Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

বেরিয়ে আসছে আড়ালের চেহারা

মো. মাসুম বিল্লাহ

মে ৯, ২০২২, ০১:১৬ এএম


বেরিয়ে আসছে আড়ালের চেহারা

খাদ্যপণ্য সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে জনজীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। অতি মুনাফার লোভে তারা এতটাই বেপরোয়া হয়ে পড়েছে যে, পবিত্র ঈদুল ফিতরকে সংকটময় করে তুলেছিল চক্রটি। জনদুর্ভোগ চরম সীমায় ঠেকিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে নিজেদের চাহিদা মতো দাম বাড়িয়ে নিয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই ভোগ্যপণ্যটির। 

চক্রটি হঠাৎ করে বাজারের সব সয়াবিন তেল গায়েব করে দেয়। বসতবাড়ি, গুদামঘর এমনকি মাটির গর্তে তেল লুকিয়ে রেখে সংকট ঘনীভূত করা হয়। খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা বড় কোম্পানিগুলোকে ঢালাওভাবে দোষারোপ করতে থাকে।

সরবরাহ সংকট তৈরির অভিযোগ করা হয় কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে। সবচেয়ে আক্ষেপের বিষয় হলো সরকারি সংস্থা ভোক্তা অধিকারের অনুরোধে বাজার পর্যালোচনা করে উল্টো দোকানিদের মজুতকে জায়েজ করার পক্ষে সাফাই গেয়েছেন বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন। 

অন্যদিকে বড় কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ করা হলেও দাম বাড়ার পর বেরিয়ে আসছে প্রকৃত চিত্র। সারা দেশে অবৈধ মজুত করা তেল এখন বাড়তি দামে বিক্রি করছে এসব চক্র। গত কয়েকদিনে ভোক্তা অধিকারের অভিযানে বেরিয়ে আসছে মজুতদারদের আসল চেহারা। 

গতকালও দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে হাজার হাজার লিটার তেল জব্দ করা হয়। গতকাল রোববার চট্টগ্রামের ষোলশহর এলাকার কর্ণফুলী কমপ্লেক্সের কাশেম স্টোর থেকে এক হাজার ৫০ লিটার সয়াবিন তেল জব্দ করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

এসময় ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় দোকানিকে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহ অভিযানের বিষয়টি সাংবাদিকদের জানান। 

তিনি বলেন, তেলের বোতলগুলো দোকানের মেঝের নিচে বিশেষ কায়দায় করা একটি গুদামে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।

ফয়েজ উল্লাহ বলেন, বাজারে কৃত্রিম সংকটকে কাজে লাগিয়ে বেশি মুনাফা আদায়ের উদ্দেশ্যে তেলের বোতলগুলো ঈদের আগেই মজুত করা হয়েছিল। জব্দ করা তেলগুলো কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতেই খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে ওই ব্যবসায়ী।

অন্যদিকে আগের কম দামে কেনা তেল বেশি দামে বিক্রি করার অপরাধে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের একটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়েছে।

গতকাল অভিযান চালিয়ে শাহ মিরন জেনারেল স্টোরকে দুই হাজার টাকা জরিমানা করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। 

ওই দোকানে আগের কেনা বোতলজাত সয়াবিন তেল যেখানে মূল্য ১৬০ টাকা লেখা আছে, তা বর্তমান রেটে ১৯৮ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। যা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯ এর ৪০ ধারার লঙ্ঘন। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে সতর্ক করতে প্রাথমিকভাবে কম জরিমানা করা হয়েছে।

পরে এসব অপরাধ করলে বড় অঙ্কের জরিমানার পাশাপাশি মামলা ও প্রতিষ্ঠান সিলগালা করা হবে বলে জানান ভোক্তা অধিকারের সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল জব্বার মণ্ডল।

এছাড়া চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ভুজপুর থানার বাগান বাজার এলাকায় এক মুদি দোকানির বাড়িতে মিলেছে অবৈধভাবে মজুত করা প্রায় আড়াই টন সয়াবিন তেল। শনিবার দিনগত রাত সাড়ে ১১টার দিকে আকতার হোসেন নামের ওই ব্যবসায়ীর বাড়িতে অভিযান চালান উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এস এম আলমগীর।

এসময় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে অবৈধভাবে তেল মজুত করায় ওই ব্যবসায়ীকে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়া রোববারের মধ্যেই এসব তেল খোলাবাজারে বিক্রির নির্দেশনা দেয়া হয়।

অন্যদিকে মজুতদারদের পক্ষে সাফাই গেয়ে মজুতকে জায়েজ করার চেষ্টা করেছেন দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন।

গত শনিবার খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ে ভ্যাট আদায় বিষয়ে দোকান মালিক সমিতির এক সংবাদ সম্মেলনে চলমান ভোজ্যতেল সংকট নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সয়াবিন তেলের চলমান সংকটের পেছনে ব্যবসায়ীদের মজুতদারির পাশাপাশি সরকারি সংস্থাগুলোর পরিকল্পনার ঘাটতি রয়েছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সবাই তো জানে যে তেলের দাম বাড়বে। 

এই জায়গায় সরকারি সংস্থাগুলোর, বিশেষ করে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের পরিকল্পনায় ঘাটতি ছিল। পরিকল্পনাটা যদি আমাদের সঠিক থাকে। তাহলে এই সংকট হবে না। পরিকল্পনার সমস্যাটা হচ্ছে বাজার বাজারের জায়গায় ছেড়ে দিতে হবে। বাজার তার মতো করে আচরণ করবে। যখন যেই দাম সেই দামে বিক্রি হবে।

এছাড়া ভোজ্যতেলের সংকট শুরুর পর ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অনুরোধে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে গিয়ে তদারকি করে মজুতদারির দুটি যুক্তি খুঁজে পাওয়ার কথা জানান হেলাল উদ্দিন। 

তিনি বলেন, ‘আমি দোকানে দোকানে গিয়েছি। জানতে চেয়েছি যে তেলের সমস্যাটা কোথায়? তারা জানালো যে ডিলাররাই কম পরিমাণ তেল দিয়েছে। লুকিয়ে রেখেছি দুইটা কারণে। যেই ক্রেতাটা গত ১০ বছর ধরে আমার দোকানে কেনাকাটা করেন তাকে তো এই সংকটের সময়ে সয়াবিন তেলটা বুঝিয়ে দিতে হবে। অন্য ক্রেতাদের যদি তেল দিতে না পারি আমি বাকি ১০টা আইটেম বিক্রি করতে পারব না। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।’ 

কিন্তু হেলাল উদ্দিনের এমন যুক্তি মানতে নারাজ সাধারণ ক্রেতারা। দেশের আইনও তার বক্তব্য সমর্থন করে না। কারণ বর্তমানে বিশ্ববাজারে দাম বাড়লেও ব্যবসায়ীরা যে তেল মজুত করেছে তা আগের কেনা। বড় কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে তারা কম দামে কিনেছে। কিন্তু কম দামে কেনা ওই তেলই তারা এখন বাড়তি দামে বিক্রি করছে। 

মতিঝিল এলাকার ক্রেতা সাকিব বলেন, দোকানদাররা কম দামে কিনেছে যা আমাদের কাছে ১৬০ টাকায় বিক্রি করার কথা। কিন্তু এখন বিক্রি করছে ১৯৮ টাকায়। এটা অমানবিক। আইন অনুযায়ীও এটি অপরাধ। তাই সারা দেশে অভিযান পরিচালনা করছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

Link copied!