নিজস্ব প্রতিবেদক
আগস্ট ১৪, ২০২৫, ১২:০০ এএম
সরকারের গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে কর্ণফুলী টানেল। বিগত সরকারের আমলে নির্মিত ব্যয়বহুল কর্ণফুলী টানেল চালুর পর থেকেই লোকসানে রয়েছে। টোল বাবদ যা আয় হচ্ছে তা দিয়ে উঠছে না টানেলটির পরিচালন ব্যয়ই, বরং ব্যয় মেটাতে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ গুনতে হচ্ছে। এ ধারাবাহিকতায় চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরও বজায় থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
সেক্ষেত্রে চলতি অর্থবছর সেতু কর্তৃপক্ষের প্রাক্কলন অনুযায়ী টানেল থেকে ১৬৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হতে পারে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত টানেলের ভেতর কৃত্রিম অক্সিজেন ও আলো সরবরাহ, সামগ্রিক নিরাপত্তা ও সার্বক্ষণিক জরুরি নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখতে হয়। যে কারণে অত্যন্ত ব্যয়বহুল টানেলটি পরিচালন ব্যয়। নির্মাণের পর টানেলটিতে দুই ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ দরকার। একটি হলো প্রতিদিনকার রক্ষণাবেক্ষণ, বিদ্যুৎ সরবরাহ, কার্বন ডাই-অক্সাইড অপসারণ করে অক্সিজেন সরবরাহসহ দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজ এতে অন্তর্ভুক্ত। আর প্রতি পাঁচ বছর পর একবার বড় ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ।
তাছাড়া কর্মীদের বেতন, বিদ্যুৎ-জ্বালানিসহ আনুষঙ্গিক পরিচালন ব্যয় তো রয়েছেই। বিপরীতে ওই পথে চলাচল করা যানবাহন থেকে আদায় হওয়া টোলই আয়ের প্রধান খাত। কর্ণফুলী টানেল পরিচালনার দায়িত্বে চীনের বহুজাতিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড রয়েছে। কোম্পানিটির সঙ্গে পাঁচ বছরের চুক্তি করেছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। চুক্তিমূল্য ৯৮৪ কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, বিগত ২০২৩ সালের অক্টোবরে টানেলটি উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনের পর ২০২৩-২৪ অর্থবছর টানেল রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা বাবদ ব্যয় হয় ১৭৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। একই অর্থবছর সংস্থাটি প্রায় ৮৭ লাখ টাকা টোল অব্যাহতি দেয়। সব মিলিয়ে পরিচালন ব্যয় হয় ১৭৫ কোটি টাকার বেশি। বিপরীতে টোল আদায় হয় কেবল ২৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা। ওই হিসাবে কর্ণফুলী টানেল চালুর পর প্রথম অর্থবছরই প্রায় ১৪৭ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়।
আর সদ্য সমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কর্ণফুলী টানেল রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা বাবদ ব্যয় হয় ২২২ কোটি ২২ লাখ টাকা। এ অর্থবছরও ৭৮ লাখ টাকার বেশি টোল অব্যাহতি দেয়া হয়। তাছাড়া টানেলের বাইরে রাস্তা ও মহাসড়ক সংস্কারে আড়াই কোটি টাকা ব্যয় হয়। এর বাইরে স্যানিটেশন ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থার জন্য আরও ৯০ লাখ টাকা ব্যয় হয়। সব মিলিয়ে ২২৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয় হয়। বিপরীতে মাত্র ৩৮ কোটি ৫৮ লাখ টাকা টোল আদায় হয়েছে। এ হিসাবে গত অর্থবছরে কর্ণফুলী টানেল প্রায় ১৮৯ কোটি টাকা লোকসান করেছে।
সূত্র আরও জানায়, চীনের ঋণে কর্ণফুলী টানেল ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকায় নির্মাণ করা হয়েছে। সমীক্ষা অনুযায়ী ২০২৫ সালে এ টানেল দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলার কথা থাকলেও বাস্তবে এর চেয়ে কয়েক ভাগ কম যানবাহন চলছে। চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের তথ্য বলছে, গত এপ্রিলে প্রতিদিন গড়ে ৪ হাজার ১৫টি যানবাহন টানেল ব্যবহার করেছে। কর্ণফুলী টানেল চালুর পর প্রথম দুই অর্থবছরের লোকসানের ধারা চলতি অর্থবছরেও অব্যাহত রয়েছে।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষও টানেল থেকে বড় অংকের লোকসান হবে বলে ধরে নিয়েছে। প্রায় ১৭০ কোটি টাকা লোকসানের পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি। পূর্বাভাস অনুযায়ী চলমান অর্থবছরে কর্ণফুলী টানেল থেকে টোল আদায় হবে ৩৯ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। বিপরীতে টানেল পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণে সব মিলিয়ে ব্যয় হবে ২০৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
এদিকে পরিচালন ব্যয় কমিয়ে এবং রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে টানেলটি লাভজনক পর্যায়ে নিতে সরকার কাজ করছে বলে সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ আবদুর রউফ জানিয়েছেন।
তিনি জানান, এখন গাড়ি যেহেতু কম চলছে, সেহেতু পরিচালনার জন্য জনবলও কমিয়ে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি যেখানে যতটা সম্ভব পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় কমিয়েছে। এরই মধ্যে টানেলের রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালন খাতের ব্যয় প্রায় ১০০ কোটি টাকা কমানো সম্ভব হয়েছে। তাছাড়া লোকসান কমিয়ে আনার জন্য টানেল দিয়ে যাতে ঢাকা-কক্সবাজারের সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হয়, সে লক্ষ্যেও কাজ করা হচ্ছে।
কর্ণফুলীর আনোয়ারা প্রান্ত ও কক্সবাজার প্রান্ত যে সড়কে মিলেছে, সেখানে একটি সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। সড়কটি নির্মাণ হয়ে গেলে পতেঙ্গা থেকে টানেল দিয়ে এ রাস্তায় সহজেই যানবাহন চলে আসতে পারবে এবং ঢাকা-কক্সবাজারের মধ্যে একটি যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হবে। ঢাকা থেকে যে গাড়িগুলো যাবে, সেগুলো চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ না করেই টানেল দিয়ে অনেক কম সময়ে যাতায়াত করতে পারবে। তখন এ পথে যানবাহনের সংখ্যা বেড়ে যাবে এবং আয়ও বাড়বে।