Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪,

সর্বোচ্চ এলএনজি আমদানির উদ্যোগ

মহিউদ্দিন রাব্বানি

মার্চ ৩১, ২০২৪, ১২:৩৫ এএম


সর্বোচ্চ এলএনজি আমদানির উদ্যোগ
  • বিশ্ববাজারে দাম কমায় প্রায় ৫০ কার্গো আমদানির পরিকল্পনা
  • দৈনিক গ্যাস সরবরাহ করা হবে তিন হাজার ১৫১ মিলিয়ন ঘনফুট
  • সিঙ্গাপুর থেকে এলএনজি সরবরাহের নীতিগত অনুমোদন

সর্বোচ্চ চাহিদা সামাল দিতে এলএনজি আমদানির বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে 
—মোহম্মদ হোসেইন, মহাপরিচালক, পাওয়ার সেল

এপ্রিল থেকে গ্যাসের সরবরাহ ক্রমান্বয়ে বাড়বে। আশা করি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে 
—জনেন্দ্র নাথ সরকার, চেয়ারম্যান, পেট্রোবাংলা

রমজানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের কথা থাকলেও কার্যত প্রথম রোজা থেকেই সারা দেশে মাঝারি ধরনের লোডশেডিং হচ্ছে। এ ছাড়া চলতি সেচ মওসুমেও বিদ্যুতের বাড়তি চাপ রয়েছে। রমজান, গ্রীষ্ম আর সেচ— এই তিন মিলে বিদ্যুতের চাহিদা দাঁড়াচ্ছে প্রায় ১৮ হাজার মেগাওয়াট। 

পরিস্থিতি সামাল দিতে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, শিল্প-কারখানায় উৎপাদন ঠিক রাখা, বাণিজ্যিক সরবরাহ ঠিক রাখতে বিশ্ববাজারের স্পট মার্কেট থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণ এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

এদিকে গত তিন বছরের মধ্যে বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম সর্বনিম্ন। এই কম দামের সুযোগ নিতে চাইছে সরকার। গ্রীষ্মে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনে দৈনিক এক হাজার ২৯০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে পেট্রোবাংলা। গ্রীষ্ম এবং সেচের বিদ্যুৎ সরবরাহ নির্বিঘ্ন করতে এই ব্যবস্থা হাতে নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান জনেন্দ্রনাথ সরকার মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে জানান, এপ্রিল থেকে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দৈনিক গ্যাসের সরবরাহ বাড়িয়ে তিন হাজার ১৫১ মিলিয়ন ঘনফুট করা হবে। বিদ্যুৎ, শিল্প এবং সব ধরনের কারখানায় যাতে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা যায়, এ জন্য এই ব্যবস্থা করা হয়েছে।

চলতি বছর দেশে গ্রীষ্মে বিদ্যুতের চাহিদা ১৭ থেকে ১৮ হাজার মেগাওয়াটে দাঁড়াতে পারে এমন তথ্য মেলে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে। ফলে দুই থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতি থাকবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। সারা দেশে গরমের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লোডশেডিংয়ের মাত্রা। এর আগে সেচ মৌসুমে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে গ্রাহকদের প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগ সাত নির্দেশনা জারি করে।

সব কিছু সামাল দিতে সমপ্রতি গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে পেট্রোবাংলা এবং জ্বালানি বিভাগ। সরকারের নির্দেশে এ জন্য বিদেশ থেকে বেশি পরিমাণ এলএনজি আমদানি করা হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম কমায় সরকার স্পট মার্কেট থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক এলএনজি কার্গো আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ইনভেস্টিগেটিং ডটকম (জ্বালানি বাজার পর্যবেক্ষক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান) ও রয়টার্সের তথ্যমতে, বর্তমানে বিশ্ববাজারে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম পৌনে আট ডলার থেকে সাড়ে আট ডলার। এর আগে ২০২১ সালে এমএমবিটিইউ প্রতি দাম নেমেছিল ৭ দশমিক ৬০ ডলারে।

জ্বালানি বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সপ্তাহ দু-একের মধ্যে সামিটের ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল রক্ষণাবেক্ষণ শেষে চালু হবে। এটি চালু হলে গ্যাসের সরবরাহ স্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাবে। মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে যে পরিকল্পনা দেয়া হয়েছে তাতে দেখা যায়, অনগ্রিড বিদ্যুৎকেন্দ্রে এক হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট, অফগ্রিড বিদ্যুৎকেন্দ্রে দৈনিক ৯০ মিলিয়ন ঘনফুট, অর্থাৎ সব মিলিয়ে মোট বিদ্যুতে এক হাজার ২৯০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হবে। চলতি বছর সাড়ে ১৬ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ উৎপাদনের চাহিদা হতে পারে। এ জন্য পিডিবির তরফ থেকে এক হাজার ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের কথা বলা হয়। তবে পেট্রোবাংলা এক হাজার ২৯০ মিলিয়ন ঘনফুট পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ করতে সম্মত হয়েছে। এর আগে ২০২৩-এর গ্রীষ্মে কোনো কোনো দিন সর্বোচ্চ এক হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ পেয়েছে বিদ্যুৎ। তবে গড়ে এই সরবরাহ এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের মধ্যেই ছিল।

এর বাইরে সার কারখানায় দৈনিক ১৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হবে। ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ বা নিজস্ব উৎপাদনে কারখানা চালানোর জন্য দৈনিক ৬৩৮ মিলিয়ন ঘনফুট, শিল্পে ৬৯২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হবে। অর্থাৎ শিল্পে সব মিলিয়ে এক হাজার ৩৩০ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ করা হবে। এ ছাড়া আবাসিকে ২৭৫ মিলিয়ন ঘনফুট, সিএনজিতে ১১০ মিলিয়ন ঘনফুট, বাণিজ্যিকে ১৫ এবং চা-বাগানে এক মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হবে। এদিকে সিঙ্গাপুর থেকে স্বল্পমেয়াদে এলএনজি সরবরাহের নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে সরকার। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন-২০১০ (সংশোধনী-২০২১)-এর আওতায় সিঙ্গাপুরের গানভোর সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেড কর্তৃক স্বল্পমেয়াদে এই এলএনজি আমদানি করছে সরকার। 

সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে এ প্রস্তাবের নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়েছে। পেট্রোবাংলার সূত্র জানায়, এখন আন্তর্জাতিক স্পট মার্কেটে এলএনজি যে দামে বিক্রি হচ্ছে, তাতে এ বছর প্রায় দ্বিগুণ বেশি কেনা হবে। এ সময় স্পট মার্কেট থেকে ৪৮-৪৯টি কার্গো কেনার পরিকল্পনা রয়েছে পেট্রোবাংলার। গত বছর কেনা হয়েছিল ২৫টি কার্গো। সে হিসাবে এ বছর ২৩টি কার্গো বেশি কেনা হবে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে এপ্রিলে পাঁচটি কার্গো আমদানি করা হবে। এর আগে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে সাতটি কার্গো আমদানি করা হয়েছে। তথ্য মতে, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম প্রায় ১৪ ডলারে উঠে যায়। ২০২২ সালের আগস্টে প্রতি এমএমবিটিইউর দাম উঠে আসে ৫৫ ডলারে। দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধির কারণে ওই বছরের মাঝামাঝি স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ করে দেয় জ্বালানি বিভাগ। ওই সময় টানা ছয়-সাত মাস আমদানি বন্ধ থাকে। তখন দেশে গ্যাস সরবরাহ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। ২০২২ সালের নভেম্বরের পর থেকে বিশ্ববাজারে জ্বালানিটির দাম নিম্নমুখী হতে শুরু করে। ফলে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে আবারো স্পট মার্কেট থেকে আমদানি শুরু করে সরকার। চলতি বছরের শুরুতে বাজারদর ৯ থেকে সাড়ে ৯ ডলারে ওঠানামা করেছে। বর্তমানে তা সাড়ে আট ডলারের নিচে নেমে এসেছে। 

পেট্রোবাংলার দৈনিক গ্যাসের চিত্র থেকে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে চাহিদা বিপরীতে দুই হাজার ৬৬৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এর মধ্যে এলএনজির পরিমাণ ৬৩৭ মিলিয়ন ঘনফুট। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, আগামী এপ্রিল মাস থেকে গ্যাসের সরবরাহ ক্রমান্বয়ে বাড়বে। আশা করছি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। আমরা একটি পরিকল্পনা করেছি, সে মোতাবেক এগোচ্ছি।

আন্তার্জাতিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহম্মদ হোসেইন বলেন, সেচ ও গ্রীষ্মের চাহিদা সামাল দেয়ার জন্য এলএনজি আমদানির বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে কোন কোন কোম্পানির কাছ থেকে এলএনজি আনা হবে, কার্গোগুলো কবে আসবে, তাও ঠিক করা হয়েছে। সঙ্গত কারণে এবার বিদ্যুতের জন্য গ্যাসের কোনো সমস্যা হবে না বলে আমরা আশা করছি।
 

Link copied!