Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪,

সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে প্রযুক্তির অপব্যবহার ঠেকাতে হবে

মো. আতিকুর রহমান

মো. আতিকুর রহমান

জুলাই ২০, ২০২২, ০৩:৪০ পিএম


সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে প্রযুক্তির অপব্যবহার ঠেকাতে হবে

এক সম্ভাবনাময় দেশের নাম বাংলাদেশ। তরুণদের ইন্টানেটের অবাধ অপব্যবহার, ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন ও সাইবার ক্রাইমের ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে আমাদের সম্ভাবনাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। মা-বাবার অগোচরে অনেকেই সাইবার ক্যাফে বা স্মার্টফোন দিয়ে অপরাধমূকল কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছে। তাদের মন থেকে দিন দিন সম্মানবোধ, বিবেক-বুদ্ধি ইত্যাদি লোপ পাচ্ছে। 

এর কারণেও সমাজে চুরি, ডাকাতি, খুন, আত্মহত্যা, বিবাহবিচ্ছেদ, স্মাগলিং, সন্ত্রাসী, ধর্ষণ, ইভটিজিং ও প্রতারণার মতো ঘৃণ্য অপরাধ ও অপরাধী চক্র উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইদানীং স্মার্ট মোবাইল ফোন ও কম্পিউটারের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফির মারাত্মক বিস্তার ঘটেছে। এ কাজে সবচেয়ে বেশি ব্যবহূত হচ্ছে স্মার্ট মোবাইল ফোন। দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারের বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট আইন বা নির্দেশনা নেই। তাই সাইবার ক্রাইমের শিকার হচ্ছে ১৬ থেকে ২৫ বছরের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের অনেকেই। 

এই আসক্তির ফলে যা হচ্ছে, নিজের সম্পর্কে অতিরিক্ত শেয়ার, যখন-তখন কারণ ছাড়াই ফেসবুকে ঢোকা, প্রোফাইলের ছবিটি নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া, ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় পার করা। এই আসক্তির ফলে যা ঘটে তা আরও ভয়াবহ। 

যেমন— আবেগ-অনুভূতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, হতাশা ও দুশ্চিন্তা পেয়ে বসে, একাকী বোধ হয় ও নিজেকে দোষী ভাবতে শুরু করে আসক্ত ব্যক্তি, কাজের সময় ঠিকঠাক থাকে না, কাজের আগ্রহ হারিয়ে যায়। তারা সাইবার ক্রাইমের ফাঁদে ফেলছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, নারী-পুরুষসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নিরীহ মানুষদের। আবার কৌশলে জিম্মি করে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। এমনকি মানুষের ইজ্জত-সম্ভ্রমও তাদের কারণে নিরাপদ থাকছে না। এসব ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভিকটিম হচ্ছে তরুণীরা।

ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার অপরাধ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সাইবার অপরাধীদের বিরুদ্ধে পাহাড়সমান অভিযোগের কারণে রীতিমতো চাপে আছেন তারা। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, একটি অভিযোগের তদন্ত শেষ করতে না করতেই আরও অভিযোগ জমা হচ্ছে। ফেক আইডি ব্যবহার করার কারণে অপরাধীরা সহজে ধরা না পড়ায় পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হচ্ছে, তাদের বেশিরভাগের বয়স ১৬ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। এমনটি অনাকাঙ্ক্ষিত। বর্তমানে পৃথিবীর ৪৪.২ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহারের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। 

বিটিআরসির হিসাব অনুযায়ী, প্রতি ১২ সেকেন্ডে একটি করে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলা হচ্ছে, যেটা বাংলাদেশের জন্মহারের চেয়েও বেশি। অন্য এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ইন্টারনেট তথ্যভাণ্ডারের প্রায় ২৫ শতাংশই পর্নোগ্রাফি। বর্তমানে ইন্টারনেটে মোট ২০ কোটির অধিক ওয়েবসাইটের মধ্যে পাঁচ কোটি পর্নোগ্রাফি ওয়েবসাইট রয়েছে। এই ভয়ংকর থাবার বিস্তার থেকে আমাদের তরুণ সমাজের মুক্তি রীতিমতো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবাধ তথ্যপ্রযুক্তির যুগে কিশোর, তরুণ ও যুবসমাজের বড় একটি অংশ আশঙ্কাজনকভাবে জড়িয়ে পড়ছে নানা সাইবার ক্রাইমে। সাইবার ক্রাইম থেকে পরবর্তীতে ঘটছে বড় ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। সংবাদমাধ্যমের তথ্যে জানা যায়, অনেক উচ্চ ও মধ্যবিত্তের সন্তান অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেও কিশোর অপরাধীদের সিংহভাগই হচ্ছে দরিদ্র পরিবারের সন্তান। 

অপরাধ বিশ্নেষকদের মতে, দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয় পেটের দায়ে। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা সঙ্গদোষ, লোভ ও অভিভাবকের সঠিক পরিচর্যার অভাবে এবং উচ্চবিত্তের সন্তানরা সার্বিক পরিচর্যা ও যথাযথ নজরদারির অভাব এবং আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে নানা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়। সন্ত্রাসী গডফাদাররা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের মাধ্যমে কিশোরদের দ্বারাই মূলত বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ সংঘটিত করছে। আন্ডারওয়ার্ল্ডের ভয়ংকর সন্ত্রাসীরা এদের নিয়ন্ত্রণ করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এদের গ্রেপ্তার করতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে দু-একদল ধরা পড়লেও অধিকাংশই থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সামাজিক অস্থিরতাসহ নানা কারণে শিশু-কিশোররা সন্ত্রাসী গডফাদারদের স্বার্থের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। 

তাছাড়া সমাজ পরিচালনা শক্তির অসহযোগিতা, উদাসীনতা এবং নিষ্ক্রিক্রয়তা, দারিদ্র্যের বিস্তার, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব ও হতাশা প্রভৃতি শিশু-কিশোরদের অপরাধের পথে ঠেলে দিচ্ছে। সাইবার ক্রাইম একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। এ সমস্যা প্রতিরোধের জন্য জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি আলাদা কমিশন গঠন করতে পদক্ষেপ নিতে হবে এবং প্রতিরোধের জন্য সর্বপ্রথম অ্যান্টিভাইরাস কোম্পানিগুলোকে আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। কারণ তাদের পৃষ্ঠপোষকতায়ই এসব হচ্ছে। তাদের দমন করলে সাইবার অপরাধ অনেকাংশে কমে যাবে। এ ছাড়া সাইবার অপরাধ দমনের জন্য যুগোপযোগী আইন ও শক্ত নীতিমালা প্রয়োজন।

প্রয়োজন আরও ব্যাপক হারে সাইবার বা ভার্চুয়াল পুলিশ বাড়ানো এবং দেশব্যাপী কঠোর মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। হ্যাকিংকে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে কঠোর হস্তে দমন করা; পর্নো সাইট একেবারেই বন্ধ করে দেয়া। পর্নো সাইট তৈরিকারকদের কঠোর আইনের আওতায় আনা জরুরি। বন্ধ করে দিতে হবে সংশ্নিষ্ট ওয়েবসাইটগুলোর আইপি অ্যাড্রেস। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ইন্টারনেট ব্যবহার জরুরি। তবে অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হবে তার আদরের সন্তান কোন কোন সাইট ব্রাউজ করছে। সঙ্গে সঙ্গে সে কোথায় যাচ্ছে, মূল্যবান সময় কোথায় ব্যয় করছে, কী করছে, কখন ফিরছে ইত্যাদি। অভিভাবকদের শিশুকাল থেকে সন্তানদের ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা এবং সুষ্ঠু বিনোদনে অভ্যন্ত করতে হবে। 

বিশেষ করে, সামাজিকভাবে সচেতনতার অভাব, পরিবারের উদাসীনতা, সুফল-কুফল বিচার-বিবেচনা না করেই প্রযুক্তির ব্যবহার, সঙ্গদোষ, আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবই মূলত সাইবার ক্রাইম সংঘটনের মূল কারণ। সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার ও অপরাধ ঠেকাতে ইতোমধ্যে ‘সাইবার নিরাপত্তা হেল্পলাইন’ চালু করা হয়েছে। সপ্তাহের সাত দিন সাইবার নিরাপত্তা (০১৭৬৬৬৭৮৮৮৮) হেল্পলাইনে ২৪ ঘণ্টা ফোন করে সাইবার সংশ্নিষ্ট হয়রানির অভিযোগ দায়েরের পথ খোলা হয়েছে। 

এছাড়া সাইবার ক্রাইম সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে প্রত্যেক জেলায় ‘সাইবার ক্রাইম কন্ট্রোল কমিটি’ গঠন করা হচ্ছে। সাইবার অপরাধ-সংক্রান্ত সব অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করতে প্রতিটি থানাকে পুলিশ সদর দপ্তরগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে। যদিও সরকার, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) মাধ্যমে লেভারেজিং গ্রোথ, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এলআইসিটি) প্রকল্পের আওতায় সাইবার নিরাপত্তায় প্রশিক্ষিত দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার লক্ষ্যে উন্নত প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছে, এটি ইতিবাচক দিক বলে মনে করি। 

আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের অস্তিত্ত্বকে হুমকির মধ্যে ফেলে দেয়ার আগেই আমাদের দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দেশ ও তথা সমাজ থেকে সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অবস্থান থেকে সমস্যা সমাধানে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ ও তার দ্রুত বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় উল্লিখিত সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধানে সচেষ্ট হতে হবে। সেইসঙ্গে সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে সোশ্যাল মিডিয়া ও স্মার্ট ফোনকে রাখতে হবে ১৬-২৫ বছর বয়সি তরুণদের নাগালের বাইরে। এ বিষয়ে পরিবারসহ সংশ্লিষ্টদের সদিচ্ছা একান্তভাবে কাম্য। 

লেখক : কলাম লেখক

Link copied!