নভেম্বর ২২, ২০২৩, ০৪:৩২ পিএম
- মোট ঋণের প্রায় ১০ শতাংশই খেলাপি
- এক বছরে বেড়েছে ২১ হাজার কোটি টাকা
- আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী কমছে না খেলাপি ঋণ
- ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণে জোর তৎপরতার পরও কমছে না ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ। দিনদিন বাড়তে থাকা খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে আনতে বিপুল পরিমাণে পুনঃতফসিল শুরু করে ব্যাংকগুলো। তবুও খেলাপির লাগাম টানা সম্ভব হয়নি। চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর) মাত্র ৬৪২ কোটি টাকা কমে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকায়।
গত জুন শেষে এ অঙ্ক ছিল এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। অথচ দুটি গ্রুপের প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে একটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমানো হয়েছে সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ অন্য ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত জুন শেষে দেশের ইতিহাসে রেকর্ড পরিমাণে ঋণখেলাপি মানে শ্রেণিকরণ হয়। তখন মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ সাড়ে ২৪ হাজার কোটি টাকা বেড়ে যায়। ফলে ব্যাপক চাপে পরে আর্থিক খাত। এছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত পূরণে খেলাপি কমাতে উদ্যোগী হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে এবং পর্যবেক্ষকদের মাধ্যমে খেলাপি কমাতে চাপ দিতে থাকে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মানে খেলাপি না কমায় ঋণ পুুনঃতফসিলের কৌশল নেয় ব্যাংকগুলো। তবুও হুহু করে বাড়তে থাকা খেলাপি ঋণ তিন মাসে ১০ হাজার কোটি টাকা বেড়ে যায়।
তবে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের গ্রাহক বড় দুই শিল্প গোষ্ঠী বেক্সিমকো ও এস আলম গ্রুপের ১৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়। ফলে ব্যাংক খাতে সার্বিক খেলাপি ঋণ সাড়ে ছয়শ কোটি টাকা কমেছে। তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৬৫ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। খেলাপি ঋণের এ অঙ্ক দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২১ হাজার কোটি টাকা। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে এ অঙ্ক দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকায়। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। দ্বিতীয় প্রান্তিকে বেড়েছিল ২৪ হাজার কোটি টাকা। তবে বিপুল পুনঃতফসিলের ওপর ভর করে তৃতীয় প্রান্তিকে খেলাপি ৬৪২ কোটি টাকা কমেছে।
অর্থনীতি বিশ্লেষক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, খাতা কলমে খেলাপি ঋণ যা দেখানো হচ্ছে বাস্তবে এ অংক অনেক বেশি। কারণ এখানে পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা ঋণের হিসাব নেই, এগুলো যোগ করলে আড়াই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। তিনি জানান, খেলাপি ঋণ কমাতে না পারলে ব্যাংকিং খাতে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হবে। ফলে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেয়ার সক্ষমতা কমবে। এতে করে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে যাবে। ফলে কর্মসংস্থান হ্রাস পাবে। সর্বোপরি দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। যা আমাদের কাম্য নয়। তাই সুবিধা বন্ধ করে খেলাপিদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যেন আইনে গিয়ে বছরের পর বছর না ঝুলে থাকে। এছাড়া খেলাপিদের সম্পদ নিয়ে নিতে হবে। কঠোর অবস্থায় যাওয়া ছাড়া এখন আর কোনো বিকল্প উপায় নেই বলে জানান এ অর্থনীতিবিদ।
প্রসঙ্গত, ডলার সংকটে পড়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের ঋণের দ্বারস্থ হয় বাংলাদেশ। ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭৬ দশমিক ২৭ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে। বাকি ছয় কিস্তির মধ্যে আগামী ১২ ডিসেম্বর দ্বিতীয় কিস্তি অনুমোদনের সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারিত আছে। ধাপে ধাপে ঋণ ছাড়ের ক্ষেত্রে সংস্থাটি ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার শর্ত দিয়েছে। ২০২৬ সালের মধ্যে বেসরকারি খাতে খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের নিচে এবং সরকারি ব্যাংকে ১০ শতাংশের নিচে নামাতে হবে। অথচ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ২১ দশমিক ৭০ শতাংশ এবং সার্বিক খেলাপির হার ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
আইএমফের শর্ত অনুযায়ী পুনঃতফসিল ও অবলোপন এবং অবলোপনকৃত ঋণও ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ হিসেবে বিবেচিত হবে। সংস্থাটির শর্তের আলোকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে ব্যাংক খাতের মোট ঋণের তিন লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা বা ২৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ ছিল ঝুঁকিপূর্ণ সম্পত্তি। ছয় মাসের ব্যবধানে এ অঙ্ক ৫৬ হাজার কোটি টাকা বেড়ে যায়। গত জুন শেষে এটি দাঁড়িয়েছে চার লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকায়। সেপ্টেম্বরের তথ্য যোগ হলে এটি সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র। এ ছাড়া পুনর্গঠন ঋণের তথ্য যোগ হলে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ কমবেশি পাঁচ লাখ কোটি টাকা হবে বলে জানা গেছে।
আরএস