Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২০ মে, ২০২৪,

ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার বিভিন্ন কৌশল

ইউসিবির পর্ষদে গোলমাল

জাহিদুল ইসলাম

আগস্ট ২২, ২০২২, ০৩:৩৬ এএম


ইউসিবির পর্ষদে গোলমাল

আর্থিক খাতের প্রতিটি আইনে কোম্পানি পরিচালনায় এক পরিবার থেকে কতজন সদস্য অন্তর্ভুক্ত থাকবে তা নির্ধারিত থাকে। একক ব্যক্তি বা পরিবারের নিয়ন্ত্রণে থেকে যেন অনিয়ম না হয়, মূলত এজন্য এই বিধানটি করা হয়। কিন্তু সেই বিধানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে এক পরিবারের পাঁচজন সদস্য অন্তর্ভুক্ত আছে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) পরিচালনা পর্ষদে।

এমনকি ব্যাংকে থাকার পরও অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পরিচালক ছিলেন তাদের কয়েকজন। ফলে বৈশ্বিক বর্তমান পরিস্থিতি ও দেশের আর্থিক খাতের সংকটের মাঝে প্রতিষ্ঠানটির এমন অনিয়মে ব্যাংক খাতের ওপর আস্থা হারাবে সাধারণ মানুষ— এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, ব্যাংক কোম্পানি আইন (সংশোধিত) ২০১৮ অনুসারে কোনো ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একই সময়ে একই পরিবারের চারজনের বেশি সদস্য থাকতে পারবে না। কিন্তু ইউসিবির বর্তমান পরিচালনা পর্ষদে একক কর্তৃত্বে রয়েছে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর পরিবার। তিনিই এই ব্যাংকের মূল উদ্যোক্তা। এছাড়া বীমা খাতের জনতা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিও তার হাতে গড়া।

বর্তমানে ওই পরিবার থেকে ইউসিবিএলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তার দুই ছেলে আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনি এবং আসিফুজ্জামান চৌধুরী জেমি। এছাড়া তিন মেয়ের মধ্যে দুজন রোকসানা জামান এবং আফরোজা জামান পরিচালনা পর্ষদে আছেন। তবে প্রতিষ্ঠানটির নেপথ্য পরিচালনায় রয়েছেন আখতারুজ্জামান চৌধুরীর বড় ছেলে এবং বর্তমান সরকারের ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ। কিন্তু ভূমি মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকায় তার সহধর্মিণী রুকমিলা জামান বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন।

এদিকে ব্যাংক আইনে কোনো পরিচালক একইসাথে অন্য কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত থাকতে পারবে না, এরূপ বিধান থাকলেও তা মানেনি এই ব্যাংকের দুই পরিচালক রোকসানা জামান ও আফরোজা জামান। ব্যাংকটির ২০২০ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ওই দুই পরিচালক ইউসিবির পাশাপাশি জনতা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতেও পরিচালক হিসেবে ছিলেন।

অথচ ব্যাংক আইন, ১৯৯১ অনুসারে ব্যাংক পরিচালক বীমা পরিচালক থাকতে পারবেন না। তাছাড়া বীমা আইন, ২০১০ অনুসারে কোনো বীমাকারীর পরিচালক অন্য ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক থাকতে পারবেন না। সেক্ষেত্রে বীমা আইনও লঙ্ঘন হয়েছে।

আবার ব্যাংক আইনে বলা হয়েছে, আর্থিক খাত সংশ্লিষ্ট কোনো নিয়ামক সংস্থার আইন লঙ্ঘন করলে কেউ ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন না। ওই পরিচালকদ্বয় একই সাথে ব্যাংক এবং বীমা আইন লঙ্ঘন করেছে, যা অপ্রত্যাশিত।

প্রতিষ্ঠানটির এমন আইন লঙ্ঘনের পরও দুই নিরীক্ষা ফার্ম এমএবিএস অ্যান্ড জে পার্টনারস এবং ইতরাত হোসেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস থেকে কোনো আপত্তি (কোয়ালিফাইড অপিনিয়ন) দেয়া হয়নি। এমনকি এসব অনিয়মের পরও কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং মুখ্য অর্থ কর্মকর্তা ঘোষণা দিয়েছেন, কোনো অনিয়ম হয়নি বরং সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি সঠিকভাবে পরিপালন করা হয়েছে।

এক্ষেত্রে এই ঘোষণাও সত্য নয় বলেই প্রতীয়মান হয়। প্রতিষ্ঠানটির এসব অনিয়মের বিষয়ে দৈনিক আমার সংবাদ থেকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ কাদরির কাছে জানতে চাওয়া হয়।

অনিয়ম বিষয়গুলো জানার পর ব্যস্ততার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে কোম্পানি সচিব এটিএম তাহমিদ জামান মতামত দেবেন।’

পরবর্তীতে কোম্পানি সচিব জানান, একই পরিবার থেকে চারজন পরিচালকই আছেন। ভূমিমন্ত্রীর সহধর্মিণী রুকমিলা ম্যাডাম আইন অনুসারে আলাদা পরিবারের।

এছাড়া দুই পরিচালকের জনতা ইন্স্যুরেন্সে পরিচালক থাকার বিষয়ে বলেন, ব্যাংক আইন ২০১৩ সালে যখন সংশোধন হয় সেখানে ব্যাংকের পরিচালকদের দুই মেয়াদে বীমার পরিচালক থাকার সুযোগ দিয়েছে। আমাদের পরিচালকদের দুই মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তারা সেখান থেকে চলে আসেন। তবে এ সম্পর্কিত বীমা আইন লঙ্ঘন হওয়ার প্রেক্ষিতে তারা ব্যাংকের পরিচালকও থাকতে পারে না, এমনটা জানালে তিনি বলেন, ‘আমার প্রাইমারি ল’ (বিধান) যেটা বলেছে আমি সেটা করেছি। এখানে কোনো অসুবিধা নেই’।

বিষয়টি নিয়ে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘ব্যাংক কোম্পানি আইনের কোনো নন-কমপ্লায়েন্স থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু এসইসির করপোরেট গভর্ন্যান্স কোড অনুসারে স্বতন্ত্র পরিচালক না থাকলে এ জন্য এসইসি থেকে এনওসি (অনাপত্তি সনদ) নিতে হয়। যদি না নিয়ে থাকে এবং আইন অনুসারে স্বতন্ত্র পরিচালকও না থাকে তবে তাদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

অপরদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যাংক আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো কার্যক্রম চালানোর সুযোগ ব্যাংকের নেই। যদি কেউ আইন অমান্য করে তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্তসাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।’ ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের কতিপয় অনিয়মের তথ্য—

১. উদ্যোক্তা পরিচালক ১৭ জনের বিপরীতে স্বাধীন পরিচালক তিনজন।

২. ব্যাংকটি তার মূলধনের ২৫ শতাংশ ঋণ দিয়েছে ফোর এইচ গ্রুপ, কবির গ্রুপ, বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার লিমিটেড, বসুন্ধরা গ্রুপ, প্রাণ এগ্রো, ডিআইআরডি গ্রুপ, জিপিএইচ ইস্পাত, হাবীব গ্রুপ, বিএসএম গ্রুপ এবং মোস্তফা হাকিম গ্রুপ।

৩. এক পরিবার থেকে পাঁচজন পরিচালক। তাছাড়া এই পরিচালকদের (রুকমিলা জামান, আনিসুজ্জামান, আসিফুজ্জামান, রোকসানা জামান, আফরোজা জামান) একত্রে ১৪ কোটি ১৫ লাখ ১২ হাজার ৯৮৯টি শেয়ার বা মোট শেয়ারের  ১১.৬৩ শতাংশ ধারণ করেছে।

৪. পরিচালক রোকসানা জামান ও আফরোজা জামান জনতা ইন্স্যুরেন্সের পরিচালক হিসেবে রয়েছেন বলে ইউসিবির ২০২০ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে।

৫. মোট ঋণ দিয়েছে ৪০ হাজার ২৪৮ কোটি ২০ লাখ টাকা। ২০২০ সালের ৩১ মার্চ মোট ঋণ বিতরণ হয়েছিল ৩২ হাজার ৪৬৮ কোটি ২০ লাখ টাকা। ২০২১ সালে কৃষি লোন দিয়েছে ৪৭৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২১-২২ অর্থবছরে কৃষি ও পল্লী ঋণ নীতিমালা ও কর্মসূচি অনুসারে পূর্ববর্তী বছরের ৩১ মার্চ মোট ঋণ ও অগ্রিমের ন্যূনতম ২.৫ শতাংশ কৃষিতে বিতরণ করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটিকে মোট ৮১১ কোটি ৭০ লাখ ৫০ হাজার টাকা কৃষি খাতে ঋণ দিতে হবে। প্রতিষ্ঠানটি এক্ষেত্রে তা পরিপালন করেনি। 

৬. নিট ইন্টারেস্ট ইনকাম ২০২০ সালে ছিল ৯৭৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। সিএসআর খাতে ব্যয় করেছে ২১ কোটি ২১ লাখ টাকা বা ২.১৬ শতাংশ।

আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। বড় ছেলে সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, মেজ ছেলে আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনি এবং ছোট ছেলে আসিফুজ্জামান চৌধুরী জেমি। সাইফুজ্জামানের স্ত্রী রুকমিলা জামান।

মোট শেয়ার : ১২৭, ৮৩, ৯৬, ৯৪৯

Link copied!