Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ১০ মে, ২০২৫,

পেনশন স্কিমে আগ্রহে ভাটা

রেদওয়ানুল হক

নভেম্বর ১৯, ২০২৩, ০১:৩৭ এএম


পেনশন স্কিমে আগ্রহে ভাটা
  • প্রথম মাসে আশা জাগানোর পর ধারাবাহিক কমছে গ্রাহক
  • আশাবাদী কর্তৃপক্ষ, আস্থা সৃষ্টির লক্ষণ নেই
  • তিন মাসে ব্যাংকে ফিরেছে হাতে থাকা সাড়ে ৩৮ হাজার কোটি টাকা
  • সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমলেও পেনশনের তুলনায় বহুগুণ বেশি

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানত রাখা কিংবা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে যখন নগদ লাভ পাওয়া যাচ্ছে, তখন কেন সর্বজনীন পেনশন স্কিমে বিনিয়োগ করবে মানুষ; এমন প্রশ্ন ছিল প্রথম থেকেই। যদিও পেনশন কর্তৃপক্ষ নানাবিধ সুবিধার কথা বলছেন কিন্তু তাদের এ প্রচারণা আস্থা সৃষ্টি করতে পারেনি। তিন মাস আগে শুরু হওয়া কর্মসূচিটি প্রথম মাসে আশা জাগালেও এরপর ধারাবাহিক কমছে আমানতের পরিমাণ। ঊর্ধ্ব মূল্যস্ফীতির চাপ থাকলেও অন্যান্য বিনিয়োগ স্কিমগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে আগ্রহের তলানিতে অবস্থান করছে সর্বজনীন পেনশন স্কিম। 

তথ্যমতে, সর্বজনীন পেনশন স্কিমের বয়স তিন মাস পেরিয়েছে গতকাল। গত ১৭ আগস্ট এই কর্মসূচি চালুর পর গতকাল ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে মোট গ্রাহক হয়েছেন ১৫ হাজার ৮৪৫ জন। তবে প্রথম এক মাসে এ স্কিমের গ্রাহক হওয়ার জন্য যত মানুষ সাড়া দিয়েছিলেন, পরের দুই মাস মিলিয়ে গ্রাহকের সংখ্যা তার কাছাকাছিও হয়নি। সংশ্লষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এ কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার কথা থাকলেও এখনো কেউ এতে যোগ দেয়নি। ব্যক্তি উদ্যোগে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেভাবে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করা দরকার ছিল তাও করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এটি অনেকটা জীবন বিমার মতো কর্মসূচি হওয়ায় এতে বিনিয়োগে ভরসা পাচ্ছে না সাধারণ গ্রাহক। সরকারি বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠানের হয়রানি ও অনিয়ম এ খাতে অর্থ বিনিয়োগে অনাগ্রহের অন্যতম কারণ হিসেবে সামনে এসেছে। সাধারণ মানুষ বলছে, পরিবারের ভবিষ্যৎ কিংবা বৃদ্ধ বয়সে আর্থিক নিরাপত্তার জন্য দীর্ঘ সময় চাঁদা দেয়ার পর ঠিকভাবে সেটি পাওয়া যাবে কি-না সে চিন্তা থেকেই বিনিয়োগে আগ্রহ পাচ্ছেন না তারা। 

নাজমুল হোসেন নামের একজন বেসরকারি চাকরিজীবী আমার সংবাদকে বলেন, ‘এটি অনেকটা বিমার মতো। দেশে প্রচলিত বিমা প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে মানুষকে হয়রানি করছে তাতে সাহস পাচ্ছি না। সারাজীবন টাকা জমা করে শেষ বয়সে ঠিক মতো পাব কি-না কিংবা আমার সন্তানের কোনো কাজে আসবে কি-না সেটি নিয়ে যথেষ্ট আস্থাহীনতা আছে। তাই প্রথমদিকে বিনিয়োগের আগ্রহ থাকলেও এখন আর ভরসা পাচ্ছি না। শুনেছি মানুষ খুব একটা বিনিয়োগ করছে না এ খাতে। তিনি বলেন, দেশে কত জ্ঞানীগুনী মানুষ আছেন, তারা যদি বিনিয়োগ করত তাহলেও অনেক টাকা জমা হওয়ার কথা। যেহেতু মানুষ এখানে খুব একটা আগ্রহী নন, তাই ব্যাংকে ডিপোজিট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’  

পেনশন কর্তৃপক্ষ সূত্রে গতকাল পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, পেনশন স্কিমে যোগ দিতে সবচেয়ে কম চাঁদা জমা পড়েছে শেষের এক মাসে। শেষের এক মাস ধরা হয়েছে ১৮ অক্টোবর থেকে ১৮ নভেম্বরের দুপুর ১২টা পর্যন্ত। কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন মাসে দেশ-বিদেশ মিলিয়ে গ্রাহকদের থেকে চাঁদা জমা পড়েছে মোট ১৬ কোটি চার লাখ ২০ হাজার টাকা। গত ১৭ আগস্ট এ স্কিম উদ্বোধনের পর গত ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রথম এক মাসে চাঁদা পরিশোধ করেছিলেন ১২ হাজার ৮৮৯ জন। পরের এক মাসে নতুন করে এক হাজার ৮৩১ জন যুক্ত হওয়ায় মোট চাঁদাদাতার সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১৪ হাজার ৭২০। তারপরের মাস, অর্থাৎ ১৮ অক্টোবর থেকে ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত পেনশন স্কিমে নতুন করে যুক্ত হয়েছেন আরও এক হাজার ১৩৪ জন। এ তিন মাস মিলিয়েই মোট চাঁদাদাতা হয়েছেন ১৫ হাজার ৮৫৪ জন। তবে চাঁদাদাতাদের পরিসংখ্যান বলছে, সর্বজনীন পেনশন স্কিমে যোগদানের সংখ্যা প্রতি মাসেই কমছে। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৭ আগস্ট সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের দিন থেকেই তা সবার জন্য উন্মুক্ত রয়েছে। প্রথম দিন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে আট হাজার মানুষ অনলাইনে নিবন্ধন করলেও পুরো প্রক্রিয়া শেষ করে চাঁদা দিয়েছিলেন এক হাজার ৭০০ জন। চার শ্রেণির জনগোষ্ঠীর জন্য চার ধরনের পেনশন স্কিম রয়েছে। এগুলোর নাম হচ্ছে— প্রগতি, সুরক্ষা, সমতা ও প্রবাস। বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীদের জন্য ‘প্রগতি’, স্বকর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য ‘সুরক্ষা’, প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ‘প্রবাস’ এবং দেশের নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য ‘সমতা’। পেনশন কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, চার স্কিমের মধ্যে প্রগতিতে সাত হাজার ২১ জন আট কোটি ৬০ লাখ ৫৮ হাজার টাকা, সুরক্ষায় ছয় হাজার ৫২৮ জন পাঁচ কোটি ৫৪ লাখ ৫১ হাজার টাকা, প্রবাসে ৪৭৪ জন এক কোটি ৪১ লাখ ৪১ হাজার টাকা এবং সমতায় এক হাজার ৮২২ জন ৪৭ লাখ ৬৯ হাজার টাকা চাঁদা জমা দিয়েছেন। 

অন্যদিকে চলতি বছরের প্রথমদিকে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে অর্থাৎ মানুষের হাতে থাকা টাকার পরিমাণ বেড়ে যায়। ব্যাংক খাতে সৃষ্ট আস্থাহীনতার কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। সরকারি উদ্যোগে গঠিত সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচিতে সেই অর্থ বিনিয়োগ হতে পারে ধারণা করছিলেন খাত সংশ্লিষ্টরা। ঘটা করে শুরু হওয়া সেই উদ্যোগের প্রথম দিনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ রেজিস্ট্রেশনও করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ কর্মসূচিতে আস্থা রাখতে পারেনি সাধারণ মানুষ। তাই গত কয়েক মাস ধরে মানুষের হাতের টাকা পুনরায় ব্যাংকে ফিরতে শুরু করেছে। গত তিন মাসে ব্যাংকে ফিরেছে সাড়ে ৩৮ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রের তথ্য অনুযায়ী গত জুন শেষে দুই লাখ ৯১ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা ছিল মানুষের হাতে। তবে জুনের পর থেকে তা কমতে শুরু করে। জুলাইয়ে কমে দুই লাখ ৬৬ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা হয়। আগস্টে আরও কমে দুই লাখ ৫৮ হাজার ৩৫৬ কোটি এবং সেপ্টেম্বরে দুই লাখ ৫৩ হাজার ৫০৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

গত মুদ্রানীতিতে আমানত ও ঋণে সুদহারের নতুন পদ্ধতি চালু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর থেকে আমানতে সুদহার বাড়ছে। ধারণা করা হচ্ছে, সামনের দিনগুলোতে আমানতে সুদহার আরও বাড়বে। কারণ বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে তীব্র তারল্য সংকট বিরাজ করছে। তাই মানুষের হাতের টাকা কিংবা প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ ব্যাংকে জমা দিয়ে নগদ মুনাফা অর্জনেই মানুষ বেশি মনোযোগী হবে বলে ধারণা করছেন ব্যাংকাররা।  অন্যদিকে ঊর্ধ্ব মূল্যস্ফীতি এবং সরকারের বেধে দেয়া নানা শর্তের কারণে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমেছে। তবুও এ খাতে বিনিয়োগ পেনশন স্কিমের তুলনায় বেশি। কারণ এখানেও নগদ লাভ উত্তোলনের সুযোগ রয়েছে। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ছয় হাজার ৭৪৫ কোটি ৭৯ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। 

প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ২১ হাজার ৬৫৬ কোটি পাঁচ লাখ টাকা। আর পেনশন স্কিমে গত তিন মাসে বিনিয়োগ হয়েছে মাত্র ১৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ মানুষ ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সিকি ভাগও যদি পেনশন স্কিমে বিনিয়োগ করত তাহলেও এটি শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেত।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্রে যেভাবে একসঙ্গে অনেক টাকা রাখা যায়, পেনশন স্কিমে তেমন রাখা যায় না। সামান্য অঙ্কের কিস্তি দিতে হয় প্রতি মাসে। তাই এক্ষেত্রে গ্রাহক বৃদ্ধির বিকল্প নেই। যেহেতু ব্যাংকে আমানত বৃদ্ধি পাচ্ছে সে বিবেচনায় যদি অল্প হলেও পেনশন স্কিমের গ্রাহক বাড়ত তাহলে এটি ইতিবাচক বার্তা হতো। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, প্রতি মাসেই বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। যেটি এ কর্মসূচিকে বিপদে ফেলতে পারে। যেহেতু সরকার একটি বড় চিন্তা থেকে এ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, তাই এটিকে এগিয়ে নিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হবে— এমনটাই প্রত্যাশা সবার। 

অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, নির্বাচন সামনে রেখে অনেক কাজ বাকি রেখেই তাড়াহুড়ো করে এ কর্মসূচি চালু করা হয়েছে। তাই প্রথম কয়েক বছর এটি নাম-সর্বস্ব কার্যক্রম হতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তবে পর্যায়ক্রমে এটি ভালো করবে জানিয়ে তিনি বলেন, নিঃসন্দেহে এটি একটি মহৎ উদ্যোগ। 

সানেমের গবেষণা পরিচালক অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা বলেন, স্কিমে যে ধরনের রিটার্ন সুবিধা রাখা হয়েছে সেটি চলমান প্রকল্পগুলো থেকে লাভজনক হওয়া প্রয়োজন। কারণ দীর্ঘমেয়াদে বিনোয়োগের তুলনায় যদি সঞ্চয়পত্রে মুনাফা বেশি হয় তাহলে মানুষ হতাশ হতে পারে। তবে এ কর্মসূচি নিয়ে আশাবাদী কর্তৃপক্ষ। দেশের অন্তত ১০ কোটি মানুষ পেনশন-ব্যবস্থার আওতায় আসবেন এমন প্রত্যাশা সরকারের রয়েছে। বিশাল একটি জনগোষ্ঠীকে সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় আনা এবং নিম্ন আয় ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত সমাজের ৮৫ শতাংশ মানুষকে সুরক্ষা দেয়ার লক্ষ্য নিয়েই পেনশন স্কিম চালু করা হয়।

জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘শুরুতে সোনালী ব্যাংক থাকলেও এখন অগ্রণী ব্যাংকও পেনশন স্কিমের সেবা দেয়ার কাজ করছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সঙ্গেও এ ব্যাপারে আলোচনা চলছে। ফলে স্কিম নিয়ে আমরা খুবই আশাবাদী।’ আশাবাদের আরও কোনো ভিত্তি আছে কি-না, জানতে চাইলে গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘প্রবাস স্কিমের কথা যদি বলি, অনেকেই আগ্রহ দেখাচ্ছেন কিন্তু অর্থ পাঠাতে পারছেন না। কারণ, অনেকেরই ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড নেই। এ সমস্যা দূর করতে এখন যেসব ব্যাংকের মাধ্যমে সর্বোচ্চ প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) আসে, সেসব ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) করার কাজ চলছে। অর্থসচিব সমপ্রতি এ বিষয়ে একটি বৈঠক করেছেন।’

প্রগতি স্কিমের আওতায় একটা প্রতিষ্ঠানও যদি এসে যায়, তাহলেই তো ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাহক যুক্ত হয়ে যাবেন এমন মন্তব্য করে গোলাম মোস্তফা বলেন, একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যুক্ত হলে আরও প্রতিষ্ঠান আসবে বলে আশা করা যায়। সবার জন্য চালু করা পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে ইউপেনশন ওয়েবসাইটে গিয়ে নিবন্ধন করতে হয়। এ ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বা পাসপোর্ট নম্বর, একটি সচল মুঠোফোন নম্বর, ব্যাংক হিসাব নম্বর, নমিনির এনআইডি ইত্যাদি তথ্য লাগে। ১৮ বছরের বেশি বয়সের নাগরিকরা এতে অংশ নিতে পারছেন।
 

Link copied!