Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ

হুমকির মুখে দেশের অর্থনীতি

মো. মাসুম বিল্লাহ

মে ৮, ২০২২, ০১:৪৬ এএম


হুমকির মুখে দেশের অর্থনীতি

রাশিয়ার ইউক্রেন হামলার মধ্য দিয়েই এক নতুন সংকটে পদার্পণ করে বিশ্ব। খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি তেলসহ জরুরি পণ্যের দাম বিশ্ববাজারে বাড়তে থাকে হু হু করে। সংকটের আশঙ্কায় অনেক দেশ পণ্য রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। ফলে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে অবস্থান করেও বাংলাদেশসহ বিশ্বের কোনো দেশই এই যুদ্ধের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। 

বাংলাদেশের সাথে রাশিয়া বা ইউক্রেনের আমদানি-রপ্তানি অংকের বিচারে খুবই কম। কিন্তু হামলার পরপরই দেশের বাজারে তেল, গমসহ অন্যান্য খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। এখানেই শেষ নয়, দেশের অর্থনীতিতে এই যুদ্ধের আরও কঠিন প্রভাব পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। 

দেশজ উৎপাদন ও রপ্তানি আয় কমে যেতে পারে, খাদ্যদ্রব্য ও জ্বালানির দামের পাশাপাশি মুদ্রাস্ফীতি অনেক বেড়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অনেকগুলো প্রকল্পে কাজ করছে রাশিয়া। যুদ্ধ শুরুর পর একাধারে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থনীতিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন। 

অথচ রাশিয়া হলো ইউরোপের সবচেয়ে বড় গ্যাস ও তেল সরবরাহকারী দেশ। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম জ্বালানি তেল উৎপাদনকারী দেশ। তা ছাড়া গম ও তুলার সবচেয়ে বড় উৎপাদক ও রপ্তানিকারকও রাশিয়া। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ গম ও তুলা সরবরাহ করে দেশটি।

এই যুদ্ধের আগে রাশিয়া ও ইউক্রেনের সাথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে উন্নতির দিকে যাচ্ছিল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের বড় ক্রেতা ছিল দেশটি। ধীরে ধীরে বাড়ছিল রপ্তানির পরিমাণ। পক্ষান্তরে রাশিয়া থেকে গম, সার, স্টিল ও অ্যালুমিনিয়াম আমদানি করে বাংলাদেশ। যদিও অর্থের বিচারে আমদানির চেয়ে রপ্তানির পরিমাণ বেশি বাংলাদেশের। 

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ায় রপ্তানি হয়েছে ৬৬ কোটি ৫৩ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য। যার ৮৫ শতাংশ তৈরি পোশাক। এ সময়ে রাশিয়া থেকে আমদানি করা হয়েছে ৪৬ কোটি ৬৭ লাখ ডলারের পণ্য। অপরদিকে ইউক্রেন গম আমদানির বিপরীতে রপ্তানি করা হয় তৈরি পোশাক। তবে এর পরিমাণ অতি নগণ্য।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এই দুই দেশের যুদ্ধে বাংলাদেশ ঝুঁকিমুক্ত রয়েছে। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের সবচেয়ে বড় ক্রেতা ইউরোপ। নিষেধাজ্ঞার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে রাশিয়া  ইউরোপের দুটি দেশে ইতোমধ্যে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে চলতি বছরের জানুয়ারির তুলনায় গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ১৫৩ শতাংশের বেশি। সর্বোচ্চ ১৭২ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে গত ১৮ এপ্রিল। 

ইউরোপের একটি বড় অংশ অচল হয়ে যাবে যদি রাশিয়া গ্যাস ও তেলের সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এতে ইউরোপের অধিকাংশ কল-কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অনেক কমে যাবে। বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতের অর্ধেকের বেশি বা ৬৪ শতাংশ তৈরি পোশাক রপ্তানি হয় ইউরোপে। ফলে বাংলাদেশে দেয়া তাদের ক্রয়াদেশের পরিমাণ কমে যেতে পারে, এমনকি বাতিলও হতে পারে। এদিকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে রাশিয়ার অর্থায়ন বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। 

কেননা, আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং চ্যানেল সুইফট ব্যবহারে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। সুইফট হচ্ছে বিশ্বের ২০০টি দেশে ব্যবহূত একটি আন্তর্জাতিক পেমেন্ট ম্যাসেজিং সিস্টেম, যা কোনো আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনের তথ্য ওই অর্থের প্রেরক এবং প্রাপককে বার্তা বা মেসেজের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়। এ ছাড়াও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সেই সমমনা দেশগুলো রাশিয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক অ্যাকাউন্টগুলোও জব্দ করে দেয়। সুইফটের দেখাদেখি ভিসা এবং মাস্টারকার্ডও রাশিয়ান অর্থনৈতিক লেনদেন করা বন্ধ করে দেয়। এর ফলে রাশিয়ার অর্থায়নে নির্মাণাধীন দেশীয় প্রকল্পের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। 

তাছাড়া আকাশপথে নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় এশিয়া থেকে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশের খরচ অনেক বেড়ে যেতে পারে। অর্থনীতি বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সুইফট থেকে রাশিয়া বিচ্ছিন্ন করার পদক্ষেপ রাশিয়ার সাথে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য প্রায় অসম্ভব করে তুলবে। যুক্তরাষ্ট্র আরো কঠিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিতে যাচ্ছে। তার মানে হলে, খুব কম দেশের পক্ষেই এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে আন্তর্জাতিক লেনদেন করতে পারবে। তা করতে গেলে সে দেশও নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তে পারে।

এদিকে দেশের কৃষি খাতের উপরও নেমে আসতে পারে নেতিবাচক প্রভাব। কারণ রাশিয়া ও বেলারুশ বিশ্বের সবচেয়ে বড় পটাশ সার সরবরাহকারী দেশ। এখন বাংলাদেশে এই সারের সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে এর প্রভাব পড়বে আগামী মওসুমে। ফলে বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদনের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে বাড়তে পারে খাদ্যদ্রব্যের দাম। তাছাড়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় গম সরবরাহকারী দেশ ইউক্রেন ও রাশিয়া।

 এই দুই দেশের যুদ্ধের পর বিশ্বের অন্য গম সরবরাহকারী দেশগুলো দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রতি টন গম আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কিনেছিল ৩৩৪ দশমিক ৫০ ডলারে। কিন্তু বর্তমানে প্রতি টন প্রায় ৪০০ ডলারে পৌঁছেছে। আবার জ্বালানি ও ভোজ্যতেলেও পড়েছে প্রভাব। 

যদিও সৌদি আরব, আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্র তেলের উৎপাদন বাড়িয়ে দাম কমানোর একটা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটা সম্ভব নাও হতে পারে। করোনার আগে আন্তর্জাতিক বাজারে যেখানে প্রতি ব্যারেল ব্রেন্ট অপরিশোধিত তেল ছিল ৫০ ডলার, ২০২২ সালের মার্চে সেটি ১৩৯ ডলার স্পর্শ করে। সে সময় অর্থনীতিবিদরা ধারণা করেছিলেন এটি ২০০ ডলার পর্যন্ত যেতে পারে। 

কিন্তু আশার কথা হলো, এই ধারণা সঠিক প্রমাণিত হয়নি। তবে এর পেছনেও কিছু কারণ আছে। ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি তেলের বড় ক্রেতা চীনে করোনার নতুন প্রকোপ দেখা দেয়ায় সেখানে লকডাউনের কারণে কমে গেছে চাহিদা। ফলে বিশ্ব বাজারে তেলের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে।

অপরদিকে প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে দেশে। এর মধ্যে দেশেই উৎপাদন হয় দুই থেকে তিন লাখ টন। আর বাকিটা আমদানি থেকে। অর্থাৎ চাহিদার ৯০ শতাংশ আমদানি থেকে পূরণ করা হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে গত জানুয়ারিতে সয়াবিন তেলের দাম ছিল এক হাজার ৪৭০ ডলার প্রতি টন, যা ফেব্রুয়ারিতে এসে দাঁড়ায় এক হাজার ৫৯৬ ডলার। 

অন্যদিকে পাম ওয়েলের সবচেয়ে বড় উৎপাদক ইন্দোনেশিয়া পাম ওয়েল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় বিশ্বব্যাপী পাম ওয়েলের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। জানুয়ারিতে প্রতি টন পাম ওয়েলের দাম যেখানে ছিল এক হাজার ৩৪৫ ডলার, ফেব্রুয়ারিতে সেটি এক হাজার ৫২২ ডলারে দাঁড়ায়। এদিকে যুদ্ধকে পুঁজি করে তেলের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়েছে একটি চক্র। ফলে পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের কন্টেইনারের দাম ৭৪০-৭৫০ টাকা থেকে ৮২০-৮৩০ টাকা পর্যন্ত উঠে। এক পর্যায়ে খোলা তেলের দাম বোতলজাত তেলের থেকে বেশি হয়ে যায়। 

এদিকে বিশ্ববাজারে তেল-গ্যাসের সরবরাহ ব্যাহত হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন। দাম বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় আরও বেড়ে যাবে। এমনিতেই বাংলাদেশ রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি করে। এর মধ্যে এমন দাম বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বর্তমানে ৪৪ বিলিয়ন ডলার, কয়েকমাস আগেও যেটা ৪৯ বিলিয়ন ডলার ছিল। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির ফলে আমদানি ব্যয় বেড়ে গিয়ে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য আরও কমবে। 

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বাংলাদেশে কেমন প্রভাব ফেলবে এবং সম্ভাব্য ক্ষতি এড়ানোর উপায় নিয়ে কথা হয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হানের সাথে। 

তিনি দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, ‘এই যুদ্ধের প্রভাব থেকে কোনোভাবেই মুক্ত থাকা সম্ভব নয়। ইতোমধ্যে এটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। আমাদের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় ক্রেতা ইউরোপে রাশিয়ার পক্ষ থেকে তেল ও গ্যাস সরবরাহের নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এতে ইউরোপের ক্রয়সক্ষমতা কমবে। ফলে আমাদের রপ্তানি হারও অনেকাংশে কমে যাবে। 

তা ছাড়া কৃষি সরঞ্জামের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় তা আমাদের খাদ্যমূল্যে প্রভাব ফেলবে। তাই এই মুহূর্তে আমাদের হাইব্রিড কৃষিকাজে ব্যাপক সহায়তা করতে হবে, কারণ আমাদের আবাদি জমি কম। পাশাপাশি পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাজার খুঁজতে হবে, নির্দিষ্ট কারো ওপর নির্ভরশীল হওয়া যাবে না।’

Link copied!