ইয়ামিনুল হাসান আলিফ
আগস্ট ২০, ২০২৫, ১১:৫৩ পিএম
বিপদ সংকেত শব্দ দুটি শুনলেই মানসপটে চলে আসে আবহাওয়া বার্তা আর এক অজানা আতঙ্ক। বাংলাদেশে উজানের বৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল ও ভূমিধসের কারণে ঘনঘন বন্যা দেখা দেয়। এতে হাজারো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়, ডুবে যায় ফসলের জমি। ঘূর্ণিঝড়, খরা, কালবৈশাখী ঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠছে। গবেষণা বলছে, যেভাবে তাপমাত্রা বাড়ছে, তা পূর্বাভাসের চেয়েও দ্রুত। এই প্রেক্ষাপটে আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য ও পূর্বাভাস অত্যন্ত জরুরি। কারণ, কৃষি, স্বাস্থ্য, শিল্প, পরিবহন থেকে শুরু করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায়ও আবহাওয়ার তথ্য বড় ভূমিকা রাখে। নদীপথ, মৎস্য, বিমান চলাচল থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রেই আবহাওয়ার প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক সময়ে আবহাওয়া দপ্তর এগিয়েছে উল্লেখযোগ্য গতিতে।
শুধু বিপদ সংকেতেই থেমে নেই, বরং দুর্যোগ মোকাবিলায় ভূমিকা রাখার পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। নতুন রাডার আর স্যাটেলাইট বিশ্লেষণে বিপদ সংকেত প্রদানের জায়গা থেকেই কৃষি, বাণিজ্য, পরিবহনসহ সব ক্ষেত্রে নতুন দুয়ার খুলেছে, নতুন পথে এগিয়েছে বাংলাদেশ।
জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর গত কয়েক বছরে যেসব কার্যক্রম হাতে নিয়েছে, তা শুধু প্রযুক্তিনির্ভর নয়, বরং জনকেন্দ্রিক এবং টেকসই উন্নয়ন অভিমুখে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কৃষক, উপকূলবাসী এবং দুর্যোগ-প্রবণ জনগোষ্ঠীর জন্য আগাম পূর্বাভাস এবং সময়োপযোগী তথ্য সরবরাহের মাধ্যমে এই সংস্থাটি দেশের জলবায়ু ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. মোমিনুল ইসলাম বলেন, ‘অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে কাজের অগ্রগতি বেড়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় পূর্বাভাস দেয়া হয়। গাজীপুর ও রংপুরে দুটি রাডার চালু হয়েছে। ফলে রাডারের তথ্য বিশ্লেষণ করে দ্রুত আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেয়া সহজ হচ্ছে। এছাড়া চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার স্যাটেলাইটের মাধ্যমে আপডেট তথ্য পাচ্ছি। ফলে যতটা সম্ভব নির্ভুল তথ্য ও পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব হচ্ছে। এতে পূর্বের থেকে অনেকাংশে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও প্রাণহানি কমানো সম্ভব হচ্ছে।’
বাংলাদেশের কৃষকরা দীর্ঘদিন ধরে আবহাওয়া পরিবর্তন নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগতেন। বৃষ্টির সময় বদলে যাওয়া, অনাকাঙ্ক্ষিত খরা বা অতিবৃষ্টির কারণে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি প্রায় নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে পড়েছিল। এই প্রেক্ষাপটে কৃষকদের জন্য চালু হয়েছে দীর্ঘমেয়াদি আবহাওয়ার পূর্বাভাস সেবা, যা বেশ আগে থেকেই আবহাওয়ার একটি চিত্র বা অবস্থান প্রদান করা হয়। ফলে কৃষকরা আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছে ঠিক কখন বীজ বপন করবেন, সেচ দেবেন, কীটনাশক প্রয়োগ করবেন কিংবা ফসল কেটে তুলবেন। এমন কার্যকর পূর্বাভাসে কৃষক শুধু ফসল রক্ষা করছেন না, বরং উৎপাদনও বাড়ছে।
এই সেবায় ব্যবহূত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি, যার মাধ্যমে আগের ডেটা বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতের প্রবণতা নির্ধারণ করা সম্ভব হচ্ছে। আবহাওয়ার সাথে সামঞ্জস্য রেখে কৃষি ক্ষেত্রকে এগিয়ে নিতে একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালু করা হয়েছে। বাংলাদেশ অ্যাগ্রোমেটিওরোলজিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেম বা বিএএমআইএস নামের এই অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, যেখানে কৃষি ও আবহাওয়ার তথ্য একসাথে পাওয়া যায়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকরা এখান থেকে জানতে পারেন তাদের এলাকার তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, বাতাসের গতি, মাটির আর্দ্রতা ইত্যাদি তথ্য। পাশাপাশি দেশের উপজেলাগুলোতে ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ড, এনালগ বোর্ড, কিওস্ক ও মোবাইল ট্যাবলেটের মাধ্যমে তথ্য পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ফলে একজন কৃষক মোবাইল ফোন না থাকলেও নিজের ইউনিয়ন অফিসে গিয়েই আবহাওয়ার হালনাগাদ তথ্য পেয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশের উপকূলীয় ও নদী বিধৌত অঞ্চলগুলো ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও বজ্রপাতের ঝুঁকিতে থাকে। এই ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় আবহাওয়া অধিদপ্তর ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর মিলে ‘পূর্বাভাসভিত্তিক ব্যবস্থা’ চালু করেছে। এর আওতায় কোনো দুর্যোগের সম্ভাবনা দেখা দিলে আগাম সতর্কবার্তা পাঠানো হয়, সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সহায়তা দেয়া হয় যেন তারা দুর্যোগের আগে প্রস্তুতি নিতে পারে। এই কার্যক্রমের ফলে সাম্প্রতিক সময়ে বন্যার আগেই অনেক পরিবার উঁচু জায়গায় উঠতে পেরেছে, গৃহপালিত পশু রক্ষা করতে পেরেছে, খাদ্য মজুত করতে পেরেছে, যা একটি বড় সাফল্য হিসেবে ধরা যায়। দুর্যোগের আগেই ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালনাও সহজ হয়েছে। আবহাওয়া পূর্বাভাস ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের কার্যক্রম আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশংসিত হচ্ছে।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আবহাওয়া সংস্থাগুলোর প্ল্যাটফর্মের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ নিয়মিত প্রযুক্তি ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করছে। তিন দেশের স্যাটেলাইট থেকে তথ্য আসছে।
এ বিষয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. মোমিনুল ইসলাম বলেন, ‘শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ করে আমাদের দেশে এর প্রভাব কেমন হবে তা জানিয়ে দেয়া হয়। পূর্বে প্রাকৃতিক দুর্যোগে হতাহতের সংখ্যা বেশি ছিল, বর্তমানে আবহাওয়ার পূর্বাভাস ও প্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে তা অনেকাংশে কমে এসেছে।’
আবহাওয়া অধিদপ্তরের জনবল কম হওয়ায় কাজের চাপ বেশি স্বীকার করে পরিচালক মো. মোমিনুল ইসলাম বলেন, ‘লোকবল কম হওয়ায় একই ব্যক্তি দুই থেকে তিন বিভাগের কাজ করতে হচ্ছে। অফিস ছুটির পরও অনেক সময় কাজ করতে হয়। ডেটা সেন্টার থেকে সার্বক্ষণিক বিভিন্ন ধরনের তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। যত বেশি যন্ত্রপাতি, আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত হবে তত বেশি সমৃদ্ধ হবো। আমরা প্রযুক্তিগতভাবে অনেকদূর এগিয়েছি, আরও সামনে এগিয়ে যাব। আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স ব্যবহার নিয়েও আমাদের আজ মিটিং আছে।’
আবহাওয়া তথ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এই চাহিদা পূরণে নতুনভাবে আবহাওয়াবিদ ও কৃষি-আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ তৈরি করা হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুনভাবে আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগ চালু হয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা আধুনিক প্রযুক্তি ও তথ্য ব্যবস্থাপনা শিখছেন। পরিবেশ সচেতনতার আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতন করা এবং তাদের পরিবেশবান্ধব নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন সভা-সেমিনার ও কর্মসূচিও গ্রহণ করা হচ্ছে।
এছাড়া, আবহাওয়াবিদদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মশালা, আন্তর্জাতিক স্কলারশিপ এবং বিদেশে পাঠানোর উদ্যোগও নেয়া হয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে। এ বিষয়ে অধিদপ্তরের পরিচালক মো. মোমিনুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগের জন্য ৩০ কোটি টাকা ফান্ডিং করা হয়েছে। স্যাটেলাইেটর তথ্য যাতে শিক্ষার্থীরা দেখতে পারে, এ জন্য ডেটা সেন্টার চালু করা হয়েছে। যাতে আগে থেকেই আবহাওয়া বিষয়ে দক্ষ জনবল এখানে যুক্ত হতে পারে।’
আবহাওয়া অধিদপ্তরের এই পরিবর্তনশীল ও প্রযুক্তিনির্ভর কার্যক্রম এক নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রতিচ্ছবি। এটি শুধু আবহাওয়ার সেবা নয়, বরং টেকসই কৃষি, দুর্যোগ প্রতিরোধ এবং জলবায়ু অভিযোজনের পথনির্দেশনা। কৃষকের মুখে হাসি, দুর্যোগে প্রাণহানির হার হ্রাস এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা, সবই প্রমাণ করে বাংলাদেশ এখন শুধু সমস্যায় পড়ে কাজ করছে না, বরং আগেভাগেই প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন একটি জনমুখী, দূরদর্শী ও তথ্যভিত্তিক আবহাওয়া সেবা ব্যবস্থাই পারে বাংলাদেশকে জলবায়ু বিপদের মধ্যেও একটি নিরাপদ ও টেকসই ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিতে।