লক্ষ করা যাচ্ছে। ব্যাংক খাতেও এর প্রতিফলন হয়েছে। তাই দিন দিন নারী ব্যাংকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
তিনি বলেন, আর্থিক খাতে নারীর যথাযথ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতে বাংলাদেশ ব্যাংক তৎপর রয়েছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারসহ আলাদা বিশ্রামাগার ও ইবাদতখানার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র স্থাপন, মাতৃত্বকালীন ছুটি কার্যকর এবং নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিতে বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়মিত তদারকি করছে।