Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪,

জ্বালানি খাতে নতুন সম্ভাবনা

মহিউদ্দিন রাব্বানি

জুলাই ১৮, ২০২২, ০১:২৪ এএম


জ্বালানি খাতে নতুন সম্ভাবনা

বিশ্বব্যাপী দেখা দিয়েছে তীব্র জ্বালানি সংকট। এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। ইতোমধ্যে নিজস্ব উৎপাদন বাড়ানোর কথাও ভাবছে সংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি বাগেরহাটের মোংলায় মৎস্যঘেরে বালি ওঠানোর সময় ভূগর্ভস্থ গ্যাসের সন্ধান মিলেছে। বিশেষজ্ঞরা এটিকে বিশাল সম্ভাবনা হিসেবে দেখছেন। তারা মনে করেন আমদানিনির্ভর জ্বালানি থেকে বেরিয়ে নিজস্ব জ্বালানির অনুসন্ধান ও উৎপাদন বাড়ানো দরকার। 

মোংলা উপজেলার মিঠাখালি ইউনিয়নের মধ্যপাড়া এলাকার ১নং ওয়ার্ডের মো. আলতাফ হোসেনের ছেলে মো. দেলোয়ার হোসেনের মাছের ঘেরে গ্যাস উদগিরণের এ ঘটনা ঘটে। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর শত শত উৎসুক জনতার ভিড় জমতে থাকে দেলোয়ারের বাড়িতে। 

সম্প্রতি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেডের (বাপেক্স) একটি বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধি দল স্থানটি পরিদর্শন করেন। কয়েক দফা পর্যালোচনা শেষে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছে। মাছের ঘেরে যেখানে গ্যাসের সন্ধান মেলে সেখানে গ্যাসের সঙ্গে তীব্র বেগে বালি ও পানি মিশে ১৫০ ফুট উদগিরণ আকারে ছড়িয়ে পড়ে। 

এরপরই গ্যাস ওঠার বিষয়টি বুঝতে পারেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। দেলোয়ার হোসেনের চিংড়ি মাছের ঘেরে প্রাপ্ত গ্যাস কাজে লাগাতে নিজেদের প্রযুক্তির মাধ্যমে শুরু থেকে পাইপলাইন দিয়ে বাসাবাড়িতে রান্নাও করছিল আশপাশের মানুষ।

বাপেক্সের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে জানা যাবে মিথেন গ্যাস নাকি হাইড্রোকার্বনের বাণিজ্যিক গ্যাস। যতক্ষণ পর্যন্ত এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া না যায় ততক্ষণ এ গ্যাস অন্যত্র ব্যবহার না করার জন্য পরামর্শ দিয়েছে বাপেক্সের প্রতিনিধি দল। 

মোংলা উপজেলা কর্মকর্তা (ইউএনও) আমার সংবাদকে জানান, মোংলার মিঠাখালির একটি মাছের ঘেরে গ্যাসের সন্ধানের তথ্য পেয়ে আমারা পরিদর্শনে যাই। ইতোমধ্যে বাপেক্স নমুনা সংগ্রহ করেছে। ২০ দিন পর জানা যাবে এটি মিথেন নাকি প্রাকৃতিক গ্যাস। যদি প্রাকৃতিক গ্যাস হয়ে থাকে তাহলে এর মাধ্যমে দেশে জ্বালানি খাতে বড় ধরনের সম্ভাবনা দেখা দেবে। 

সূত্রে জানা যায়, মোংলা উপজেলার মিঠাখালী ইউনিয়নের মধ্যপাড়া এলাকার দেলোয়ার হোসেনের তিস বিঘা মৎস্য ঘেরের জমিতে কয়েকটি স্থান থেকে গ্যাস বের হওয়ার খবর বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশ হয়। খবর পেয়ে নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা প্রশাসন, জেলা প্রশাসক ও পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহারসহ সরকারের কয়েকটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এটি পরী

ক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সরকারি পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নজরে আনা হয়। পরিদর্শনকালে জেলা প্রশাসক মো. আজিজুর রহমান বিষয়টি বাপেক্সের কর্মকর্তাদের সরেজমিন এসে দেখার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠান। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বুধবার বাপেক্সের জিএম (ল্যাব) ওহিদুল ইসলাম হওলাদারসহ চার সদস্যের প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে।

একই সময় উদগিরণকৃত গ্যাসের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য নমুনা সংগ্রহ করে বাপেক্সের এ প্রতিনিধি দল। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা যাবে মিথেন নাকি হাইড্রোকার্বনের বাণিজ্যিক গ্যাস।

জানা গেছে গত চার-পাঁচ বছর আগে জমিতে ড্রেজার দিয়ে মাটি কাটার সময় কয়েকটি জায়গা দিয়ে গ্যাস উদগিরণ হচ্ছিল। কিন্তু সে সময় আমলে নেয়নি জমির মালিক দেলোয়ার হোসেন। পুনরায় গত ৩০ জুন একই জায়গায় মাটি কাটার ড্রেজার বসাতে গেলে হঠাৎ পাইপ দিয়ে গ্যাস উদগিরণ হতে দেখে বিষয়টি সবার নজরে আসে। 

তবে ওই সময় থেকে প্রতি বছরই ঘেরের চাষকৃত মাছ মরে যেত। কিন্তু কোনো কারণ খুঁজে পায়নি ঘেরমালিক। এ বছর গ্যাসের ঘটনা দেখে নিজেদের প্রযুক্তিতে ড্রাম ও পাইপলাইনের মাধ্যমে বাড়ির গ্যাসের চুলার সাথে সংযুক্ত করে মাসব্যাপী রান্নার কাজ করে আসছে দেলোয়ার হোসেনের পরিবার। 

বাপেক্সের বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধি দলের প্রধান ওহিদুল ইসলাম হাওলাদার গণমাধ্যমকে বলেন, সংগ্রহকৃত গ্যাসের নমুনার দুই স্তরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে প্রতিবেদন দেয়া হবে। তবে প্রতিবেদন তৈরি করতে কিছুটা সময় লাগবে। 

তিনি আরও বলেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরই জানা যাবে এ গ্যাসের ধরন। তবে প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে এটি শ্যালো মার্স গ্যাস (লতাপাতা, গুল্মপচা) অর্থাৎ উপরিভাগের মিথেন গ্যাস। তারপরও দুই ধরনের পরীক্ষায় একটিতে যদি হায়ার হাইড্রোকার্বনের উপস্থিতি পাওয়া যায় তাহলে সেটি হবে ভূগর্ভস্থ দাহ্য মূল্যবান বাণিজ্যিক গ্যাস। আর হায়ার হাইড্রোকার্বন না থাকলে হবে ভূ-উপরিভাগের মিথেন (মাটির নিচের লতাপাতা-গুল্মপচা গ্যাস। যা কিছুদিন ধরে উঠতে উঠতে এক সময়ে শেষ হয়ে যাবে। আর বাণিজ্যিক হলে সে ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। 

তিনি পরিদর্শন ও নমুনা সংগ্রহের পর জমি ও ঘেরের মালিক দেলোয়ার হোসেনকে নিজেদের প্রযুক্তিতে পাইপলাইন টেনে চুলায় গ্যাসের ব্যবহার না করার জন্য পরামর্শ দেন। কারণ এ গ্যাস জমি অথবা বাড়ির বিভিন্ন জায়গা থেকে উদগিরণ হতে পারে। এতে বাড়ি ঘরসহ এর আশপাশে আকস্মিক অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি রয়েছে। 

তাই এ ঘটনায় প্রতিবেদন বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সঠিক তথ্য-উপাত্ত না পাওয়া পর্যন্ত গ্যাস ব্যবহার না করার পরামর্শ দেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। স্থানীয় ইউপি সদস্য উকিল উদ্দিন ইজারাদার সূত্রে জানা যায়, বিগত পাঁচ বছর আগে দেলোয়ারের মাছের ঘের থেকে গ্যাস জাতীয় কিছু একটা উঠেছিল। কিন্তু কেউ কখনো মূল্যায়ন করেনি। হঠাৎ দেখা যায়, ঘেরের জমি থেকে প্রচণ্ড বেগে গ্যাস উঠছে। এখনই প্রয়োজন সরকারের ব্যবস্থা নেয়া, না হয় গ্যাস গ্রামে ছড়িয়ে পড়লে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

মোংলা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম বলেন, গ্যাস উদগিরণের  বিষয়টি আমরা পরিদর্শনে যাই এবং নির্বাহী কর্মকর্তাকেও বিষয়টি অবহিত করি। ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটে বেড়েছে সব ধরনের জ্বালানির দাম। দাম নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় আমদানিও করা যাচ্ছে না। যার প্রভাব পড়ছে গোটা দেশে। 

এদিকে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান জানান, এই সংকট শিগগিরই মোকাবিলা করা যাচ্ছে না। আমাদের আরও বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ফলে সময়সাপেক্ষে সংকট দূর হবে। 

২০০৯ সালের পর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিয়ে ‘বড় পরীক্ষার’ মধ্যে পড়ার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা বলেন, ‘যে এলএনজির দাম ছিল প্রতি ইউনিট পাঁচ ডলার, সেটি এখন ৪১ ডলার হয়ে গেছে। ৭১ ডলারের ডিজেল এখন ১৭৭ ডলারে উঠে গেছে। ব্লুমবার্গসহ কিছু মিডিয়া সেটা ৬০০ ডলারে পৌঁছে যাওয়ার আভাস দিচ্ছে।’

জ্বালানির কারণে এখন সারা বিশ্বে সংকটে জাপানের মতো দেশে লোডশেডিং শুরু হয়ে গেছে। জার্মানি বিদ্যুতের রেশনিংয়ের জন্য তৈরি হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়াও হচ্ছে। 

আন্তর্জাতিক জ্বালানি সম্পদ সংস্থার (আইইএ) নির্বাহী পরিচালক ফাতিহ বিরল জানিয়েছেন, রাশিয়া বিশ্বের জ্বালানি সম্পদের গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহকারী দেশ। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষের পর পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ওপর সার্বিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে সারা বিশ্ব তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ সংকটে পড়েছে।
 

Link copied!