Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

ঈশা খাঁর স্মৃতি বিজড়িত

কালের সাক্ষী জঙ্গলবাড়ি ও এগারসিন্দুর দুর্গ

আশরাফুল ইসলাম তুষার, কিশোরগঞ্জ

আশরাফুল ইসলাম তুষার, কিশোরগঞ্জ

মে ২৫, ২০২৩, ০৬:৪২ পিএম


কালের সাক্ষী জঙ্গলবাড়ি ও এগারসিন্দুর দুর্গ

কিশোরগঞ্জ জেলায় অবস্থিত ঈশা খাঁর স্মৃতিবাহী দুটি স্থাপনা জঙ্গলবাড়ি ও এগারসিন্দুর দুর্গ। মসনদে-আলা-বীর ঈশা খাঁ ছিলেন বাংলার বার ভূঁইয়াদের প্রধান। ঈশা খাঁর জঙ্গলবাড়ি প্রকৃতপক্ষে ঈশা খাঁর দ্বিতীয় রাজধানী ছিল। কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলাধীন কাদিরজঙ্গল ইউনিয়নের জঙ্গলবাড়ি গ্রামে নরসুন্দা নদীর তীরে দূর্গটির অবস্থান। বর্তমানে এটি বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর কর্তৃক তালিকাভুক্ত একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা।

ইতিহাসে ঈশা খাঁ সম্পর্কে যা পাওয়া যায় তা হলো, তিনি ১৫২৯ সালের ১৮ আগস্ট জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সোলায়মান খাঁ। তিনি ছিলেন আফগানিস্তানের সোলায়মান পার্বত্য অঞ্চলের এক আফগান দলপতির বংশধর। মুঘল ও ইংরেজদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ বাংলার তৎকালীন জমিদারগণ তাকে গোয়েন্দা মারফতে বাংলায় আসার সংবাদ পাঠালে তিনি ১৪০০ ঘোড়সওয়ার, ২১টি নৌবিহার ও গোলাবারুদ নিয়ে ত্রিপুরা রাজ্যে পৌঁছান। ১৫৮৫ সালে তৎকালীন কোচ রাজা লক্ষ্মণ হাজরা ও রাম হাজরাকে পরাজিত করে জঙ্গলবাড়ি দূর্গ দখল করেন। কোচ রাজা লক্ষ্মণ হাজরা বা ঈশা খাঁর কেউ এই দূর্গের স্থপতি নয়। এটি প্রাক-মুসলিম যুগে নির্মিত বলে ধারনা করা হয়। তবে ঈশা খাঁ দূর্গ দখল করার পর এর ভিতরে কিছু স্থাপনা নির্মাণ করেন। ১৫৯৭ সালে তিনি পাকুন্দিয়ার এগারসিন্দুরে মুঘল সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংকে পরাজিত করেন। এই দূর্গ থেকে পরে তিন মোট ২২টি পরগণা দখল করেন। ত্রিপুরা রাজ্য থেকে কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ি দূর্গ দখল করে পরবর্তীতে সোনারগাঁও দূর্গ দখল করেন। তিনি তাঁর যৌবন ভাটিতে কাটিয়েছিলেন। সোনারগাঁওয়ের প্রাচীন নাম ছিল সুবর্ণ গ্রাম। ঈশা খাঁ ত্রিপুরা রাজ্যের রাজা চাঁদরায়ের কন্যা-কেদার রাজার বোন স্বর্ণময়ীকে বিবাহ করেন। স্বর্ণময়ী পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং ঈশা খাঁ তার নাম রাখেন সোনা বিবি। সেই নাম অনুসারে বাংলার রাজধানী সোনারগাঁও নামকরণ করা হয়।

দূর থেকে দেখলে দুর্গস্থলটিকে এখনো একটি দ্বীপ বলে মনে হয়। চারদিকের জলরাশি এতটাই গভীর যে শুকনো মৌসুমেও নৌকা ছাড়া পার হওয়া যায় না। দুর্গের চারিদিকে প্রমান করে যে, এটি ছিল বৃত্তাকার আকৃতির। দক্ষিন, পশ্চিম ওউত্তর দিকে গভীর পরিখা খনন করা এবং পূর্বদিকে নরসুন্ধা নদীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা হয়। কালের পরিক্রমায় দুর্গটির ছাদ ধসে গেলেও দরবার কক্ষের অনেকটাই টিকে আছে। দরবারসংলগ্ন পান্থশালায় এখনো ১০-১২টি কক্ষের অস্তিত্ব আছে। ২০০৫ সালের ১২ জুন দুর্গের ভেতরের দরবারগৃহটি সংস্কার করে স্থানীয় প্রশাসন ‘ঈশা খাঁ স্মৃতি জাদুঘর ও পাঠাগার’ স্থাপন করে। সেখানে ঈশা খাঁর বিভিন্ন ছবি, তার বংশধরদের তালিকা এবং বিভিন্ন নিদর্শন রয়েছে।

যেভাবে যাবেন: গুলিস্তান থেকে প্রতি ঘণ্টায় কিশোরগঞ্জের বাস ছাড়ে

মহাখালী থেকে । তাছাড়া সকাল  ৭টা ৩০ মিনিটে  ঢাকা কমলাপুর রেলষ্টশন থেকে এগারসিন্দুর এক্সপ্রেসে কিশোরগঞ্জ যাওয়া যায় ছুটির দিনে তিন ঘণ্টায় পেঁছোনো যায় কিশোরগঞ্জ। তারপর সাত কিলোমিটার বাস, অটো রিকশায় চেপে জঙ্গলবাড়ি।

বার ভূঁইয়ার বিখ্যাত ভূঁইয়া ঈশা খাঁর স্মৃতিবিজড়িত এগারসিন্দুর দুর্গ। লালমাটি, সবুজ গাছগাছালি আর ঐতিহাসিক নিদর্শনে সমৃদ্ধ এগারসিন্দুর। এটি ছিল ঈশা খাঁর শক্ত ঘাঁটি। জনশ্রুতি রয়েছে, ১১টি নদীর মোহনায় ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে উঁচু শক্ত এঁটেল লালমাটির এলাকা ব্যবসা-বাণিজ্য ও বসবাসের স্থান হিসেবে উতকৃষ্ট বিবেচিত হওয়ায় গঞ্জের হাট নামে এটি প্রসিদ্ধ ছিল। হাটটি ১১টি নদীর সঙ্গমস্থলে হওয়ায় স্থানীয়রা ১১টি নদীকে সিন্দু আখ্যায়িত করে গঞ্জের হাট থেকে স্থানটির নামকরণ করেন এগারসিন্দুর। কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে এগারসিন্দুর অবস্থিত।

এগারসিন্দুর ইতিহাস থেকে জানা যায়, বেবুধ নামক এক কোচ উপজাতি প্রধান ষোড়শ শতাব্দীতে এই দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে। তিনি একে রাজধানী করেন। বেবুধ রাজার দীঘি নামক একটি দীঘি এখানে অবস্থিত এবং এই দীঘির পাড়ে রাজপ্রাসাদ ছিল বলে ধারণা করা হয়। ঈশা খাঁ বেবুধ রাজার কাছ থেকে দুর্গটি দখল করে নেন এবং একে শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত করেন। দুর্গে প্রায় ৬০ ফুট চওড়া মাটির দেয়াল ছিল। এর তিন দিকে নদী দিয়ে ঘেরা ছিল এবং এক দিকে পরিখা খনন করে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা ছিল। ১৮৯২ সালের ভূমিকম্পে দুর্গটি ধ্বংস হয়ে গেলেও আজও কিছু কিছু নিদর্শন আছে, যা দেখে আন্দাজ করা যায় দুর্গটির অবস্থান। দুর্গটি ছিল বিশাল আকারের। দুর্গ এলাকায় এখনও খুঁজে পাওয়া যায় জাফরি ইট, অজানা সুড়ঙ্গ, মৃতপাত্রের ভগ্নাংশ। এটি ছিল ঈশা খাঁর শক্ত ঘাঁটি। মোগলরা বারবার আক্রমণ করেও এ দুর্গের পতন ঘটাতে পারেনি। এখনও দুর্গের ভেতরে উঁচু একটি টিলার মতো ঢিবি দাঁড়িয়ে আছে, যেখান থেকে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কামান দাগানো হতো। বর্তমানে এই দুর্গের অস্তিত্ব নেই। এগারসিন্দুরে রয়েছে – এগারসিন্দুর দুর্গ, বেবুথ রাজার দিঘি, সাদী মসজিদ, শাহ মাহমুদ মসজিদ। দুর্গ না থাকলেও ১৭ শতাব্দীর দুটি মসজিদ টিকে রয়েছে। এগুলো হল ১৬৫২ সালে নির্মিত সাদী মসজিদ ও ১৬৯৭ সালে নির্মিত শাহ মুহাম্মদ মসজিদ। সাদী মসজিদ বর্গাকার এবং আট কোণাকার মিনারবিশিষ্ট।

যেভাবে যাবেন: ঢাকার মহাখালী থেকে জলসিঁড়ি ও অনন্যা পরিবহনের বাস সরাসরি পাকুন্দিয়া চলাচল করে। থানারঘাট নেমে এগারসিন্দুর যাওয়া যায় সহজে।

আরএস
 

Link copied!