নিজস্ব প্রতিবেদক
আগস্ট ৪, ২০২৫, ১২:০৬ এএম
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক রূপান্তরের প্রেক্ষাপটে সংবিধান সংশোধনের প্রশ্নটি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। বিশেষত ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণ-আন্দোলন ও ২০২৫ সালের ‘জুলাই সনদ’-এর প্রেক্ষিতে অনেকেই বলছেন, বর্তমান সংবিধান জনগণের ইচ্ছা ও প্রতিনিধিত্ব যথাযথভাবে প্রতিফলিত করতে পারছে না। ফলে প্রশ্ন উঠছে— সংবিধান কি সংসদের বাইরেও সংশোধিত হতে পারে?
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, শুধুমাত্র জাতীয় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সংবিধান সংশোধন সম্ভব। আদালতও বারবার এই বিধানকে সমর্থন করেছে, যেমন- আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বনাম বাংলাদেশ মামলায়। তবে বর্তমান বাস্তবতায়, যেখানে সংসদ নেই এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র চালাচ্ছে, সেই পরিস্থিতিতে এই ধারা কার্যকর কীভাবে তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।
কিছু সংবিধান বিশেষজ্ঞ, যেমন- ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ও অধ্যাপক রণদাপ্রসাদ সাহা বলেন, যদি বিদ্যমান ব্যবস্থা জনগণের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তবে ‘জনগণের সার্বভৌম ইচ্ছা’ অনুযায়ী একটি নতুন সংবিধান বা ট্রানজিশনাল চার্টার তৈরি হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ফ্রান্স (১৭৮৯), দক্ষিণ আফ্রিকা (১৯৯৪) ও নেপাল (২০০৭)-এর মতো বিপ্লবোত্তর বাস্তবতায় দেখা গেছে যে জনগণই নতুন সাংবিধানিক কাঠামো তৈরি করেছে।
বিচার বিভাগ বহুবার বলেছে, সংবিধানের ‘মৌলিক কাঠামো’ পরিবর্তনযোগ্য নয়, এমনকি সংসদের মাধ্যমেও নয়। ফলে কোনো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা গণচাপ যদি পরিবর্তন আনে, আদালত তা পরীক্ষা করে দেখবে জনগণের ইচ্ছা ও গণতান্ত্রিক বৈধতা এতে প্রতিফলিত হয়েছে কি না। বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ‘জুলাই বিপ্লব’ ও এর পরের অন্তর্বর্তী সরকার একটি নতুন রূপরেখা তুলে ধরেছে, যেখানে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ, স্বাধীন বিচার বিভাগ ও মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। তবে প্রশ্ন উঠছে— সংসদের বাইরের এমন প্রস্তাবনা কিভাবে বৈধতা পাবে? বিশিষ্ট আইনজীবী আবু হেনা রাজ্জাক বলেন, ‘দেশে তো এখন কোনো কার্যকর সংবিধান নেই। অলিখিত সংবিধানে দেশ চলছে। যা ড. মুহাম্মদ ইউনূস করেন, সেটিই এখন বাস্তব সংবিধান।’
তিনি বলেন, শেখ হাসিনা সংসদ না ভেঙে পালিয়ে যাওয়ার পরই সংসদ বিলুপ্ত হয়ে গেছে, রাষ্ট্রপতিও আর বৈধ নন। তার প্রশ্ন— যদি এখন সংবিধান থাকত, তাহলে ৮ আগস্ট থেকে ৭ নভেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না দিয়ে কেন রাজনৈতিক দলগুলো ইউনূসের কাছেই নির্বাচন চাচ্ছে? সাবেক জেলা জজ ইকতেদার আহমেদ বলেন, ‘অধ্যাদেশ দিয়ে সংবিধান সংশোধন সম্ভব নয়। এজন্য সংসদেই দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন দরকার।’ সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিকীও বলেন, ‘সামরিক শাসনকালেও সংবিধান সংশোধনের পর সংসদের অনুমোদন নিতে হয়েছে।’
সংবিধান প্রণেতা ও প্রাক্তন আইনমন্ত্রী হিসেবে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘জনগণের ইচ্ছা থাকলেও তা সংসদের মাধ্যমে বৈধতা পেতে হবে।’ তবে তিনি গণ-আন্দোলনের বাস্তবতা স্বীকার করে বলেন, ‘গণভোট বা নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে পরিবর্তন সম্ভব।’
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের অভিমত। তিনি বলেন, ‘যখন সংসদ পুরোপুরি বৈধতা হারায়, তখন জনগণের ঐচ্ছিক ক্ষমতা ফিরে আসে।’ তার মতে, ‘এটি সংবিধান লঙ্ঘন নয়, বরং এক নতুন সংবিধানিক আত্মপ্রতিষ্ঠা।’
সালাহউদ্দিন আহমেদ- সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘সংবিধান একটি চুক্তিগত দলিল। যদি তা যুগোচিত না থাকে, জনগণ সেটি পাল্টাতে পারে।’ তবে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক বাস্তবতা প্রাথমিকভাবে বৈধতা দিতে পারলেও, বিচারিক ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পেলে তা টেকসই হবে না।’
বর্তমানে বাংলাদেশ এক সংবিধানিক সন্ধিক্ষণে। ‘জুলাই সনদ’-এর মতো প্রস্তাবনায় নতুন কাঠামো সামনে এলেও তা কিভাবে আইনি ও রাজনৈতিক বৈধতা পাবে, তা নিয়ে রয়েছে মতভেদ। তবে একটিই বিষয় পরিষ্কার: জনগণের ইচ্ছা যদি প্রকৃত ও সুস্পষ্ট হয়, তবে তা কোনো না কোনোভাবে আইনত রূপ নিতে বাধ্য। কিন্তু সেই পথে গণতান্ত্রিক ও বিচারিক স্বীকৃতি না এলে তা স্থায়ী হবে না।