Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ০৯ মে, ২০২৫,

পেশাজীবীরাও বিদেশমুখী

সাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া

সাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া

ডিসেম্বর ৬, ২০২৩, ০৪:৩৯ পিএম


পেশাজীবীরাও বিদেশমুখী

আতিক ইসলাম পড়াশোনা করেছেন রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়াশোনা শেষে গত তিন বছর ধরে কর্মরত বহুজাতিক একটি কোম্পানির সহকারী ম্যানেজার পদে। কিন্তু দেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে তিনি পাড়ি জমাতে চান মধ্য ইউরোপের দেশ জার্মানিতে। এর জন্য তিনি গত এক বছর জার্মান ভাষা শিক্ষাসহ বিভিন্ন আনুষঙ্গিক কাজ সম্পন্ন করেছেন। তার আশা, আগামী বছরের মধ্যে তিনি ভিসা পেয়ে দেশ ছেড়ে যাবেন। 

৩৫ বছর বয়সি আবিদ হোসাইন। দেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত। তার পরিবারে রয়েছে স্ত্রী ও তিন বছর বয়সের এক মেয়ে। তিনি এসেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কনস্যুলার বিভাগে পারিবারিক ভিসার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র স্বাক্ষর করাতে। কনস্যুলার বিভাগে অপেক্ষারত অবস্থায় তার সাথে কথা হয় আমার সংবাদের এ প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, উন্নত জীবনের আশা কে না করে। আমি ও আমার স্ত্রী দুজনই উচ্চ শিক্ষিত। দেশে চাকরি করছি ঠিক আছে কিন্তু দেশের সার্বিক অবস্থা ও সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে দেশের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করছি। তার পছন্দের গন্তব্য কানাডা। 

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে একটি আইটি ফার্মে কর্মরত আছেন মোনায়েম খন্দকার। চলতি বছরের মাঝামাঝি তিনি বিয়ে করেছেন। তিনিও এসেছেন কনস্যুলার বিভাগে তার ও স্ত্রীর বিদেশগামী প্রয়োজনীয় কাগজপত্র স্বাক্ষর করাতে। তিনি যেতে চান যুক্তরাষ্ট্র। বিদেশমুখী হওয়ার কারণ সম্পর্কে তার কাছে জানতে চাইলে বলেন, দেশের বাইরে গিয়ে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করতে চান। পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরবেন কি-না এমন প্রশ্নে তিনি কিছুটা ইতঃস্তত হয়ে বললেন, ভালো সুযোগ না পেলে দেশে ফিরবেন না। আমার সংবাদের এ প্রতিবেদক গত ১৫ দিন প্রায় ৫০-এর অধিক পেশাজীবীর সাথে কথা বলেন। যারা উন্নত জীবনের আশায় দেশ ছাড়তে চাচ্ছেন। প্রতি বছর দেশ ছেড়ে যাওয়া তরুণদের উপর পরিসংখ্যান থাকলেও পেশাজীবী ঠিক কতজন দেশ ছাড়ছেন তার কোনো পরিসংখ্যান নেই।

সামপ্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টার (বিওয়াইএলসি) ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিস অ্যান্ড জাস্টিস সেন্টারের ‘ইয়ুথ ম্যাটার্স সার্ভে-২০২৩’ শীর্ষক এক যৌথ সমীক্ষায় আট বিভাগের পাঁচ হাজার ৬০৯ জন তরুণ-তরুণীর মধ্যে পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, দেশ ছাড়ার কারণ হিসেবে ৭৫ দশমিক ৫ শতাংশ আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যতের অনিশ্চিতাকেই দায়ী করছেন। ৫০ দশমিক ৯ শতাংশ তরুণ মনে করেন, তাদের দক্ষতা অনুযায়ী পর্যাপ্ত চাকরি নেই দেশে। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই বলে মনে করেন ৪২ দশমিক ৩ শতাংশ তরুণ এবং ৪০ দশমিক ৮ শতাংশ মনে করেন, দেশে উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তার অভাব রয়েছে। 

এ ছাড়াও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার কারণেও দেশ ছাড়তে চাইছেন ৩৩ দশমিক ৯ শতাংশ তরুণ। জরিপে অংশ নেয়া ৫৫ দশমিক ৩ শতাংশ তরুণ বিশ্বাস করেন, বর্তমানে দেশে শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করছে না। অপরদিকে, ৬৩ শতাংশ তরুণ মনে করেন, গত পাঁচ বছরে দেশের সার্বিক শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে দুর্নীতিকে চিহ্নিত করেছেন ৮৮ দশমিক ৯ শতাংশ তরুণ। এ ছাড়াও ২৯ শতাংশ তরুণ মনে করেন দেশে গণতান্ত্রিক অধিকার হ্রাস পাচ্ছে যা সুশাসনকে বাধাগ্রস্ত করছে। বিদেশ যেতে হলে দেশে পড়াশোনা করা সনদসমূহ স্বাক্ষর করে নিতে হয় শিক্ষা, পররাষ্ট্র, আইন ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগ থেকে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কনস্যুলার বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এ বিভাগে আমি বেশ কিছু দিন যাবত কর্মরত আছি। পারিবারিক ভিসা নিয়ে কেউ বিদেশ যেতে চাইলে তার সাধারণ ভিসার চেয়ে অনেক বেশি কাগজপত্র স্বাক্ষর করিয়ে নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে এমন কাগজপত্রের সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিদিনই অনেকে আসছেন পারিবারিক সদস্যদের কাগজপত্র নিয়ে। 

পেশাজীবী ও তরুণদের বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে রাজধানী ও রাজধানীর বাইরে গড়ে উঠেছে অনেকগুলো কনসালটেন্সি ফার্ম। এসব ফার্মের কয়েকটি ঘুরে দেখা যায় প্রতিদিনই এসব ফার্মে বিদেশমুখী মানুষ পরামর্শ নিতে আসছেন। তেমনই একটি ফার্ম রাজধানীর পান্থপথ এলাকার সুইডিশ গ্লোবাল এডুকেশন অ্যান্ড ভিসা সার্ভিস। ফার্মটির একজন সিনিয়র কনসালটেন্ট জাফরান মাহমুদ। তার সাথে কথা বলেন আমার সংবাদের এ প্রতিবেদক। তিনি বলেন, তরুণদের মধ্যে বিদেশমুখী হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। কিন্তু গত দুই তিন বছর দেশে বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত অনেকে পরিবারসহ বিদেশমুখী হচ্ছেন। দেশের অনেক ভালো চাকরি ছেড়ে বিদেশমুখী হওয়ার উদাহরণ অনেক। বিশেষ করে আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপে মানুষ ঝুঁকছে বেশি। তার অন্যতম কারণ একটিই উন্নত ও নিরাপদ জীবন। 

পেশাজীবীদের বিদেশমুখী হওয়ার কারণ ও ভবিষ্যতে এর প্রভাব সম্পর্কে আমার সংবাদের এ প্রতিবেদক কথা বলেন বাংলাদেশ অর্থনীতির সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আইনুল ইসলামের সাথে। তিনি বলেন, ‘বিদেশমুখী হওয়ার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটো দিক আছে। হয়তো সাময়িক সময়ের জন্য মনে হতে পারে বিদেশ গিয়ে রেমিট্যান্স পাঠালে দেশের জন্য কাজে লাগবে। কিন্তু মেধাবীরা এভাবে বিদেশমুখী হলে দেশের দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। দেশের মেধা দেশে কাজে লাগানোর মতো কর্মসংস্থান আমাদের সৃষ্টি করতে হবে। অন্যদিকে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রয়োজন যাতে সবাই দেশেকেই নিরাপদ আশ্রয় মনে করে।

আরএস
 

Link copied!