Amar Sangbad
ঢাকা রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪,

এলসি জটিলতা

সংকটে ওষুধশিল্প

মাহমুদুল হাসান ও রেদওয়ানুল হক

মাহমুদুল হাসান ও রেদওয়ানুল হক

ডিসেম্বর ১২, ২০২২, ১২:২০ পিএম


সংকটে ওষুধশিল্প

রপ্তানি আয়ে আসতে পারে বড় ধাক্কা, দেশীয় সরবরাহে ঘাটতির শঙ্কা

  • ব্যাংক এলসি খুলছে না কাঁচামাল ফুরিয়ে আসছে
    -শিল্প সমিতি
  • এলসিতে সমস্যা নেই প্যানিক সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে
    -ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর
  • ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলসিতে কোনো বিধিনিষেধ নেই
    -বাংলাদেশ ব্যাংক

ডলারের সংকট প্রভাব ফেলছে সর্বত্র। জরুরি পণ্য (খাদ্য ও জ্বালানি) কিনতে রিজার্ভ থেকে সহায়তা দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে এর মধ্যেই সংকট তৈরি হয়েছে অতি জরুরি ওষুধশিল্পে। খাদ্যের মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ এ খাতে ডলার সহায়তার উদ্যোগ এখনো নেয়া হয়নি। কিন্তু নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এলসি খুলতে ব্যর্থ হচ্ছে ব্যাংক। সংকটের কথা বলে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে শিল্পমাকিলকদের। তারা বলছেন, দ্রুতই ফুরিয়ে আসছে কাঁচামাল। এরই মধ্যে সরকারি দপ্তরে চাওয়া হয়েছে সহায়তা। সময়মতো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে বড় ধাক্কা আসবে ওষুধ রপ্তানিতে। দেশীয় চাহিদায় সরবরাহ ঘাটতি দেখা দিলে বিঘিœত হতে পারে স্বাস্থ্য নিরাপত্তা। পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারে সিন্ডিকেট।

ব্যাংকগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু ওষুধ নয়; ডলার সংকটে সব ধরনের পণ্যের এলসিতেই সমস্যা হচ্ছে। তাই বাধ্য হয়ে ফেরত দিতে হচ্ছে ঋণপত্রের আবেদন। তারা বলছেন, কেবল জরুরি খাদ্যপণ্য ও জ্বালানিসহ কয়েকটি ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার সহায়তা দেয়া হয়। ওষুধের ক্ষেত্রে এখনো এ ধরনের সিদ্ধান্ত আসেনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ডলারের তীব্র সংকটের কারণে তারা ওষুধের এলসি খুলতে পারছেন না। শুধু রপ্তানি আয় থেকে প্রাপ্ত ডলারের সমপরিমাণ এলসি খোলা হচ্ছে। তবে শিল্পমালিকরা বলছেন, রপ্তানি আয়ের সমপরিমাণ এলসিও তারা খুলতে পারছেন না।

হাডসন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামান আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমার কোম্পানি ভারত থেকে মেশিন আমদানি করেছে; কিন্তু ব্যাংক বিল পরিশোধ করছে না। এতে বৈদেশিক বাণিজ্যে মারাত্মক সমস্যা তৈরি হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘মানুষ তার অন্যান্য চাহিদার সাথে কম্প্রোমাইজ করতে পারবে কিন্তু রোগ হলে ওষুধ না খেয়ে তো থাকা সম্ভব নয়। ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান দুই থেকে তিন মাসের কাঁচামাল মজুত রাখে। অধিকাংশ উৎপাদক কোম্পানির কাঁচামালের মজুত ফুরিয়ে এসেছে। আমাদের (ওষুধ শিল্প সমিতি) অনেক সদস্য ব্যাংকে এলসি খুলতে পারছে না।’

শফিউজ্জামান বলেন, ‘এসব সমস্যা নিয়ে ছোট পরিসরে অধিদপ্তরের (ঔষধ অধিদপ্তর) সাথে বসেছিলাম। আমরা জানিয়েছি ব্যাংকের এলসিজনিত সমস্যা সমাধানে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। নয়তো দেশের ওষুধের চাহিদা ও বিদেশে রপ্তানিতে বড় বাধা তৈরি হতে পারে।’

তবে সংকটের কথা নাকচ করে দিয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আইয়ুব হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, ‘অনেকে বলে ডলার সংকটে নাকি অনেক ব্যাংক তাদের এলসি খুলতে দিচ্ছে না। কিন্তু এই অভিযোগের কেউ প্রমাণ দিচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক তো সম্প্রতি বলেছে- এলসি খুলতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সরকার খাদ্যপণের সাথে ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে সর্বোচ্চ সুযোগ তৈরি করেছে। ওষুধের কাঁচামাল আমদানির এলসি খুলতে দিচ্ছে না এই কথা বলে অনেকে হয়তো প্যানিক তৈরি করতে চাচ্ছে।’

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক আমার সংবাদকে বলেন, ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলসিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো বিধিনিষেধ নেই। ব্যাংকগুলো তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী এলসি খুলছে। অর্থাৎ কেউ যদি এলসি খুলতে না পারে সেটি তার নিজস্ব ডলার সংকটের কারণে; বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো বাধার জন্য নয়।’

বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট চাহিদার ৯৭ শতাংশের বেশি ওষুধ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। এর পাশাপাশি ৪৩টি কোম্পানির বিভিন্ন প্রকারের ওষুধ ও ওষুধের কাঁচামাল যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রায় ১৫৩টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, ক্যান্সার, কুষ্ঠরোগ, অ্যান্টি-হেপাটিক, পেনিসিলিন, স্ট্রেপটোমাইসিন, কিডনি ডায়ালাইসিস, হোমিওপ্যাথিক, বায়োকেমিক্যাল, আয়ুর্বেদিক ও হাইড্রোসিলের সাথে সংশ্লিষ্ট ওষুধ বাংলাদেশ মূলত রপ্তানি করে থাকে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য ঘেটে দেখা যায়, প্রতি বছরই ওষুধ রপ্তানি থেকে আয় বেড়েছে। তথ্য বলছে, ২০১০-১১ অর্থবছরে ওষুধ রপ্তানি করে মাত্র চার কোটি ৪২ লাখ ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। এক দশক পর এ খাতে আয় বেড়েছে প্রায় পাঁচগুণ।

ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, আগের বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় গত ২০২১-২২ অর্থবছরেও ওষুধ রপ্তানির ইতিবাচক ধারা অব্যাহত ছিল। ওই অর্থবছরে এ খাত থেকে ১৮ কোটি ডলার আয়ের লক্ষ্য ধরা ছিল। আয় হয়েছিল ১৮ কোটি ৮৭ লাখ ৮০ হাজার ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে  ওষুধ রপ্তানি থেকে ২৩ কোটি ডলার বিদেশি মুদ্রা আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। অতীতের মতো এবারও লক্ষ্য অর্জনে কাজ করছে দেশের ওষুধ শিল্প প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ সংকট। ফলে চাহিদার অনুপাতে কাঁচামাল আমদানিতে জটিলতা তৈরি হচ্ছে। এদিকে ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের কাঁচামালের রিজার্ভও ফুরিয়ে আসতে শুরু করেছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের বিষয়ে এলসি খোলায় অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু ওষুধ শিল্প সংশ্লিষ্ট একাধিক প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, ডলার সংকটে ইতোমধ্যে বিভিন্ন ব্যাংক তাদের এলসি খোলার সুযোগ দিচ্ছে না। এই সমস্যা চলতে থাকলে দ্রুত সঙ্কটে পড়ে যাবে বৃহৎ রপ্তানি খাত।

প্রসঙ্গত, বিশাল বাণিজ্য ঘাটতির কারণে দেশে ডলার সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এরপর আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্য রক্ষায় বিলাসী পণ্য আমদানিতে শর্ত জুড়ে দেয়াসহ নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তবে এসব উদ্যোগের পরও ঘাটতি কমেনি। এর ফলে ডলার সংকট বেড়েই চলেছে। আর এর প্রভাব পড়ছে আমদানিনির্ভর পণ্য ও শিল্পে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে দুই হাজার ৫৫০ কোটি ৫০ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। তার বিপরীতে এক হাজার ৫৯১ কোটি ৮০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এতে ৯৫৮ কোটি ৭০ লাখ ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি হয়েছে। দেশীয় মুদ্রায় এই অংঙ্ক এক লাখ কোটি টাকার বেশি। 

Link copied!