Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

পাড়ার মুদি দোকানও এখন ব্যাংকের শাখা

ড. যশোদা জীবন দেবনাথ

ড. যশোদা জীবন দেবনাথ

ডিসেম্বর ১, ২০২২, ১২:৫৯ পিএম


পাড়ার মুদি দোকানও এখন ব্যাংকের শাখা

১৬ কোটির বেশি মানুষের দেশ বাংলাদেশ। নানা সংকট পেরিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রায় সব জায়গায় প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে। প্রযুক্তি উন্নয়নের সাথে সাথে ব্যাংকিং এখন হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। এক প্রকার আলাদিনের আশ্চর্য চেরাগের মতো। দেশের ব্যাংকিং খাতে যুক্ত হয়েছে অনলাইন ব্যাংকিং, এটিএম কার্ড, সিআরএম ইন্টারনেট ব্যাংকিং, ক্যাশ ডেপোজিট মেশিন, মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ও বিভিন্ন অ্যাপভিত্তিক ব্যাংকিং সেবা। প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পৌঁছে গেছে ব্যাংকের শাখা, উপশাখা ও এজেন্সি। পাড়ার মুদি দোনানটিও এখন ব্যাংকের শাখায় পরিণত হয়েছে। হিসাব খোলা ও বন্ধ করা যায় ঘরে বসেই। ব্যাংকের বিনিয়োগ পাওয়াও এখন অনেক সহজ। পণ্য ও সেবা ক্রয়ের ক্ষেত্রেও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের দিয়ে যাচ্ছে। বলতে গেলে ব্যাংকিং এখন আর শুধু আমানত আর বিনিয়োগের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ব্যাংকগুলো পরিণত হয়েছে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বহুমাত্রিক সেবা প্রতিষ্ঠানে। ব্যাংকগুলো বর্তমানে ইউটিলিটি বিলসহ অটোমেটেড চালান সিস্টেমের মাধ্যমে সরকারি ১৬০ প্রকারের সেবার বিল সংগ্রহ করে মানুষের জীবন সহজকরণে অকল্পনীয় অগ্রগতি সাধন করেছে।

গত এক দশকে ব্যাংকিং খাত নজিরবিহীন আধুনিকায়ন হয়েছে। মানুষ উন্নত ব্যাংকিংসেবা পাচ্ছে। যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বড় চালিকাশক্তি হলো ব্যাংকিং খাত। অর্থ গচ্ছিত রাখা, অর্থ লেনদেন করা, বিভিন্ন ধরনের ঋণসেবা প্রদান, দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ নিশ্চিত করা, এসএমইর উন্নয়নসহ নানাবিধ কার্যক্রমে ব্যাংকিং খাত সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে ই-ব্যাংকিং ব্যবস্থা দিনদিন প্রত্যাশিত সফলতা পাচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী ব্যবসায়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য বাংলাদেশের বর্তমান ব্যাংকিং ব্যবস্থার দ্রুত পরিবর্তন এবং অভিযোজন প্রয়োজন ছিল। বর্তমান প্রযুক্তির যুগে এ ধারায় যোগ দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। অন্যথায় দেশের জন্য যেকোনো ফলপ্রসূ কীর্তি আনা প্রায় অসম্ভব। কেননা ব্যাংকিং খাতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশের শিল্প-কারখানা, উন্নয়ন, আমদানি-রপ্তানি, সাধারণ মানুষের জীবন ধারণের নানা পথ। তাই এ খাতকে সমুন্নত করতে ব্যাংকিং খাতের আধুনিকায়নের কোনো বিকল্প নেই।

তাই যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ অনলাইন ব্যাংক সেবা প্রযুক্তিতে অনেকটা উন্নতি করেছে। বর্তমানে আইসিটির বদৌলতে ব্যাংকিং খাতে নতুন নতুন অনেক গ্রাহকসেবা যোগ হয়েছে, বেড়েছে কর্মদক্ষতা, কর্মসংস্থান। বেসরকারি ব্যাংকগুলো সফলতা দেখালেও সে তুলনায় দেশের বিশেষায়িত সরকারি ব্যাংক অনলাইন ব্যাংকিংয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এ অবস্থায় প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাংকিং পদ্ধতি নীতিমালায় পরিবর্তন আনা জরুরি। না হলে তথ্যপ্রযুক্তির অপার সম্ভাবনাময় যুগে অনলাইন ব্যাংকিং সেক্টরে দেশ ও সরকার অনেক পিছিয়ে থাকবে, যা বিশ্বায়নে দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়।

ব্যাংক একটি মুনাফাভোগী আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ব্যাংক যুগ যুগ ধরে গ্রাহকদের আস্থা ও সুষ্ঠু সেবা নিশ্চিত করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়েছে ব্যাংকের গ্রাহকসেবার মান। একবিংশ শতাব্দীর এ যুগে তথ্য প্রযুক্তির ক্রমাগত উন্নতিতে গ্রাহকের সেবায় একটি নতুন উন্নত মাত্রা যোগ করেছে ‘অনলাইন ব্যাংকিং’। 

তবে তথ্যপ্রযুক্তির আগমনে সারা বিশ্বে অনলাইন ব্যাংকিং উন্নত গ্রাহকের সেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এর তেমন একটা ব্যাপকতা লক্ষ করা যায় না। তবে দ্রুত গতিতে এটা সম্প্রসারিত হচ্ছে। বলা যায়, বেশির ভাগই অপরিচিত এই অনলাইন ব্যাংকিংয়ের সুবিধা ও অসুবিধা সম্পর্কে। প্রচার প্রচারনায় সেটাও কাটিয়ে উঠছে। 

১৯৯০ সালে অনলাইন ব্যাংকিং সিস্টেমটি চালু হওয়ার মাত্র বছর খানেকের মধ্যেই এই ব্যাংকিং সিস্টেমটি সারা বিশ্বে ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও সাড়া ফেলতে থাকে। এখন ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের সব দেশেই বড় বড় ব্যাংকগুলো উন্নত গ্রাহকসেবায় এবং সেবার মান বৃদ্ধিতে চালু করছে অনলাইন ব্যাংকিং সিস্টেম। বিশ্বায়নের যুগে তথ্যপ্রযুক্তির অপার এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অনলাইন ব্যাংকিং গ্রাহকদের কষ্ট এবং ঝুঁকি এড়ানোর জন্য নানাবিধ সুবিধা প্রদান করছে।

উল্লেখযোগ্য কিছু সুবিধা যেমন— অনলাইন ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অর্থ স্থানান্তরে ব্যাংক নির্দিষ্ট চার্জের বিনিময়ে অতি দ্রুত ও নিরাপদে গ্রাহকের টাকা গ্রহণ করে এবং গ্রাহকের ইচ্ছানুযায়ী তা অন্য শাখায় নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রেরণ করে থাকে। কোনো প্রকার চেক না লিখেই অনলাইনে বিভিন্ন ধরনের বিল পরিশোধ করা যায়। অ্যাকাউন্ট সর্তকতা ও অনুস্মারক সেটআপ করে প্রতিটি লেনদেনের আপডেট জানা যায়। গ্রহণকৃত সব চেকের ছবি ও ট্রানজেকশন হিস্টরি দেখা যায়। কেনাকাটার বিল অনলাইন মারফত পরিশোধ করা যায়। অনেক ব্যাংক অনলাইনে ঋণ গ্রহণ ও ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের সুবিধাও দিয়ে থাকে।

এছাড়া বিভিন্ন ধরনের সুবিধা অনলাইন ব্যাংকিং সিস্টেম গ্রাহকদের প্রদান করে থাকে। তবে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে উন্নত দেশের ব্যাংকিং লেনদেন অনলাইননির্ভর হলেও তুলনায় বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। দেশের মধ্যে বিদেশি ব্যাংকগুলোর শত ভাগ শাখা অনলাইনে। সরকারি ব্যাংকগুলো ৯৯ শতাংশ, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ৯৭ শতাংশ ও বিশেষায়িত সরকারি ব্যাংকগুলোর ২৫ শতাংশ শাখা অনলাইনে। অনলাইনের আওতায় সব থেকে বেশি গ্রাহকসেবা দিয়ে থাকে প্রাইভেট ব্যংকগুলো। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যাংক হলো, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ইবিএল, শাহজালাল ব্যাংক, এবি ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, সাউথ ইস্ট ব্যাংক ইত্যাদি।

শুধু অনলাইন বা ই-ব্যাংকিং সেবায় গত বছরের ডিসেম্বরে গ্রাহক ছিল ২০ লাখ ৪০ হাজার। ঐ এক মাসে লেনদেন হয়েছিল ২ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা। এক কোটি ৫৪ লাখ ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডে গত ডিসেম্বরে লেনদেন হয়েছে ১৩ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। সারাদেশে এটিএম বুথ রয়েছে ১০ হাজার ৩৫৫টি। কেনাকাটার জন্য পয়েন্ট অব সেলস রয়েছে ৪৫ হাজার ৮৯৬টি। দেশের ১০ হাজার ১০৯ শাখার মধ্যে ৮ হাজার ৮৯৯ ব্যাংক শাখাই অনলাইনের আওতায়। 

বর্তমানে দেশে সব মিলিয়ে ৫৯টি ব্যাংক কার্যক্রমে আছে। এর মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি ব্যাংক ছাড়া সব ব্যাংকই অনলাইন ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। এর মধ্যে কেউ দিচ্ছে পুরোপুরি ব্যাংকিং সেবা, কেউ-বা অল্প কিছু সেবা। এক বছর আগের তুলনায় গত জুলাইয়ে ইন্টারনেট ব্যাংকিং লেনদেন প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে ২৩ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে এ তথ্য দেখা গেছে। দেশের অনেকেই এখন বিভিন্ন আর্থিক সেবা পেতে কম্পিউটার ও মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করছে। ২০২১ সালের জুলাইয়ে ইন্টারনেট ব্যাংকিং লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১২ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা। তবে জুলাইয়ের ইন্টারনেট ব্যাংকিং লেনদেনের পরিমাণ জুনের ২৩ হাজার ৭৭০ কোটি টাকার চেয়ে কিছুটা কম ছিল বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে। ইন্টারনেট ব্যাংকিং সাধারণত অনলাইন ব্যাংকিং নামে অধিক পরিচিত।

এর মাধ্যমে গ্রাহকরা আর্থিক লেনদেন ও বিল পেমেন্টসহ নানা ধরনের পরিষেবা সহজেই পান। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ২ দশক আগে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যাংকিং চালু করে। তখন থেকেই দ্রুত গতিতে এটি দেশব্যাপী বহুল প্রচলিত হতে শুরু করে। মূলত করোনাভাইরাস মহামারির কারণে অনলাইন ব্যাংকিংয়ের ব্যবহার বিপুল পরিমাণে বেড়েছে। কারণ এর মাধ্যমে বাইরে যাওয়ার ঝুঁকি এড়িয়ে গ্রাহকরা ঘরে বসে সহজেই কাজ সারতে পারেন। গ্রাহকরা ইন্টারনেট ব্যাংকিং ব্যবহার করেই আর্থিক লেনদেন করতে আগ্রহী হওয়ায় চলতি বছরের জুলাইয়ে গত বছরের চেয়ে গ্রাহক সংখ্যা ৪৩ শতাংশেরও বেশি বেড়ে ৫৪ লাখ ৭২ হাজারে দাঁড়িয়েছে।

গত বছরের জুলাইয়ে ইন্টারনেট ব্যাংকিং ব্যবহার করা গ্রাহকের সংখ্যা ছিল ৩৮ লাখ ২২ হাজার। আর চলতি বছরের জুনে এ সংখ্যা ছিল ৫৩ লাখ ৫৫ হাজার। স্বাধীনতা-পরবর্তীতে সামাজিক ন্যায়বিচার ও প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিয়ে ব্যাংকিং নীতিমালা ঢেলে সাজানো হয় এবং সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় ব্যাংকিং সেবা পৌঁছানোর জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাংকের শাখা স্থাপন করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দক্ষ দিকনির্দেশনা ও নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে।

একসময় এ দেশে মানুষের মধ্যে ব্যাংকবিমুখতা ছিল। মানুষ মাটির কলসিতে, বাঁশের খুঁটির মধ্যে, মাটির ব্যাংকে ও বালিশের ভেতরে তাদের টাকা-পয়সা ও সম্পদ লুকিয়ে রাখত। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী ব্যাংকিং সেবা উন্নয়ন, সংস্কার ও বিস্তারের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ এখন ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করছে অবলীলায়।  ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশি-বিদেশি মিলে ১৪টি ব্যাংকের মোট শাখার সংখ্যা ছিল এক হাজার ১৬৯টি। বর্তমানে দেশে মোট ৬১টি তফসিলি ব্যাংকের শাখার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৮১২টি।

এছাড়া উপশাখা ও এজেন্ট ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক বিস্তারের মাধ্যমে বর্তমান বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামেও পৌঁছে গেছে আধুনিক ব্যাংকিং সেবা। দেশে ব্যাংকিং খাত বড় ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো থেকে বড় ধরনের দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে হলমার্ক ও বিসমিল্লাহ গ্রুপের মতো অনেকগুলো ঘটনা রয়েছে। এ সংকট উত্তরণে সময়োচিত ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে। সব ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদ এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে পরিপালনের সংস্কৃতি লালন করতে হবে।

পরিশেষে বলা যায়, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের সাথে ব্যাংকিং খাত অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ব্যাংকিং খাত উন্নত হলে দেশের সুষম উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। জনগণের দোরগোড়ায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের সুফল পৌঁছে দিতে ব্যাংকিং খাতকে ভালোভাবে সাজাতে ও একে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ব্যাংকার ও গ্রাহক উভয়ের মধ্যে ব্যাংকিংয়ের সব বিধিমালা পরিপালনের সংস্কৃতি লালনের পাশাপাশি সততা, আমানতদারি, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার বিকাশ ঘটাতে পারলে দেশের ব্যাংকিং খাতের অগ্রগতি আরও ত্বরান্বিত হবে বলে আশা করা যায়।

লেখক : পরিচালক বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক

Link copied!