Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪,

সড়কে বাড়ছে পুলিশের চাঁদাবাজি

মো. মাসুম বিল্লাহ

মে ৮, ২০২২, ০২:২১ এএম


সড়কে বাড়ছে পুলিশের চাঁদাবাজি

মোড়ে মোড়ে চেকপোস্ট। কাজ আইনি। তবে বৈধ চেকপোস্ট থাকলেও তারা অন্য কাজে ব্যস্ত। আইনের নামে তারা বেআইনি তৎপরতায় লিপ্ত। গাড়ি আটকে তল্লাশির নামে প্রকারান্তরে চাঁদা আদায় যেন ওদের প্রধান কাজ। রাজধানীর এমন কোনো চেকপোস্ট খুঁজে পাওয়া কঠিন যেখানে কাগজপত্র যাচাইয়ের নামে চাঁদার টাকা তোলা হয় না। 

নির্ধারিত স্থানে অনেকটা গোপনে গুঁজে দেয়া হচ্ছে টাকা। পকেটে টাকা পড়লেই গাড়ি ছোটে নির্দিষ্ট গন্তব্যে। কিছুক্ষণ দাঁড়ালে এমন দৃশ্য হরহামেশাই দেখা যায়। চেকপোস্টের নামে চাঁদার এই উৎসব যেন এক ফ্যাশনে রূপ নিয়েছে। 

দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ট্রাক, লরি আটক করে চাঁদা দাবি করে ট্রাফিক পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশের একাধিক বিপথগামী দুর্নীতিবাজ সদস্য। এছাড়া ঢাকার বাইরে থেকে আসা লেগুনা, সিএনজি এমনকি রিকশা থেকেও নিয়মিত চাঁদা আদায় হয়। তাদের দাবিকৃত চাঁদা না দিলেই নানাভাবে হয়রানিসহ গাড়ি আটক করে মামলা ঠুকে দেয়। দেয়া হয় হুমকিও। 

রাজধানীর কারওয়ান বাজার, বাবুবাজার, যাত্রাবাড়ী, গাবতলী, মোহাম্মাদপুর, বংশাল, উত্তরা ও মিরপুরসহ বেশ কয়েকটি স্পটে দিনে-রাতে চলছে রমরমা চাঁদার মহড়া। আদায় করা হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। 

জানা গেছে, হাইওয়ে, ট্রাফিক ও থানা পুলিশের সামনে প্রতিদিন শত শত বাসে দিন-রাত পালাক্রমে চলছে চাঁদাবাজি। পেশাদার চাঁদাবাজদের পাশাপাশি এসব চাঁদাবাজ চক্রের নেতৃত্ব দেয় সার্জেন্ট অথবা সাব-ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার কর্মকর্তারা।

এদের থেকেই আবার চাঁদার নির্ধারিত অংশ ভাগ হয়ে যায় ভিন্ন ভিন্ন মহলে। বগুড়ায় সাধারণ মানুষকে হয়রানি ও চাঁদাবাজির অভিযোগে দুই পুলিশ সদস্যকে সদর থানা থেকে প্রত্যাহার করা হয়। 

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) তৌহিদুল ইসলামকে সড়কে চাঁদাবাজির অভিযোগে ক্লোজড করা হয়। এমন ঘটনা শুধু ঢাকা, নোয়াখালী অথবা বগুড়াতে নয়। দেশের প্রায় সব বিভাগীয় শহরগুলোতেও পুলিশি নেমপ্লেটের আড়ালে সক্রিয় চাঁদাবাজদের সংখ্যা বাড়ছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর বাবুবাজার ব্রিজ দিয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অজস্র মালবাহী ট্রাক সন্ধার পরই ঢাকায় ঢুকছে। এসব ট্রাক থেকেই লাইনম্যান নাম করে তুলছে নির্ধারিত চাঁদা।

এসব চাঁদা উত্তোলনে আবার রশিদও দেয়া হচ্ছে। লাল, হলুদ অথবা গোলাপি রঙের এসব রশিদে থাকছে চাঁদার নির্ধারিত অংক। লাইনম্যান দিয়ে চাঁদা তোলা হলেও ক্ষেত্র বিশেষ পুলিশের সদস্যরাও নিজ হাতেই গ্রহণ করছেন চাঁদার অর্থ। 

খুলনা থেকে আসা আবদুুল আওয়াল নামের এক ট্রাকচালকের সাথে কথা হলে তিনি জানান, আগে সাধারণত ঢাকার যেকোনো একজন সার্জেন্টকে ১০০ টাকা দিয়ে স্ল্লিপ সংগ্রহ করলে সিটির মধ্যে আর কোথাও পুলিশকে চাঁদা দিতে হতো না।

কিন্তু বর্তমানে এক সার্জেন্ট অন্য সার্জেন্টের স্ল্লিপকে পাত্তা দেয় না, আলাদা আলাদাভাবেই টাকা দিতে হয়। গাড়ি ঢুকালেই বিভিন্ন স্থানে নির্ধারিত হারে চাঁদা দিতেই হবে। 

জহির মিয়া নামের এক চালক নড়াইল থেকে পানের ট্রাক নিয়ে প্রতি সপ্তাহে ঢাকা আসেন। তিনি জানান, আগে চাঁদার পরিমাণ কম ছিল। হয়রানিও কম করত। এখন চাঁদার পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। টাকা না দিলে গাড়ি দাঁড় করে রাখে। পাশে সাইড করে রেখে অতিরিক্ত টাকার জন্য চাপ দেয়। আমার লাইসেন্স, গাড়ির ফিটনেসসহ সব কাগজপত্র ঠিক থাকলেও এসব টাকা দিতেই হয়।

যাত্রাবাড়ী আড়ৎ আসা এক চালক জানান, গাড়ির কাগজপত্রে সমস্যা থাকলে বেশি চাঁদা দাবি করে পুলিশ। টাকা না দিলে মামলা দেয়ার ভয় প্রদর্শন করে তারা। ধোলাইপাড়, আমিনবাজার এলাকাতেও পুলিশকে চাঁদা দিতে হয়। মালের গাড়ি ঢুকাতেই তাদের টাকা দেয়া লাগবে। টাকা না দিলেই হয়রানি তো আছেই। গাড়ি সাইড করে রাখলে অনেক সময় কাঁচামাল নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তা ছাড়া টাকা যেহেতু দেয়াই লাগে সেহেতু আর কথা বলি না। 

সড়কে চাঁদাবাজির কারণ ও সমস্যা সমাধানে কেমন পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে এমন প্রশ্নের উত্তরে ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ মো. সাখাওয়াত হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, ‘পুলিশের ট্রাফিক পদমর্যাদার অনেকেই সড়কে নামে-বেনামে অজস্র গাড়ি পরিচালনা করছেন। এদের বেশির ভাগ নিজেদের পুলিশ পরিচয়কে পুঁজি করে অবৈধ সুবিধা লুফে নিচ্ছেন। 

পাশাপাশি পুলিশের কিছু বিপথগামী সদস্য ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে নির্ধারিত হারে চাঁদা উত্তোলন করছেন। এক্ষেত্রে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও সময়মতো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না বলেই বেপরোয়া হয়ে উঠছে তারা। এ জাতীয় সমস্যা নিরসনে ট্রাফিক ব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের পরিবহন ব্যবসায় নির্ধারিত আইন করা যেতে পারে। পাশাপাশি চাঁদা উত্তোলনের ক্ষেত্রে পুলিশের সচ্ছতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’  
 
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, ‘সড়কে পুলিশের এমন চাঁদাবাজির কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে নেই। ঢাকা অথবা ঢাকার বাইর থেকে আসা যানবাহন থেকে অর্থ আদায়ের এখতিয়ার পুলিশের নেই। তবে কোনো সদস্য যদি নির্ধারিত অভিযোগে অভিযুক্ত হন তবে আমরা তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেবো। এক্ষেত্রে পুলিশের প্রবিধান অনুযায়ী তাদের শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।’

Link copied!