আবদুর রহিম ও রফিকুল ইসলাম
জুলাই ২৩, ২০২২, ০১:১৬ এএম
আবদুর রহিম ও রফিকুল ইসলাম
জুলাই ২৩, ২০২২, ০১:১৬ এএম
হ্যাটট্রিক সময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের ১৩ বছর পার করেছে। দেখিয়েছে উন্নয়নের ম্যাজিক। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারিতে দিনবদলের অঙ্গীকার করে সোনালি অধ্যায় পার করেছে।
২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত স্বপ্নের বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি রেখে দ্বাদশ নির্বাচনের ইশতেহার প্রণয়ন করা হচ্ছে। টানা চতুর্থবারের মতো বিজয়ের রেকর্ড গড়তে ভেতরে-বাইরে আপ্রাণ চেষ্টা চলছে।
এর মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে নাগরিক সংকট। ধনী থেকে গরিব— সবার ঘরে চাপ পড়েছে। মানুষের মধ্যে যন্ত্রণা ও বিরক্তি এসেছে। কষ্টের সম্মুখীন হচ্ছে সব পরিবার। রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে খাতা-কলমে আয় বাড়লেও দেশের বেশির ভাগ মানুষের আর সংসার চলছে না। চাল ও তেলের বাজার অস্থির হয়ে গেছে। গ্যাসও ফুরিয়ে যাচ্ছে।
কথা রাখছে না বিদ্যুৎ বিভাগ, এক ঘণ্টার লোডশেডিং তিন ঘণ্টায়ও শেষ হচ্ছে না, গ্রাম থেকে শহরে সব জায়গায় ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়েছে। রিজার্ভ অর্থের অপব্যবহার নিয়ে রাজনৈতিক মহলে দুর্নীতি ও অপব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। নানা ক্ষেত্রে যেভাবে অপ্রয়োজনীয়ভাবে রিজার্ভ থেকে টাকা খরচ করা হয়েছে তাতে বর্তমান ফান্ড দিয়ে সামনের ঝুঁকি মোকাবিলা চ্যালেঞ্জ হয়ে যাবে বলে বিশেষ মহল থেকে রব উঠেছে।
এ ছাড়া দেশের সাংবিধানিক পদ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বের বিষয়গুলোতেও আঘাত আসছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে সম্পৃক্ত বিষয়গুলোতে ততই শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য স্বয়ং নির্বাচন কমিশন থেকেই প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। মাঠে সেনা প্রয়োজন বলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিজেই বলেছেন।
বিএনপিসহ প্রধান দলগুলো অংশগ্রহণ না করলে দেশ-বিদেশে জাতীয় নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠবে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বারবার উত্তেজনা, খুনোখুনি চলছে। দেশে প্রায় ১৪ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। এর মধ্যে প্রতি বছর ৩০ হাজারেরও বেশি নতুন করে জন্ম নিচ্ছে।
এদের পরিচয় ও ঠিকানা কী হবে— এখনো সরকার থেকে স্পষ্ট কিছু বলা হচ্ছে না। স্থানীয়রা সংখ্যালঘু হয়ে পড়ছেন। নিরাপত্তা শঙ্কায় অনেকেই এলাকা ছাড়ছেন। পাহাড় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। নিরাপত্তা হুমকিতে পড়ছে পুরো দেশ। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় অস্থিরতা বিরাজ করছে।
শিক্ষিতের হার বেড়েছে, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই। এর মধ্যে এখনো অনিরাপদ ক্যাম্পাস। সমপ্রতি চবিতে ছাত্রী হেনস্তায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উত্তাল হয়ে ওঠছে। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই নাগরিক সমস্যা বাড়ছে।
দেশের সামগ্রিক বিষয়ের উপর চোখ রাখা ব্যক্তিরা বলছেন, এবার যেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসবে তাকে আগে নাগরিক সমস্যা দূর করতে হবে। নাগরিকদের সমস্যা দূরীকরণ ব্যতীত এবার কোনো দলেরই অবস্থান মজবুত হবে না।
এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য বেশি চ্যালেঞ্জ— কারণ, তারা দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব দিলেও নাগরিকদের বড় সমস্যাগুলো দূর করতে পারেনি।
অন্যদিকে সরকারবিরোধী দলগুলো বলছে, ক্ষমতাসীন সরকার দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। মানুষের চাহিদা পূরণ করতে পারেনি। যার জন্য এ সরকারের পতন নিশ্চিত হবে।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সাবেক সদস্য নূহ-উল আলম লেনিন আমার সংবাদকে বলেন, ‘দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী, মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনৈতিক বিপর্যয়— এগুলো শুধু বাংলাদেশ নয়, এটি বিশ্বব্যাপী সমস্যা। চলমান এ সমস্যা নিয়ে দেশের সব শ্রেণির মানুষ জানে ও বোঝে। কাজেই এ সমস্যা নিয়ে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে কোনো প্রভাব পড়বে বলে আমি মনে করি না।
সংকট নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ থাকতে পারে, আক্ষেপ থাকতে পারে; কিন্তু মানুষের ফেটে পড়ার মতো বা সরকার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার মতো কিছু হয়নি। কারণ দেশের মানুষ জানে বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাস ও ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে আমাদের দেশে এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে কিন্তু কখনোই এ সমস্যা সৃষ্টি হয়নি।’
শ্রীলঙ্কা সরকারের মুখথুবড়ে পড়ার কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘একই সমস্যার জন্য আজ শ্রীলঙ্কা সরকার পড়ে গেছে। সরকার পড়লেও সেখানে কিন্তু সঠিক সমাধান হয়নি। রাতারাতি কেউ কিন্তু এ সমস্যার সমাধান দিতে পারবে না। এ সমস্যার সমাধান করতে হলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তেমনি সরকার পরিবর্তন হলেও কিন্তু বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান হবে না। সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
ইতোমধ্যে সরকারপ্রধান কিন্তু সেই পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। আর সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের জন্য এ মুহূর্তে আওয়ামী লীগ ছাড়া তেমন কোনো রাজনৈতিক দলও নেই। আওয়ামী লীগের ওপর দেশের মানুষের সেই আস্থা ও বিশ্বাস আছে। তবে দেশে দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে, সেহেতু নির্বাচনের কিছুটা প্রভাব তো পড়বেই। কারণ, এবার আর ফাঁকা বুলি দিয়ে নির্বাচনের মাঠে পার হওয়া যেকোনো দলের জন্য কঠিন হবে।’
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু আমার সংবাদকে বলেন, ‘চলমান সংকট মোকাবিলায় সরকার সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। যেন দ্রুত সময়ের মধ্যেই এ সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘যেকোনো সংকট জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের এখনো দেড় বছর বাকি আছে। নির্বাচন আসতে আসতে এই সংকটের কী অবস্থা হবে। সেটি দেখার বিষয়। এ নিয়ে আগে মন্তব্য করা সঠিক হবে না।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু আমার সংবাদকে বলেন, ‘একটি দেশে যদি গণতান্ত্রিক সরকার না থাকে, একটি দেশে যদি মানুষের ভোট দেয়ার অধিকার না থাকে; সে দেশে নানামুখী সংকট ও সমস্যা সৃষ্টি হবে— এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশেও ঠিক তাই হয়েছে।
সরকারের অনিয়ম, দুর্নীতি ও জবাবদিহিতা না থাকায় আজ চলমান সংকট আরও বেগবান হচ্ছে। এই সরকার উন্নয়নের ফাঁকা বুলি আওড়াচ্ছে। উন্নয়নের বুলি দিয়ে আর ক্ষমতায় থাকা যাবে না। এ দেশের মানুষের এখন উন্নয়ন প্রয়োজন। বিএনপি ক্ষমতায় এলে আগে মানুষের উন্নয়নের কথা চিন্তা করবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক আমার সংবাদকে বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী যে সংকট সেই সংকটের প্রভাব থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত রাখা সম্ভব নয়। তবে যতটুকু পারা যায় নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করা।
একই সাথে দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখীর যে চাপ এবং বিদ্যুতের সাশ্রয়ের জন্য সরকার যে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে তার সাথে দেশের জনগণকে সম্পৃক্ত করা। কারণ আমাদের দেশের মানুষ গণতন্ত্রমনা ও অল্পেতুষ্ট মানুষ। কাজেই বিভিন্ন সময় সরকার যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুক না কেন, সেই সিদ্ধান্তের সাথে জনগণকে সম্পৃক্ত রাখতে হবে।
তাহলে জনগণ অনুধাবন করবে, কেন লোডশেডিং দিচ্ছে, কেন দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী। জনগণের সাথে সরকারের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলে তুষ্টতা না থাকলে নির্বাচনে জনগণ সসরকারের বিপক্ষে অবস্থান নেবে।’