অক্টোবর ১৫, ২০২৩, ১১:৫২ পিএম
- ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধে বেড়েছে দাম
- ১০ মাসে তেলের দাম সর্বোচ্চ
এবারের সংকট তেলের চাহিদা বৃদ্ধি বা উৎপাদন হ্র্রাসের কারণে নয়, বেড়েছে রাজনৈতিক কারণে : জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স
সংঘাত দীর্ঘকালীন হলে জ্বালানি খাতে বড় ধরনের সংকট তৈরি হবে
—নসরুল হামিদ, জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী
বৈশ্বিক বাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে গেলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবো
—অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
করোনা পরিস্থিতি ও রুশ-ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধের মধ্যেই এবার হামাস-ইসরাইল সংঘাতে জ্বালানি খাতে প্রভাব ফেলছে। একের পর ইস্যু সৃষ্টি হয়ে বিশ্ব বাজারে বাড়ছে তেল-গ্যাসের দাম। হামাস-ইসরাইল যুদ্ধের প্রভাবেও আরেক দফা বেড়েছে জ্বালানির দাম। ফলে অস্থিরতা বেড়েছে বৈশ্বিক জ্বালানি খাতে। এমন পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্যও বড় দুশ্চিন্তার কারণ।
এদিকে বিশ্বের বৃহৎ দুই জ্বালানি তেল উৎপাদনকারী দেশ সৌদি আরব ও রাশিয়া উৎপাদন কমানোর পর আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়তে শুরু করেছে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ১০ মাসের মধ্যে এখন সর্বোচ্চ।
গত মাসের ৯ সেপ্টেম্বরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতি ব্যারেল ব্রেন্ট ক্রুড বিক্রি হয়েছে ৯০ দশমিক ৬৫ ডলারে এবং প্রতি ব্যারেল ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (ডব্লিউটিআই) ক্রুড বিক্রি হয়েছে ৮৭ দশমিক ৫১ ডলারে। আগের দিন ৮ সেপ্টেম্বরের তুলনায় ৯ সেপ্টেম্বর ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি বেড়েছে দশমিক ৭৩ ডলার বা দশমিক ৮ শতাংশ এবং ডব্লিউটিআইয়ের দাম বেড়েছে দশমিক ৬৪ ডলার বা দশমিক ৭ শতাংশ। উভয় ব্র্যান্ডের তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় গতকাল অপরিশোধিত তেলের দাম ১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই দাম গত ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।
জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজার পর্যবেক্ষণকারী মার্কিন সংস্থা ওয়ান্ডার জানিয়েছে, এই সপ্তাহের মধ্যেই ব্রেন্ট ক্রুডের দাম (ব্যারেলপ্রতি) ৫ শতাংশ এবং ডব্লিউটিআই ক্রুডের দাম (ব্যারেলপ্রতি) ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে। সব মিলিয়ে সপ্তাহ শেষে অপরিশোধিত জ্বালানির দাম শতকরা ২ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যকার সশস্ত্র সংঘাতের কারণে বিশ্ববাজারে বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম। বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, এবার তেলের চাহিদা বৃদ্ধি বা উৎপাদন হ্রাসের কারণে নয়, বেড়েছে রাজনৈতিক কারণে। গত ৭ অক্টোবর ইসরাইলের সঙ্গে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র হামাস গোষ্ঠীর সংঘাত শুরু হওয়ার পর ৯ অক্টোবর সকালে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ে। চলতি বছরের জুনের পর তেলের দাম বাড়তে শুরু করেছিল। একপর্যায়ে তা ব্যারেলপ্রতি ৯৭ ডলার ৬৯ সেন্ট হয়। তবে এরপর তেলের দাম আবার কমতে শুরু করে এবং একপর্যায়ে ব্যারেল প্রতি ৮৪ ডলারে নেমে যায়। গত সপ্তাহেও তেলের দাম কমেছে। মূলত বিশ্বজুড়ে উচ্চ সুদহারের প্রভাব নিয়ে শঙ্কার কারণে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম গত সপ্তাহে ১১ শতাংশ ও ডব্লিউটিআই ক্রুডের দাম আট শতাংশ কমেছিল। সেটা ছিল গত মার্চের পর তেলের সর্বোচ্চ দরপতন। এএনজেড ব্যাংকের বিশ্লেষকরা এক নোটে লিখেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি বাড়লে তেলের দামও বাড়বে। তেলের দামে আরও উত্থান-পতন প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হামাস-ইসরাইলের সংঘাত দীর্ঘায়িত হলে অনেকটা মধ্যপ্রাচ্য নির্ভর আমদানির কারণে বড় সংকটে পড়তে পারে বাংলাদেশ। তবে কয়লাভিত্তিক জ্বালানি নিশ্চিত করা গেলে কিছুটা সমাধান মিলতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে দেশের জ্বালানি খাতের দগদগে ঘা পরিস্থিতি এখনো কাটেনি পুরোপুরি। দাম কিংবা সরবরাহ দুই ক্ষেত্রেই বিরূপ প্রভাব ফেলেছে বৈশ্বিক টালমাটাল অবস্থা। ইউক্রেন যুদ্ধের আগে দেশে গ্রাহক পর্যায়ে যে দামে মিলত জ্বালানি তেল, এখন সেখানে গুনতে হচ্ছে ৩৬ থেকে ৪৬ শতাংশ বাড়তি দাম। গ্যাসের ঘাটতিও ভুগিয়েছে সব খাত। এদিকে বাংলাদেশে প্রতিমাসে জ্বালানি তেল-গ্যাসের দাম সমন্বয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে সরকার এখন থেকেই এ নিয়ম কার্যকর করতে চাচ্ছে না। কারণ কয়েক মাস পরই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এখনই দাম বৃদ্ধি করলে নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে— এমনটিই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রীও নির্বাচনের পর জ্বালানি তেল, গ্যাসের দাম বাড়ার ঈঙ্গিত দেন।
এই অবস্থার মধ্যে নতুন করে উদ্বেগ জাগাচ্ছে হামাস-ইসরাইল সংঘাত। দেশে জ্বালানি আমদানির বড় অংশই মধ্যপ্রাচ্যনির্ভর। বাংলাদেশ মূলত সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকেই আমদানি করে থাকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল। এছাড়া পরিশোধিত জ্বালানি তেলেরও অন্যতম উৎস মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ। আর তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করা হয়ে থাকে কাতার ও ওমান থেকে।
জাতীয় নির্বাচনের পর প্রতিমাসে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হবে বলে জানিয়েছে জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের পর পরিশোধিত জ্বালানি তেলের আমদানি ব্যয়ের সঙ্গে স্থানীয়ভাবে শুল্ক-কর, পরিবহনসহ অন্যান্য চার্জ ও ফি যুক্ত করে প্রতিমাসে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হবে বলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে জানিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। সম্প্রতি আইএমএফের সঙ্গে এক বৈঠকে এ তথ্য জানিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। সম্প্রতি জ্বালানি খাতের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আইএমএফ মিশন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) ও পেট্রোবাংলার সঙ্গে বৈঠক করবে। বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে দেশে এর প্রভাব কতটুকু পড়বে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, আমদানি-নির্ভর জ্বালানির দেশ হওয়ায় আমরা ইতোমধ্যেই চাপের মধ্য দিয়েই যাচ্ছি। হামাস-ইসরাইল সংঘাতের ফলে বৈশ্বিক বাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে গেলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবো। এখন বড় একটা সংঘাত চলছে। এটা শিগগিরই সমাধান হয়ে গেলে কোনো ভয় নেই। কিন্তু এই সংঘাত বেড়ে গেলে জ্বালানি ক্ষেত্রে প্রভাব পড়বে। ড. ইজাজ হোসেন আরও বলেন, যেহেতু মধ্যপ্রাচ্যে এখন সমস্যা চলছে, আমরা যদি কয়লার সরবরাহ ঠিক রাখি তাহলে এই সংকট থেকে আমরা বাঁচতে পারি।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গণমাধ্যমকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা খুবই শঙ্কিত। আমাদের তেল এবং গ্যাস- দুটিই মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক। কিন্তু হামাস-ইসরাইল সংঘাত দীর্ঘকালীন হলে জ্বালানি খাতে বড় ধরনের সংকট তৈরি হবে। জ্বালানির মূল্য বেড়ে গেলে সব ক্ষেত্রেই দাম বাড়বে। সবাই এটার সুযোগ নিতে চাইবে।