Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

জুয়ায় ১০০ টাকা হেরে একযুগ আত্মগোপনে ছিলেন সুমন!

মো. মাসুম বিল্লাহ

মে ২৪, ২০২২, ০৭:৪০ পিএম


জুয়ায় ১০০ টাকা হেরে একযুগ আত্মগোপনে ছিলেন সুমন!

দুই হাজার দশ সালে ১০০ টাকা হেরে ১২ বছর আত্মগোপনে ছিলেন সুমন (৩০)।রাজধানীর পল্লবী থানায় দায়ের করা একটি অপহরণ মামলার রহস্য উদঘটন করেছে পিবিআই। মামলায় উল্লিখিত সুমন (৩০) আসলে অপহৃত হননি। জুয়া খেলায় হেরে বাবার ভয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যান।

মঙ্গলবার (২৪ মে) দুপুরে এ তথ্য জানিয়েছেন পুলিশ ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো-পিবিআই’র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু ইউসুফ। পিবিআই’র দেওয়া তথ্যমতে, ২০১০ সালের ৩১ আগস্ট সকালে পল্লবীর মো. মোজাফ্ফর (৫২) নামে এক ব্যক্তির ১৭ বছরের ছেলে সুমন বাসা থেকে তার কর্মস্থল ডায়মন্ড প্যাকেজিং গার্মেন্টস এর উদ্দেশে বের হন। পরে তিনি আর বাসায় ফিরে আসেননি। তার মোবাইল নম্বরও বন্ধ পাওয়া যায়। ঘটনার দুই মাস পর বাবা মোজাফ্ফর তার ছেলের নিখোঁজের বিষয়ে পল্লবী থানায় একটি জিডি করেন। এরপর মোজাফ্ফর বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারেন যে, আসামি মো. সুলায়মান হোসেন (২৮), শাওন পারভেজ (১৮), মো. রুবেল (২০), সোহাগ (২০) ও মানিক (২৫) নামে কয়েকজন তরুণ তার ছেলে সুমনকে অফিসে যাওয়ার পথে মার্ক ডিজাইন গার্মেন্টসের সামনে থেকে অপহরণ করেছে। এরপর ২০১০ সালের ২৯ অক্টোবর মোজাফ্ফর পল্লবী থানায় একটি অপহরণ মামলা দায়ের করেন।

মামলাটি প্রথমে পল্লবী থানার এস.আই মো. হাবিবুর রহমান তদন্ত করেন। এরপর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত শুরু করে। তারা সুমনের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি উদ্ধার করে এবং মামলার আসামি সুলাইমান,পারভেজসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। পুলিশ আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আদালতে সোপর্দ করে। পরে এই মামলা আরও দুজন তদন্ত করেন। এরপর পুলিশ সদর দফতরের আদেশে মামলাটির তদন্তভার সিআইডির ওপর অর্পণ করা হয়। সিআইডি ২০১২ সালের ২৫ এপ্রিল মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে। তদন্তে তারা দেখতে পায়, মামলার আসামিরা কেউই অপহরণের সঙ্গে জড়িত না। সিআইডি চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়ার পর বাদী মোজাফ্ফর আদালতে না-রাজি আবেদন করেন। এরপর আদালত পুনরায় ডিবিকে মামলাটির তদন্তভার ন্যস্ত করে। ২০১৩ সালে সুমনকে উদ্ধারে ফের কাজ শুরু করে ডিবি। তবে তারা কোনও হদিস করতে পারেনি।

ডিবি তদন্তকালে জানতে পারে, সুমনের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি এজাহারে থাকা আসামি মো. সুলায়মান এডিসি ক্যাম্পে অবস্থিত কাঁচা বাজারের জুয়ার বোর্ড থেকে কিনে নেন। এর ডিবি ২০১৯ সালের ২৬ এপ্রিল মামলার চূড়ান্ত রিপোর্ট দেয়। এবারও বাদী আদালতে না-রাজি দেন। আদালত ২০১৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মামলার তদন্তভার পিবিআইতে ন্যস্ত করে।

আবু ইউসুফ জানান, পিবিআই’র পরিদর্শক মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে মামলাটি তদন্ত শুরু করেন। তিনি তদন্তের একপর্যায়ে জানতে পারেন যে, মামলার ভিকটিম সুমন নিখোঁজ হওয়ার ১১ দিন পর সন্ধ্যায় তার বাবার মোবাইল নম্বরে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন আসে। সুমন নিজেই সেই ফোনটি করেছিল। তবে তার অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে কোনও উত্তর না দিয়েই কলার ফোনটি রেখে দেন। এরপর থেকে মোবাইল নম্বরটি বন্ধ ছিল। পিবিআই তদন্তকালে ওই মোবাইল নম্বরের মালিককে খুঁজতে থাকে। এক পর্যায়ে জানা যায়, ওই মোবাইল নম্বরটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশবিদ্যালয়ের স্যানিটারি ইন্সপেক্টর আব্দুল হাই (৪৫) নামে এক ব্যক্তির। এরপর তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

তিনি জানান, মোবাইলের সিমটি তার নামে থাকলেও তিনি ব্যবহার করতেন না। তার দূর-সম্পর্কের ভাগনে মো. সালাউদ্দিনকে দিয়ে তিনি এই মোবাইল সিম দিয়ে শাহবাগ থানার সামনে ফ্লেক্সিলোডের দোকান করাতেন। পরবতীকালে ভাগনে সালাউদ্দিনকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, অনেক অপরিচিত লোক দুই টাকা মিনিটে কথা বলতো বিধায় কে কল করেছিল, তা তিনি শনাক্ত করতে পারেননি। এখানে একটি ক্লু পেলেও সুমনের অবস্থান তখনও জানতে পারেনি পিবিআই। ভিকটিমের অবস্থান নিশ্চিত করতে তারাও ব্যর্থ হয়। তবে ভবিষ্যতে ভিকটিমকে উদ্ধার সংক্রান্ত কোনও সূত্র বা তথ্য পাওয়া গেলে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করা হবে— উল্লেখ করে তারাও মামলার চূড়ান্ত রিপোর্ট দেয় আদালতে।

সোমবার (২৩ মে) সুমনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পান পিবিআই’র পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম। আদালতে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করা জন্য আবেদন করেন। এরপর ওই দিনই সন্ধ্যায় ঢাকার কদমতলী থানার মদিনাবাগ এলাকা থেকে সুমনকে উদ্ধার করা হয়।

সুমন পিবিআইকে জানান, তিনি মিরপুরের শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর ডায়মন্ড প্যাকেজিংয়ে হেলপার হিসেবে কাজ করেন। ঘটনার দিন মিরপুর-১১ নম্বর বাজার এলাকার চার রাস্তার মোড়ে তিন তাসের জুয়া খেলায় ১০০ টাকা ধরে হেরে যান। তার কাছে নগদ টাকা না থাকায় জুয়ারিরা জোর করে তার মোবাইল ফোনটি রেখে দেয়। মোবাইলের বিষয়ে বাবার কাছে সে কী সদুত্তর দেবে, এই ভয়ে মিরপুর থেকে গুলিস্থানে চলে যাযন। সারা দিন ও রাতে গুলিস্তানে ঘোরাফেরা করেন। পরদিন সকালে বায়তুল মোকাররম মসজিদে শুয়ে থাকেন। সেখান থেকে এক লোক তাকে শাহবাগের ফুলের মার্কেটে নিয়ে গিয়ে নাস্তা খাওয়াযন। পরে টিপু নামে এক লোক তাকে শাহবাগ এলাকার একটি রেস্তোরাঁয় শুধু থাকা ও খাওয়ার শর্তে কাজ দেন। ওই হোটেলের বাবুর্চি হারুনের সঙ্গে সুমনের বন্ধুত্ব হয় এবং তার সঙ্গে ভোলার লালমোহন থানার মঙ্গল শিকদার এলাকায় একাধিকবার বেড়াতে যান। পরে শাহবাগ এলাকায় বিভিন্ন চটপটির দোকানে কাজ করেন সুমন। এছাড়া পপকর্ন বিক্রি, বাসের হেলপার, রুমা অ্যাকুরিয়াম সেন্টার, পপুলার অ্যাকুরিয়াম সেন্টারসহ বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেন। এরই মধ্যে নান্নু ওস্তাদ নামে এক ড্রাইভারের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তার সঙ্গে তিনি হেলপারিও করেন। নান্নু ওস্তাদের হয়ে ইউসুফ টেকনিক্যাল স্কুল ও বারডেম হাসপাতালের যাত্রী আনানেওয়া করতেন। তখন ইউসুফ স্কুলের ছাত্রী জোনাকি নামে একটি মেয়ের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক ছিল। সেই সুবাদে তাদের বাসায় যেতেন। একপর্যায়ে জোনাকির মা জোসনার সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক হয়। জোসনার স্বামী বকুল মোল্লা তার স্ত্রীকে ডিভোর্স দিলে ভিকটিম সুমন প্রায় ৩ বছর আগে লালবাগ কাজী অফিসে গিয়ে জোসনাকে বিয়ে করেন। তাদের একটি ছেলে রয়েছে, নাম হাবিবুল্লাহ (৩ মাস)। সুমন তার স্ত্রী জোসনাকে নিয়ে রায়েরবাগ এলাকায় বসবাস করে আসছিলেন।

আমারসংবাদ/আরএইচ

Link copied!