Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪,

সুষ্ঠু নির্বাচনই পূর্বশর্ত

রেদওয়ানুল হক

রেদওয়ানুল হক

নভেম্বর ২৯, ২০২৩, ১২:২৫ এএম


সুষ্ঠু নির্বাচনই পূর্বশর্ত

রিজার্ভের ধারাবাহিক পতন, দেশীয় মুদ্রা টাকার মানে রেকর্ড অবনমন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, তীব্র তারল্য সংকট এবং খেলাপি ঋণ ও মূলধন ঘাটতিতে ব্যাংক খাতে অস্থিরতাসহ নানামুখী সংকটে দেশের অর্থনীতি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বমুহূর্তে নেয়া যাচ্ছে না বড় কোনো সংস্কারের উদ্যোগ। নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে সৃষ্ট অস্থিরতায় বৈদেশিক বিনিয়োগে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। মূল্যস্ফীতি ও ডলার সংকট ঠেকাতে গৃহীত পদক্ষেপ নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করেছে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে। 

বিপুলসংখ্যক কর্মসংস্থান কমে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক চোখ রাঙানির কবলে রপ্তানি খাত। এমন পরিস্থিতিতে সব সংকট সমাধানের একমাত্র উপায় সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন— বলছেন অর্থনীতিবিদরা। এর সঙ্গে একমত পোষণ করে বক্তব্য দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনারও। বিষয়টি কতটা প্রাধান্য পাবে নীতিনির্ধারকদের কাছে, সেটি নিয়ে উৎকণ্ঠায় খাত-সংশ্লিষ্টরা।

চলমান অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে জাতীয় নির্বাচন অনেকটা মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থিতিশীল সরকার কাঠামো না থাকলে বৈদেশিক সম্পর্কে অস্থিরতা দেখা দেয়। একইসঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক সংঘাত বিরাজমান থাকে। ফলে বৈদেশিক বিনিয়োগ ও ঋণ পেতে বিপাকে পড়তে হয়। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে বড় সমস্যা তৈরি হয়। চলমান অস্থিরতা অর্থনীতি খুব বেশিদিন বহন করতে পারবে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও খাত-সংশ্লিষ্টরা। তাই সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি এখন অর্থনীতির প্রধান নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে।  

সম্প্রতি গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, নির্বাচনের পর বাংলাদেশের ওপর আস্থা বাড়লে বিদেশ থেকে বিনিয়োগ আসবে, বৈদেশিক ঋণের অর্থ ছাড় হবে। এছাড়া সামনের দিনগুলোতে ইউএস ইন্টারেস্ট রেট কমলে বাংলাদেশের শর্টটার্ম ক্রেডিট ও ট্রেড ক্রেডিট বাড়লেই অর্থনীতিতে বাউন্স ব্যাক শুরু হবে। তখন রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ার পাশাপাশি রপ্তানিকারকরা প্রবাস থেকে রপ্তানি আয় দ্রুততার সঙ্গে আনবেন। এর আগে চলমান অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সঙ্গে এক আলোচনায় গভর্নর বলেন, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে নেমেছে। আর নিচে নামার সুযোগ নেই। ৩৬ বছরের চাকরি জীবনে এমন অর্থনৈতিক সংকট দেখিনি। নির্বাচনের পর অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন শুরু হবে বলে জানান তিনি। 

সংকট প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা যখন তৈরি হয়, তখন একধরনের ভীতির সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এ ভীতির সংস্কৃতির ফলে অনানুষ্ঠানিক খাতে খুব প্রভাব পড়ে। দেশের ৮০-৮৫ শতাংশ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অনানুষ্ঠানিক খাতেই প্রবাহিত হয়। অর্থাৎ দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ এসব কাজের সঙ্গে জড়িত। বর্তমানে পণ্য সংগ্রহ করা মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা এখন খুব ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। এতে মানুষের উপার্জনে সমস্যা দেখা দিয়েছে। এরকম ভয়ের সমাজে পরিবহন সংকটের কারণে সরবরাহে সংকট দেখা দেয়। এ কারণে শহরে গ্রাম থেকে আসা জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। অন্যদিকে শহর থেকে যাওয়া পণ্য গ্রামে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। 

তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতিতে অতিসত্বর নতুন বিনিয়োগের কোনো সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি না। অনিশ্চিত অবস্থায় কীভাবে বিনিয়োগ করবে? এ পরিস্থিতিতে ছোট-বড় সব বিনিয়োগকারীরই সমস্যা হচ্ছে। বিশেষ করে রপ্তানি খাতে পণ্য সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সম্প্রতি গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এমন উদ্বেগের কথা তুলে ধরেন।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক কলামে সংকট উত্তরণে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, যদি একটি একতরফা নির্বাচন হয়, তাহলে নির্বাচন-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপরই নির্ভর করবে ভবিষ্যৎ অর্থনীতি। এর আগেও নির্বাচনকালীন সহিংসতায় অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে।  কিন্তু ওই সময়গুলোতেও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো ছিল। এবারই বেশ কিছুদিন থেকে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে নির্বাচনি সহিংসতা শুরু হয়েছে। প্রথমবারের মতো অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট একসঙ্গে দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে চলমান অর্থনৈতিক সংকট আরও গভীর হবে। তাই সার্বিকভাবে অর্থনীতির স্বার্থেই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন। এরপর যে সরকারই আসুক না কেন, চলমান অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। 

তিনি বলেন, গত দুটি নির্বাচনে বিদেশি কোনো শক্তির তেমন হস্তক্ষেপ না থাকলেও এবার যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে। তাই এবারের নির্বাচন কতটুকু অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক হয়, তার ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে যুক্তরাষ্ট্র। যদি নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে তারাও হয়তো নির্বাচন মেনে নেবে। যদি আগের মতো একতরফা হয়, তাহলে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।

একতরফা নির্বাচন অর্থনীতির জন্য কতটা খারাপ পরিণতি ডেকে আনতে পারে, সে সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘ইচ্ছা পূরণের নির্বাচন শুভ ফল দেবে না।’ বর্তমানে দেশ তিনটি সংকটে রয়েছে— রাজনৈতিক সংকট, অর্থনৈতিক সংকট ও বৈদেশিক সম্পর্কজনিত সংকট। এ সংকটগুলো আরও ঘনীভূত হচ্ছে। নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে যুক্তরাষ্ট্র তার বিদ্যমান আইনের আদেশবলে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে। এর মধ্যে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকিও রয়েছে। ইতোমধ্যে কল্পনা আক্তারের বিষয়টি  দেশটির সামনে এসেছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, এটি কোনো কল্পনা নয়, এটি বাস্তব ‘কল্পনা’। বৈদেশিক সম্পর্কের অবনতি বিষয়ে তিনি বলেন, সরকারের সর্বোচ্চ জায়গা থেকে যেসব বাক্য ব্যবহার করা হয়, তা কূটনৈতিক সম্পর্কে অস্বস্তি তৈরি করে চলেছে।

রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে এবং নির্বাচনের পরও হরতাল-অবরোধ চলতে থাকলে দেশ গভীর সংকটের মুখোমুখি হবে জানিয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি চলতে থাকলে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। রাজনৈতিক সহিংসতা চলতে থাকলে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমর্যাদাও বড় সংকটে পড়বে। বর্তমান দেশের অর্থনীতির আকার বিবেচনায় এখন একদিন হরতাল হলে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় সাড়ে পাঁচ হাজার থেকে ছয় হাজার কোটি টাকা। এই হরতাল-অবরোধের কারণে আমাদের সরবরাহ চেইনও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যার ফলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের খাত রপ্তানি ধসে পড়ার আশঙ্কা আছে। 

অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের আশঙ্কার সঙ্গে বিদেশি অংশীদারদের চাপের বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষণেও এসেছে। রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনক হলো আমাদের নির্বাচনে বাইরে থেকে থাবা বা হাত এসে পড়েছে। তারা আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে। ওরা খুব বেশি দাবি করেনি। তাদের একটাই দাবি— বাংলাদেশের নির্বাচন ফ্রি, ফেয়ার ও ক্রেডিবল হতে হবে। আমাদের অর্থনীতি, আমাদের ভবিষ্যৎ, আমাদের অনেক কিছু রক্ষা করতে হলে, সাধারণ জনগণকে বাঁচাতে হলে, আমাদের গার্মেন্ট শিল্পকে বাঁচাতে হলে নির্বাচনটাকে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, বিশ্বাসযোগ্য করতে হবে।’

খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থনীতিবিদদের বিরামহীন সতর্কতার পরও একতরফা নির্বাচন দেশের জন্য ভয়ানক পরিণতি বয়ে আনতে পারে। তাই চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনোই বিকল্প নেই। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, দায় সৃষ্টিতে দায়বদ্ধতা থাকা প্রয়োজন। সরকার যদি জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ না থাকে, তাহলে অপ্রয়োজনীয় দায় সৃষ্টি করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিপদের মুখে ঠেলে দেবে।
 

Link copied!