Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ১০ মে, ২০২৫,

ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ প্রায় সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা

রেদওয়ানুল হক

রেদওয়ানুল হক

অক্টোবর ২৩, ২০২৩, ১২:০২ এএম


ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ প্রায় সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শর্ত পরিপালনে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের হিসাব প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে খেলাপি ঋণের পাশাপাশি অন্যান্য তথ্য যোগ হয়ে ব্যাংক খাতে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ার তথ্য সামনে এসেছে। গত জুন শেষে প্রায় সাড়ে চার লাখ কোটি টাকায় ঠেকেছে এ মানের ঋণ। পুনর্গঠনকৃত ঋণের হিসাব ছাড়াই বিপদগ্রস্ত ঋণ দাঁড়িয়েছে চার লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে রয়েছে, খেলাপি, পুনঃতফসিল ও অবলোপনকৃত ঋণ। প্রকৃত হিসাব পাওয়া গেলে এ অঙ্ক পাঁচ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছানোর আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে ব্যাংক খাতের মোট ঋণের তিন লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা বা ২৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ ছিল ঝুঁকিপূর্ণ সম্পত্তি। ছয় মাসের ব্যবধানে এ অঙ্ক ৫৬ হাজার কোটি টাকা বেড়ে  গেছে। গত জুন শেষে এটি দাঁড়িয়েছে চার লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকায়। এর মধ্যে রয়েছে— খেলাপি ঋণ এক লাখ ৫৬ হাজার কোটি এবং পুনঃতফসিল ও অবলোপনকৃত ঋণ দুই লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। তবে ঋণের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই কিছু ঋণ পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় মেয়াদ বাড়িয়ে নেয়া হয়েছে। এ তথ্য প্রকাশ করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। এ খাতের ঋণকেও বিপদগ্রস্ত ঋণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা। সাধারণত বড় অঙ্কের ঋণের ক্ষেত্রে এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। এ অঙ্ক যোগ হলে ব্যাংক খাতে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের পরিমাণ কমবেশি পাঁচ লাখ কোটি টাকা হবে বলে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র। তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২৩ সালের জুন শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৫৬ হাজার ৪০ কোটি টাকা। বছরের শুরুতে এ অঙ্ক ছিল এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ ছাড়া ঋণ পুনঃতফসিলের পরিমাণও বাড়ছে। ২০২২ সাল শেষে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের পরিমাণ ছিল দুই লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। 

গত বছরের শেষ প্রান্তিকে রেকর্ড ১৭ হাজার কোটি টাকা পুনঃতফসিল করা হয়। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে এ প্রবণতা কিছুটা কমে আসে। প্রথম তিন মাসে পুনঃতফসিল হয় তিন হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি ঋণ। তবে পরের তিন মাসে ফের পুনঃতফসিলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় ব্যাংকগুলো। কারণ এ প্রান্তিকে দেশের ইতিহাসে খেলাপি ঋণ রেকর্ড গড়ে দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রের তথ্যমতে, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি পরিমাণে ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে। অর্থাৎ বছরের প্রথম ছয় মাসে ১৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে। অন্যথায় খেলাপি ঋণের অঙ্ক দাঁড়াত এক লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। তবে এ তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক জানিয়েছেন, ‘ঋণ পুনঃতফসিল সংক্রান্ত তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে, শিগগিরই প্রকাশ করা হবে।’ 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, খেলাপি ঋণ কম দেখানোর জন্য পুনঃতফসিল একটি বড় অস্ত্র। ব্যাংকগুলো সহজেই এটি গ্রহণ করে। আর খেলাপি গ্রাহকও সুযোগ নিতে প্রস্তুত থাকে। এ প্রক্রিয়ায় একদিকে যেমন ঋণ নবায়নের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কম দেখানো হয়, একই সঙ্গে সুদ মওকুফ করেও পরিমাণ কমানো হয়। ২০২২ সালে ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ও তিনটি বিশেষায়িত ব্যাংক আট হাজার ৪০৪ কোটি টাকা সুদ মওকুফ করেছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে এ তথ্য জানিয়েছেন। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সুদ মওকুফের তথ্য যোগ হলে এ অঙ্ক প্রায় দ্বিগুণ হবে। অন্যদিকে অবলোপন (রাইট অফ) প্রক্রিয়ায় হিসাবের খাতা থেকে খেলাপি ঋণের তথ্য মুছে ফেলার পরিমাণও কম নয়। গত জুন শেষে মোট অবলোপকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬৮ হাজার কোটি টাকায়। এক বছরে অবলোপনকৃত ঋণ বেড়েছে সাত হাজার ৩১৯ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর পুঞ্জীভূত অবলোপন ঋণের পরিমাণ ছিল ৬৭ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। এক বছর আগে ২০২২ সালের জুন শেষে পুঞ্জীভূত অবলোপন ঋণের পরিমাণ ছিল ৬০ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। তবে এর মধ্যে ১৭ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকার অর্থ আদায়ের পর গত জুন শেষে অবলোপনকৃত ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৫০ হাজার ২৮৬ কোটি টাকায়। ২০২২ সালের জুন শেষে স্থিতি ছিল ৪৩ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা। গত এক বছরের এ খাতের ঋণ আদায়ের পরিমাণও ছিল হতাশাজনক। বছরজুড়ে অবলোপনকৃত ঋণের মাত্র ৩৯৩ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে ব্যাংকগুলো।

সমপ্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ নেয়ার শর্ত অনুযায়ী ব্যাংক খাতের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ তুলে ধরার জন্য বলা হয়। খেলাপি ঋণের পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের মধ্যে রয়েছে পুনঃতফসিল করা ঋণ, অবলোপন করা ঋণের পুনর্গঠিত অংশ ও আদালতের আদেশে শ্রেণিকৃত নয় এমন ঋণ। সংস্থাটির এমন শর্তের কারণ হলো— ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ আড়াল করে রাখতে বেশ কিছু কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ঋণ শ্রেণিকরণের ক্ষমতা ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দেয়া। এ ছাড়া খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল, অবলোপন এবং ঋণ পুনর্গঠনের মতো পদ্ধতিতেও বড় ছাড় দেয়া হয়েছে। গত বছরের জুলাইয়ে জারিকৃত নীতিমালায় এসব ছাড় দেয়া হয়। নতুন নীতিমালায় ডাউন পেমেন্টের হার কমিয়ে বকেয়ার আড়াই থেকে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। আগে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ডাউন পেমেন্ট বা এককালীন জমা দিতে হতো। আবার আগে কোনো ঋণ একবারে সর্বোচ্চ তিন বছরের জন্য পুনঃতফসিল করা যেত। এখন ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ প্রথম দুই দফা আট বছর করে ১৬ বছর, তৃতীয় দফায় সাত বছর এবং চতুর্থ দফায় ছয় বছরের জন্য পুনঃতফসিল করা যাবে। এভাবে পুনঃতফসিলের পর নতুন ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে ‘সমঝোতার অঙ্ক’ জমা দেয়ার শর্তও শিথিল করা হয়েছে। 

এ ছাড়া নিয়মিত মেয়াদি ঋণের বিদ্যমান অবশিষ্ট মেয়াদের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত মেয়াদ বর্ধিত করে ঋণ পুনর্গঠন করা যাবে। অন্যদিকে আগে মামলা ছাড়া দুই লাখ টাকা পর্যন্ত খেলাপি ঋণ অবলোপন করা যেত। এখন থেকে অর্থঋণ আদালতে মামলা ছাড়াই পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ অবলোপন করা যায়। ঋণের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে মামলার খরচ বেশি হয়। এ বিবেচনায় ব্যাংকগুলোর ছোট ঋণ অবলোপনে এমন সুযোগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সব মিলিয়ে বিভিন্ন ছাড় দিয়ে ব্যাংক খাতের আসল চিত্র আড়াল করার সুযোগ দিয়ে আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে নানা ছাড়ের পরও খেলাপি ঋণ বেড়ে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে খেলাপি ঋণ ৩৫ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা বেড়ে গেছে। গত জুন মাস শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। খেলাপি ঋণের এ অঙ্ক দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।  

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ বিতরণে তদারকি বাড়ানোর পরিবর্তে খেলাপিদের একটার পর একটা সুবিধা দিচ্ছে। তাই তারা বেপরোয়া। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে পরিসংখ্যান দিচ্ছে এটি আন্তর্জাতিক মানের নয়। কারণ এখানে অনেক তথ্য থাকে না। আবার খেলাপি কম দেখাতে অনেক তথ্য যোগ করা হয় না। ঋণ পুনঃতফসিল, পুনর্গঠন ও রাইট অফ করা তথ্য দেয়া হয় না। পাশাপাশি বিশেষ ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণ কম দেখানো হয় শুধু আর্থিক প্রতিবেদন ভালো দেখানোর জন্য যা কখনোই মানসম্পন্ন বলা যাবে না।’ ঋণখেলাপি বন্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ। তার মতে, ‘খেলাপিদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা এবং তাদের ফৌজদারি মামলার আওতায় আনা যায় কি-না তা ভেবে দেখা দরকার।’
 

Link copied!