Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪,

ম্যাজিক বুলেটের আঘাতে আপনিও কি আহত?

আব্দুল্লাহ আল নোমান

আব্দুল্লাহ আল নোমান

ডিসেম্বর ৭, ২০২৩, ০৭:৫৮ পিএম


ম্যাজিক বুলেটের আঘাতে আপনিও কি আহত?

সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এখন ‍‍`চিলে কান নিয়ে গেছে, কান না খুঁজে সবাই চিলের পেছনে দৌড়ানো‍‍` উক্তিটির মত খবরই বেশি রটে। কোন ভিডিও বা তথ্যের সত্যতা যাচাই-বাছাই না করে, তা ছড়িয়ে দেওয়া এবং তা নিয়ে নানান মন্তব্যে নিয়মিত তুলকালাম কাণ্ড ঘটে সোশ্যাল মিডিয়ায়।

আমরা শিক্ষিত হওয়া তথা প্রযুক্তির ব্যবহারের মত জ্ঞান না থাকার অভাবে এমনটি হচ্ছে বলে মনে করছেন সমাজবিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন দেশ ব্যাপী প্রযুক্তির সয়লাভ হলেও প্রযুক্তির উপকরণ গুলো ব্যবহারের নিয়ম বা সুফল-কুফল নিয়ে তেমন ধারণা নেই দেশের মানুষের। তাইতো কোনটি সত্য আর কোনটি মিথ্যা সেটির সত্যতা যাচাই-বাছাই না করে হরহামেশাই প্রচারসহ নানান মন্তব্য করছেন দেশের নেটিজেনরা।

শুধু সোশ্যাল মিডিয়া নয়, বর্তমানে কিছু গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ার কিছু আলোচিত ইস্যুকে কেন্দ্র করে তথ্যের সত্যতা যাচাই-বাছাই না করে সংবাদ প্রচার করছে। সে সব সংবাদে নেই কোন বিশেষজ্ঞের মতামত কিংবা তথ্যসূত্রের  মাত্রা। তাহলে কেন করছে এমন ভিত্তিহীন সংবাদ?

ইংরেজিতে খুব পরিচিত একটি প্রবাদ আছে, "Whoever Controls the media, Controls the mind" অর্থাৎ যে মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করে, সে মানুষের মন নিয়ন্ত্রণ করে। এবার হয়তো কিছুটা বুঝতে পারছেন আমি আসলে কি নিয়ে আলোচনা করতে চলছি।

সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র হিসেবে একটি তত্ত্বের সাথে বেশ পরিচিত। যদিও এটি নিয়ে অনেকের অনেক রকম মন্তব্য রয়েছে। তবে আমি তাদের মতামতকেও সম্মান জানাচ্ছি।

আমেরিকান রাজনৈতিক বিজ্ঞানী এবং  যোগাযোগ তত্ত্ববিদ হ্যারল্ড ডোয়াইট ল্যাসওয়েল ১৯২৭ সালে "ম্যাজিক বুলেট" নামে একটি তত্ত্ব প্রণয়ন করেন।

তত্ত্বটিতে বলা হয়েছে, ‘মিডিয়ার এমন একটি ক্ষমতা রয়েছে যা সমাজে বুলেটের মতো কাজ করে। মিডিয়া যা বলবে, সমাজ, সমাজের মানুষ সেভাবেই কাজ করবে।’

এখানে দু’টি শব্দ- একটি ‘ম্যাজিক’, অন্যটি ‘বুলেট’। দু’টি শব্দই কিন্তু নিজ ক্ষমতা ও কার্যকারিতায় শক্তিশালী। জাদুর শক্তি দিয়ে যেমন যেকোনো কিছু পাল্টে ফেলা যায়, ঠিক তেমনটি ঘটলে আমরা বলি… ‘বাহ যাদুর মতো কাজ করেছে’। আর বুলেট যেমন ছুটে এসে দ্রুত আঘাত করে, তেমন কিছু ঘটলে আমরা বলি, ‘বাহ! বুলেটের মতো কাজ হয়েছে’।

হ্যারল্ড ল্যাসওয়েল মিডিয়ার ক্ষমতাকে এমনভাবে দেখেছেন যে, তার প্রকাশে এ দু’টি শক্তিশালী শব্দকে একসঙ্গে ব্যবহার করছেন। তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, ‘মিডিয়া’ নামের ‘বন্দুক’ থেকে যখন গুলি বের হয়, তখন তা সরাসরি দর্শক, পাঠক শ্রোতার ‘মস্তিষ্কে’ আঘাত করে।

এটিকে ‘হাইপোডারমিক নিডল’ মডেলও বলা হয়। অর্থাৎ বলা হয়, ‘মিডিয়ার কোনো বার্তা তার দর্শকের মস্তিষ্কে সরাসরি ইনজেকশনের মত পুশ করে দেয়। তখন মিডিয়া যেভাবে চায়, পাঠক-দর্শক সেভাবেই আচরণ করে।’

তত্ত্বটি সাথে আমি ব্যক্তিগতভাবে একমত পোষণ করি। গত বেশ কয়েকদিন ধরে পর্যবেক্ষন করছি যে, কিছু সংখ্যক মিডিয়া আলোচিত ইস্যুতে পাঠক ধরে রাখতে গিয়ে এক জঘণ্যতম খেলায় মেতে উঠেছে। আর তার ফলে এথিক্সের জায়গাটি ধ্বংস হচ্ছে। কারণ মিডিয়া যা আমাদের সামনে আনছে আমরা পাঠক তাতেই বিশ্বাস রাখি। কারণ আমরা মনেকরি তথ্যটি একজন সংবাদকর্মী ভালো করেই যাচাই করেছেন।

সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় একজন শিক্ষকের "তিরিং তিরিং সাইকেল চালায়" সহ বেশ কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়। সবাই নতুন কারিকুলামে সংযুক্ত পাঠ্যক্রমের জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ বলে বেশ জোরসে প্রচার চালিয়ে ছিলেন৷

অথচ রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায় ভারতের আসাম রাজ্যের রতন লাল শাহ নামের একজন শিক্ষক ২০২০ সালে ভিডিওটি করেছিলেন। তখন সেটি ভারতে ভাইরাল হয়েছিলো। অথচ সে ভিডিওকে বাংলাদেশের বলে চালিয়ে দেওয়ার পর আমরা হরহামেশাই এটিকে শেয়ার সহ নানান মন্তব্য শুরু করি।

শুধু তাই নয়, এই রকম একাধিক ভিডিও স্যোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে, যে ভিডিও গুলোর কোন সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া যায় নি।  অর্থাৎ যে যার মত পারছেন ভিত্তহীন ভাবে প্রচার করছেন। এখানে অনেক শিক্ষক, ডাক্তার, ধর্মীয় বক্তাসহ অনেক উচ্চ শিক্ষিত লোকজনকেও দেখছি এসব বাচবিচার না করে ঢালাও ভাবে প্রচার করতে।

আর একটি উদাহরণ টেনে লেখাটি শেষ করবো। গত কিছুদিন আগে News ABC নামে একটি ফেসবুক পেইজে একজন ইউটিউবার ড্রাগন ফল নিয়ে একটি ভিডিও আপলোড দেয়। ড্রাগন আগে ছোট ছিলো, এখন এত বড়। টনিক রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে এমন হচ্ছে। সে ভিডিওতে ওই ইউটিউবার ড্রাগন ফলে টনিক রাসায়নিক ডিএনএ (DNA) পরিবর্তন করে দিতে পারেও বলে উল্লেখ করে। যেখানে কিছু তথ্য এক রকম ভিত্তিহীন। এর পর থেকে কিছু গণমাধ্যমসহ ইউটিউবারেরা নেমে গেছে ড্রাগন ফল নিয়ে কনটেন্ট তৈরিতে। তৈরিকৃত বেশিরভাগ ভিডিও পর্যালোচনা করে দেখি...তেমন কোন তথ্য উপাত্ত ছাড়াই তারা ভিডিও বানাচ্ছে। আর আমরা তা হরহামেশাই গিলছি। ড্রাগনের বাজারে ধস্ নেমেছে।

আমার কথা হলো, বাজারে এখন বেশিরভাগ ফলই হাইব্রিড জাতের। পেয়ারা, তরমুজ, পেপেসহ ইত্যাদি। আর হাইব্রিড জাতের প্রত্যেকটি ফলে নানান কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। তাহলে শুধু ড্রাগন নয় বাজারের সব ফলই বর্জন করতে হবে। কেন শুধু ড্রাগনের পিছে ছুটলাম?

শুরুতে যে ম্যাজিক বুলেট তত্ত্বের কথা আমি বলছি সে তত্বমতে গণমাধ্যম বা মিডিয়া খুব দ্রুত আমাদের মস্তিষ্ককে এক রকম হ্যাক করছে। ফলে মিডিয়া বা সোশ্যাল মিডিয়ার কোন তথ্য যাচাই-বাছাই না করে তার সাথে একমত পোষণ করছি এবং ছড়ানো সে সব তথ্য প্রচার করছি।

তাই এখন আমার প্রশ্ন, ম্যাজিক বুলেট তত্ত্ব আপনার ক্ষেত্রেও কাজ করছে না তো? আপনিও কি এই বুলেটের আঘাতে আহত হয়ে পড়ছেন না তো?

আসুন, নিজে সচেতন হই, আর অন্যকেও সচেতন করি। সোশ্যাল মিডিয়ার মিথ্যা প্রোপাগাণ্ডা থেকে দূরে থাকি।

শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মী

Link copied!