Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ০৪ মে, ২০২৪,

স্বাস্থ্যসেবায় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী উদ্যোগ

তৃণমূলের আস্থা কমিউনিটি ক্লিনিক

সাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া

সাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া

এপ্রিল ২২, ২০২৪, ০১:৩৫ পিএম


তৃণমূলের আস্থা কমিউনিটি ক্লিনিক

সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে কাজ করছে কমিউনিটি ক্লিনিক, স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা বাস্তবায়নে আরও বাড়ানো হচ্ছে সংখ্যা 
—অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন, মন্ত্রী, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়

প্রধানমন্ত্রীর কমিউনিটি ক্লিনিক ধারণা বিশ্বজুড়ে সমাদৃত হয়েছে, অনেক দেশেই আমাদের কমিউনিটি ক্লিনিক মডেল নিয়ে কাজ করছে 
—অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী, সভাপতি, কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টি বোর্ড

গণমুখী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে আস্থার ঠিকানা হিসেবে কাজ করছে কমিউনিটি ক্লিনিক। দেশ স্বাধীনের পর সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে প্রথম কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবার ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বলেছিলেন, কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে যাবে। তার যুগোপযোগী ধারণা বাস্তবায়িত হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে। ২০০০ সালের ২৬ এপ্রিল গোপালগঞ্জ জেলার পাটগাতী ইউনিয়নে গিমাডাঙ্গা কমিউনিটি ক্লিনিকের উদ্বোধনের মাধ্যমে জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের যাত্রা শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে যাত্রা কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবায় বিপ্লব ঘটিয়েছে। যার স্বীকৃতিও এসেছে দেশ-বিদেশ থেকে। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের অভিনব ধারণা বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিক করতে জনগণ জমি দিয়ে থাকে আর সরকার সেই জমিতে অবকাঠামো নির্মাণ থেকে শুরু করে জনবল ও ওষুধ সরবরাহ করে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে। 

দেশের তৃণমূল স্বাস্থ্যসেবায় অত্যন্ত ফলপ্রসূ কমিউনিটি ক্লিনিক ব্যবস্থা নিয়ে বিশ্বসমপ্রদায়েরও রয়েছে ব্যাপক আগ্রহ। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক বাংলাদেশ সফরের সময় গ্রামে গিয়ে কমিউনিটি ক্লিনিক ঘুরে দেখেছিলেন। কমিউনিটি ক্লিনিকের সাফল্য নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার একটি পুস্তিকার নাম ‘কমিউনিটি ক্লিনিক’ হেলথ রেভ্যুলেশন ইন বাংলাদেশ। কমিউনিটি ক্লিনিকের অগ্রযাত্রায় ‘শেখ হাসিনার অবদান, কমিউনিটি ক্লিনিক বাঁচায় প্রাণ’ স্লোগানটি কমিউনিটি ক্লিনিকের ব্রান্ডিং কার্যক্রমে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ধারণা কমিউনিটি ক্লিনিক বাস্তবায়ন সহজ ছিল না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে ও পরে স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামোগুলো ছিল মূলত শহরকেন্দ্রিক। অথচ সে সময় ৮৫ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করতেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার। বঙ্গবন্ধুই স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় অর্থাৎ সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে মাত্র তিন বছরেই তিনি প্রতিটি থানায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স’। চালু করেছিলেন ১০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল। 

কিন্তু পঁচাত্তরের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে তিনি সপরিবারে নিহত হওয়ার পর তৃণমূল মানুষের স্বাস্থ্যসেবার দিকে আর গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ২১ বছর পরে ১৯৯৬ সালের মাঝামাঝি আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পরপরই জাতির জনকের কন্যা পিতার স্বপ্ন ‘সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা’ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। জন্ম দেন অভিনব ধারণা ‘কমিউনিটি ক্লিনিক’। কিন্তু সরকার পরিবর্তন হলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয় তৃণমূলের জনগণের জন্য কল্যাণকর এই সফল স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমটি। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসেই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে ক্লিনিকগুলো। নষ্ট হয়ে যায় অনেক ভবন।

২০০৮ সাল পর্যন্ত বন্ধ ছিল ক্লিনিকগুলো। ২০০৯ সালে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার আবার কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম চালু করে। পরিত্যক্ত ব্যবহার অযোগ্য ভবনগুলো সংস্কার ও নতুন ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করে। দ্রুত বাড়তে থাকে কমিউনিটি ক্লিনিকের সংখ্যা। ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে কমিউনিটি ক্লিনিক ব্যবস্থাকে একটি আইনি কাঠামোতে ঢেলে সাজানো হয়। ২০১৮ সালে ‘কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট-২০১৮’ নামে একটি আইন করা হয়। এই আইন ও স্ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের ফলে ক্লিনিকের কার্যক্রম পরিচালনা এবং জনবলের বেতন-ভাতাদিসহ আর্থিক ব্যয়ভার নিশ্চিতের জন্য অর্থ সংগ্রহের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সারা দেশে মোট ১৪ হাজার ৮৯০টি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। 

ইতোমধ্যে নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে ১৪ হাজার ৩১৮টি। বর্তমানে চালু রয়েছে ১৪ হাজার ২৭৫টি। গ্রামীণ জনপদের প্রতি ছয় হাজার মানুষের জন্য একটি করে ক্লিনিক তৈরি করা হয়েছে। ২০ থেকে ৩০ মিনিটের হাঁটার দুরত্বে স্বাস্থ্য সেবা পাওয়া যাবে এমন পরিকল্পনায় ক্লিনিকগুলোর স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। কমিউনিটি সেন্টারে ১৩ হাজার ৬৬৭ জন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) কর্মরত আছেন। এ ছাড়া আরও ৬৫১ জনকে শূন্য পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যে জনবল মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্য পরিচর্যা, প্রতিষেধক টিকা (যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, হুপিং কফ, পোলিও, ধনুষ্টংকার, হাম, হেপাটাইটিস-বি, নিউমোনিয়া ইত্যাদি) এবং শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা, পরিবার পরিকল্পনা-বিষয়ক স্বাস্থ্যসেবার মতো প্রাথমিক পর্যায়ের প্রায় ৩০টিরও বেশি রোগের চিকিৎসা ও পরামর্শ দিয়ে থাকে। 

শুরুতে কমিউনিটি ক্লিনিকে সন্তান প্রসবের ব্যবস্থা ছিল না। তবে এখন দেশের প্রায় তিন শতাধিক  কমিউনিটি ক্লিনিকে নরমাল ডেলিভারি বা স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসব করানোর সেবা দেয়া হচ্ছে। কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে মানুষকে বিনামূল্যে ৩২ ধরনের ওষুধ দেয়া হয়। অসচ্ছল ও দরিদ্র ডায়াবেটিক রোগীরা বিনামূল্যে ইনসুলিনও পাচ্ছেন। বিনামূল্যে বিতরণের জন্য সরকার প্রতি বছর ৩০০ কোটি টাকার বেশি ওষুধ দেয়, যা ইডিসিএল থেকে নিয়ে থাকে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রমকে পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে। জাতিসংঘের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বিশ্বব্যাংক, জাইকা, ইউনিসেফ ইত্যাদি সংস্থা আর্থিক, কারিগরি ও লজিস্টিক সরবরাহের মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম বাস্তবায়নে সহযোগিতা করছে।

এ ছাড়া বিভিন্ন এনজিও কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবার মানোন্নয়নে কাজ করছে। কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের তথ্য বলছে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৪১ কোটির অধিক ভিজিটের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগণ কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে সেবা গ্রহণ করেছেন। যাদের অধিকাংশ নারী ও শিশু। গড়ে প্রতিটি ক্লিনিকে প্রতিদিন ৩৮ জন সেবাগ্রহীতা সেবা গ্রহণ করে থাকেন। কমিউনিটি ক্লিনিক পরিচালনায় স্থানীয় জনগণের ভূমিকা অপরিসীম। সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ইউনিয়নস্থ সব কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রধান পৃষ্ঠপোষক এবং সংরক্ষিত আসনের নির্বাচিত মহিলা সদস্যরাও সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের মহাবিদ্যালয়-মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষরা কমিউনিটি ক্লিনিকের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করছেন। দেশের বর্তমান কমিউনিটি ক্লিনিকের অগ্রযাত্রা ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে আমার সংবাদের সঙ্গে কথা বলেন কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী। 

তিনি বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিক প্রধানমন্ত্রীর একটি উদ্ভাবনী উদ্যোগ। জনগণকে সম্পৃক্ত করে জণগণের সেবা নিশ্চিত করণের নতুন ধারণা স্বাস্থ্য খাতে এটিই প্রথম। এটি পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের এক অনন্য উদাহরণ। বিশ্বের অনেক দেশ প্রান্তিক পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে আমাদের কমিউনিটি ক্লিনিক মডেল নিয়ে কাজ করছে। আমাদের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য খাতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে সব বয়সের সব মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবা ও কল্যাণ নিশ্চিত করা কমিউনিটি ক্লিনিকের মূল্য উদ্দেশ্য। 

কমিউনিটি ক্লিনিকের ধারণা ও স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণের বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেছেন, বাংলাদেশে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের চিন্তা এবং এর সমপ্রসারণ সবই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মস্তিষ্কনিঃসৃত। প্রধানমন্ত্রীর এই দূরদর্শী চিন্তার ফসল হিসেবে স্বাস্থ্যসেবা এখন বাংলাদেশের একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে চলে গেছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে মানুষ প্রাথমিক পর্যায়ের সব সেবা ও বিনামূল্যে ওষুধ দেয়া হচ্ছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে কমিউনিটি ক্লিনিক অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। দেশে কমিউনিটি ক্লিনিকের সংখ্যা আরও বাড়ানোর কাজ চলছে। উন্নত সমৃদ্ধশালী স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করবে কমিউনিটি ক্লিনিক।


 

Link copied!