Amar Sangbad
ঢাকা রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪,

মির্জা ফখরুলের বিকল্প কে

আবদুর রহিম

মার্চ ১২, ২০২৪, ১২:৪২ এএম


মির্জা ফখরুলের বিকল্প কে
  • মির্জা ফখরুল সময়ে তিনটি জাতীয় নির্বাচনে ব্যর্থতা সবার মুখে মুখে 
  • জ্যেষ্ঠদের বড় অংশ কাউন্সিল চান না  চেয়ারম্যানের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়ার অভিযোগ 
  • খালেদা জিয়ার মুক্তিতে আন্দোলন না হওয়া একাদশে ঐক্যফ্রন্ট, দ্বাদশে এক মঞ্চের বাধা নিয়ে প্রশ্ন
  • দ্বাদশে রাজপথে গ্রেপ্তার না হয়ে ‘ঘরের গ্রেপ্তারও’ রহস্য চোখে 
  • কেউ কারাগারে, কেউ ব্রিফিংয়ে, কেউ আত্মগোপনে পরিকল্পিত বলে সন্দেহ 

কাউন্সিল হলে মহাসচিব বিকল্পের অবসান হবে
— বলছেন নীতিনির্ধারকরা

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ছিলেন পাঁচ বছর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব। ২০১৬ সালের ৩০ মার্চ ভারমুক্ত হয়ে আট বছর পূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। এক যুগে মির্জা ফখরুল সময়ে তিনটি জাতীয় নির্বাচন পার হলো। ২০১৪ সালে ভোট বর্জন, ২০১৮ সালে ভরাডুবি এবং ২০২৪ সালে আন্দোলনের ডাক দিয়ে কেউ কারাগারে, কিউ ব্রিফিংয়ে, কেউ আত্মগোপনে। প্রশ্ন ওঠে দলটির মহাসচিব, স্থায়ী কমিটি এবং আন্দোলন সমন্বয়ে যারা ছিলেন, তাদের নেতৃত্ব দুর্বলতা নিয়েও। দলটির বড় অংশ থেকে অভিযোগ উঠেছে— দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যাদের দায়িত্ব দিয়েছেন, তাদের বড় অংশই ব্যর্থ হয়েছেন। সিনিয়র অনেকেই তারেক রহমানের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেননি। 

বিএনপির যে জনপ্রিয়তা ছিল, সাধারণ মানুষের সমর্থন ছিল, তৃণমূলের ত্যাগ ছিল— তা কাজে লাগাতে পারেনি। এবার নির্বাচনের পরপরই মাঠ পর্যায় থেকে কাউন্সিলের মাধ্যমে মহাসচিব পরিবর্তন এবং স্থায়ী কমিটিতে আন্দোলনে যোগ্যদের জায়গা করে দিতে জোরালো দাবি ওঠে। তবে হাইকমান্ডের বড় অংশ এ নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলছেন, মির্জা ফখরুলের বিকল্প কে? মির্জা ফখরুল আওয়ামী লীগ, ডান-বাম সব দলের কাছে জনপ্রিয়। দেশের সুশীল সমাজের বড় অংশও মির্জা ফখরুলে সন্তুষ্ট! তবে এ নিয়ে বিএনপির ত্যাগী নেতাদেরও কিন্তু পাল্টা অভিযোগ নেই। তারা বলছেন, নম্র-ভদ্রতায় সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতায় ফখরুল নিয়ে প্রশ্ন নেই। তবে রাজনৈতিক ভূমিকায় মহাসচিবের বিচক্ষণতায়, উপযুক্ত সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত, নেতাকর্মীদের ভাষা  বোঝায় ফখরুলের দুর্বলতা রয়েছে। 

দলটির দুই ভাইস চেয়ারম্যান, এক যুগ্ম সম্পাদক নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার সংবাদকে বলেন, ২০ দল ভেঙে দিয়ে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করা, খালেদা জিয়াকে আটকের পর আন্দোলন না করা, দ্বাদশে সব দলকে নিয়ে এক ব্যানারে আন্দোলনে না এসে ৬৩ দলকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন করা— এসব প্রক্রিয়ার পেছনে মহাসচিবের ভূমিকা ছিল অনেক বেশি। আমাদের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) আটকের পর আন্দোলন না করা। আমাদের দলে রাজনীতিতে যারা অভিজ্ঞ ছিলেন, তাদের বড় অংশের দাবি আন্দোলন করা। কিন্তু মহাসচিবসহ একাংশের পক্ষ থেকে প্রস্তাব আসে খালেদা জিয়াকে এক সপ্তাহের মধ্যে ছেড়ে দেয়া হবে। আন্দোলন করলে খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন না। দিনশেষে সেই প্রস্তাবে আন্দোলনও নষ্ট হয়ে যায়। এরপর মহাসচিব অংশের দলের কিছু জ্যেষ্ঠ নেতা কারাগারে গিয়ে খালেদা জিয়াকে বুঝিয়ে আসেন— যদি বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, তাহলে সরকার সরে যেতে বাধ্য হবে। এরপর ড. কামাল, আ স ম আবদুর রব, সুলতান মনছুর নিয়ে এক মঞ্চে ওঠেন। বেলাশেষে মাত্র ছয়টি আসন পেয়ে ভরাডুবির পর আন্দোলনের অংশ হিসেবে ছয়জনকে সংসদে পাঠানো হয়। একইসঙ্গে দুটো নির্বাচন পার হয়ে যাওয়ার পরও এখনো দলের প্রধান নেত্রী খালেদা জিয়ার বিষয়েও কোনো ফলাফল আনা সম্ভব হয়নি।

শীর্ষ এই তিন নেতা আরও বলেন, এবার দ্বাদশে বিএনপির জয়ের জোয়ার উঠেছিল, মানুষ নদী সাঁতরেও শীতের সময় জনসভায় যোগ দিয়েছে। কূটনৈতিক বিষয়গুলো বিএনপির ঘরে ছিল, তবুও ‘অজানা রহস্যে’ কোনো কিছুরই ফলাফল আসেনি। যুক্তরাষ্ট্রসহ কূটনীতিকদের অনেকেই এবার বিএনপি-জামায়াতের এক ব্যানারের আন্দোলন চেয়েছেন। বিএনপির এক ভাইস চেয়ারম্যান জানান, বিএনপির কাছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু দেশ প্রস্তাব দিয়েছিল, যাতে বিএনপি-জামায়াত এক ব্যানারে আন্দোলন করে। তাহলে এ অঞ্চলে ভারতের যে চাপ রয়েছে, সেগুলো আন্দোলন পরিস্থিতির মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে কূটনীতিকভাবে সমাধানে নিয়ে আসা যাবে। কিন্তু  দলের গুটিকয়েকের বাধার কারণে তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এবার যদি এক মঞ্চের আন্দোলন হতো, তাহলে আওয়ামী লীগের এবার সরকার গঠন করা কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। বিএনপির জন্য এবার লজ্জার বড় বিষয় ছিল নেতাকর্মীরা রাজপথে থেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন আর আমাদের হাইকমান্ডের শীর্ষরা ঘর থেকে আটক হয়েছেন। আমাদের মহাসচিব, স্থায়ী কমিটির নেতারা যদি রাজপথের কর্মসূচি থেকে গ্রেপ্তার হতেন, তাহলে পরিস্থিতি আরও ভালো হতো। কর্মীদের কাছেও আস্থা এবং জবাব থাকত। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, দলের বড় অংশ এখনো কাউন্সিল চাচ্ছে না। কারণ তৃণমূল হাইকমান্ডের ওপর ক্ষুব্ধ। কাউন্সিল হলে যারা রাজপথের কর্মসূচির জন্য, কূটনৈতিক বিষয়ে দক্ষ— এমন নেতৃত্ব নিয়ে আসতে পারেন। এর ফলে  মহাসচিবসহ দলটির অনেক সিনিয়র নেতা নেতৃত্ব থেকে বাদ পড়ে যেতে পারেন। এজন্য একটি অংশ চাচ্ছে যেন কাউন্সিল না করে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ওপর দায়িত্ব তুলে দেয়া যায়। তাতে অন্তত সিনিয়ররা বাদ পড়বেন না। দলের মধ্যে একটি সিনিয়র-জুনিয়র সংমিশ্রণ থাকবে। কাউন্সিল হলে ক্ষুব্ধ নেতারা যে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারেন। তৃণমূল যে হাইকমান্ডের নেতৃত্বের ওপর ক্ষুব্ধ— এটি প্রায় স্পষ্ট। তবে খালেদা জিয়া-তারেক রহমানের নেতৃত্ব নিয়ে তৃণমূল থেকে শীর্ষ কারো মন্তব্য নেই। তারা খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে থাকবেন এবং তার অবর্তমানে তারেক রহমানের। এ দুই পদ ঠিক রেখে কাউন্সিল হলে অনেক পরিবর্তনই চলে আসবে। তাতে কপাল পুড়বে মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির অনেকের।     

রাজনীতিতে চোখ রাখা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ দলটিতে দৃশ্যপট একই! কোনো পরিবর্তন নেই বিএনপিতে। বারবার আন্দোলনে ব্যর্থ তারা। যেমন একাদশ নির্বাচন, তেমননি দ্বাদশ নির্বাচন। ভোট এলে জোট বাঁধে। সংখ্যা বাড়ে আর হুঙ্কার আসে; কিন্তু ভোট শেষে চুপসে যায়। দলটির রাজনীতিতে বারবার ঘুরেফিরে ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়। একবার ঘুরে দাঁড়ানোর পর ফের তছনছ। সব মিলিয়ে আলামত ভালো নয়। ২০১৬ সালের পর থেকে দীর্ঘ প্রায় আট বছর ধরে দলটির কাউন্সিল হচ্ছে না। মেয়াদোত্তীর্ণ এই কমিটি নিয়ে বিএনপিতে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি গণতন্ত্রের কথা বলে রাজনীতি করলেও তাদের দলেই গণতন্ত্র নেই। তাই তারা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) তোয়াক্কা করছে না। দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরাও বারবার জাতীয় কাউন্সিলের দাবি তুলছেন। কিন্তু বিএনপি হাইকমান্ড তাদের দাবি আমলে নিচ্ছেন না। কেন্দ্রীয় কমিটির ১৩০টির মতো পদ এখন শূন্য। বয়সজনিত কারণেও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয় রয়েছেন দলটির কোনো কোনো নেতা। বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটিতে বর্তমানে পদ রয়েছে ১৯টি। এর মধ্যেও পাঁচটি পদ খালি রয়েছে। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সর্বশেষ ২০১৬ সালের মার্চে কাউন্সিল করে বিএনপি। ওই বছরের আগস্টে ১৭ সদস্যের স্থায়ী কমিটি ঘোষণা করে তারা। স্থায়ী কমিটিতে পদ রয়েছে ১৯টি। তখন থেকেই দুটি পদ এখনো শূন্য রয়েছে। এরপর এম কে আনোয়ার, তরিকুল ইসলাম, আ স ম হান্নান শাহ ও মওদুদ আহমদ মারা গেলে ছয়টি পদ শূন্য হয়। সাবেক সেনাপ্রধান মাহবুবুর রহমান পদত্যাগ করায় শূন্যপদ দাঁড়ায় সাতটিতে। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ২২ জুন সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে স্থায়ী কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হলে এখন পাঁচটি পদ খালি রয়েছে। বর্তমানে স্থায়ী কমিটিতে রয়েছেন দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, খন্দকার মোশাররফ হোসেন, জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, রফিকুল ইসলাম মিয়া, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ, সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু।

জানতে চাইলে সাবেক ছাত্রনেতা মিলন মিয়া আমার সংবাদককে বলেন, আমাদের তৃণমূলে আসলে করণীয় কী, সে বিষয়ে আমরা সঠিক বার্তা থেকে দূরে ছিলাম। সিনিয়র নেতাদের নিয়ে আমাদের অনেক অভিযোগ রয়েছে। আমরা রাজপথ থেকে আটক হই, ঘরে যেতে পারি না। আর আমাদের নীতিনির্ধারকরা বেডরুম থেকে আটক হন। সব মিলিয়ে আমাদের মধ্যে না আছে কোনো চিন্তার স্বচ্ছতা, না আছে কাজকর্মের স্বচ্ছতা। এ কারণেই আজ বিনপির এই ভঙ্গুর অবস্থা। আমাদের নেতৃত্ব সংস্কারের জন্য অবশ্যই কাউন্সিল করা দরকার। আমরা খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের ওপর পূর্ণ ভরসা রাখি। একইসঙ্গে আমাদের আরও যারা নীতিনির্ধারণী ফোরাম আছে, সেখানেও আস্থা আবশ্যক। বারবার একটি কথা আসে— ‘মির্জা ফখরুলের বিকল্প কে? সেটা কাউন্সিল হলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে’— যোগ করেন এই তৃণমূল নেতা। 

জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান আমার সংবাদকে বলেন, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান এ দুজনের বিষয়ে আমাদের তৃণমূল থেকে হাইকমান্ড কারো কোনো প্রশ্ন নেই। খালেদা জিয়া আমাদের প্রধান নেতা। তার অবর্তমানে তারেক রহমান। কাউন্সিল হলেও তৃণমূলরা এ দুজনের বিষয়ে কোনো আপস করবেন না। আমাকে যদি বলেন, আমিও বলব দলে মির্জা ফখরুলের কোনো বিকল্প নেই। তার মতো স্বচ্ছ ও ত্যাগী এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এমন নেতা খুব কমই আছে। এরপরও কাউন্সিল হলে সেখানে অবশ্যই নেতারা ভরসা রাখবেন। এখন যে পরিস্থিতি, তাতে কাউন্সিল হবে কি না বলা দুষ্কর; এটা নিয়ে কিছু আলোচনা আছে। তবে কাউন্সিল না হলেও আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে সেই ক্ষমতা দেয়া আছে। তিনি যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। 

বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘আমরা বৃহৎ রাজনৈতিক দল। আমাদের কাউন্সিল তো করতেই হবে। সময়-সুযোগ করে আমরা তা করব। তবে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কাউন্সিলের তারিখ নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। কে আসবে-কে আসবে না, সেটা বলা মুশকিল; কাউন্সিল হলে কাউন্সিলররাই সিদ্ধান্ত নেবেন।’
 

Link copied!