Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ১৬ জুন, ২০২৫,

খেলাপি ঋণ বেড়ে ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা

আমার সংবাদ ডেস্ক

আমার সংবাদ ডেস্ক

জুন ১৫, ২০২৫, ০৮:১৯ পিএম


খেলাপি ঋণ বেড়ে ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা

ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ এখন এক বিপজ্জনক রেকর্ডে পৌঁছেছে। ২০২৫ সালের মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। এতে বিতরণকৃত ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশই খেলাপি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আওয়ামী লীগ পতনের পর খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র উঠে আসায় খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ৮ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা। গতকাল রোববার প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, রাঘববোয়াল ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের লুটপাটের ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ছে বলে এখন তা বাড়ছে। এসব ব্যাংকখেকোরা আগেও ঋণ খেলাপি ছিল। কিন্তু প্রভাবশালী হওয়ায় ব্যাংকগুলো তাদের ঋণ খেলাপি দেখাতে পারত না। আড়াল করে রাখত। ৫ আগস্ট-পরবর্তী কিছুটা সুযোগ এসেছে বলেই আংশিক তথ্য বেরিয়ে আসছে। তবে এটাও প্রকৃত তথ্য নয়। প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৭ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৫ সালের মার্চ শেষে মোট বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। যা বিতরণ করা মোট ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। সে হিসেবে তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা।

২০২৪ সালের মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। যা তৎকালীন সময়ের বিতরণকৃত ঋণের ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। সে হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ৩৮ হাজার ৪০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর নতুন গভর্নরের নেতৃত্বে জুন প্রান্তিকের খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময় দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিলো ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা। তাড়াহুড়ো করে ওই সময় খেলাপির তথ্য প্রকাশ করায় প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা যায়নি। এরপর নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ব্যাংকগুলোকে খেলাপির প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার নির্দেশ দেন। এতে সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৩ মাসে খেলাপি বেড়েছে ৭৩ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। পরের প্রান্তিকে সরকারের কড়াকড়ির কারণে খেলাপি আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা। আর গত মার্চ পর্যন্ত এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ খেলাপির প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার নির্দেশে নতুন সরকারের আমলে খেলাপি বেড়েছে ২ লাখ ৮ হাজার ৯৪৩ কোটি কোটি টাকা।

গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ বলেন, ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর লুকানো খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে। অবলোপন, পুনঃতফসিল ও মামলার অন্তর্ভুক্ত ঋণ ধরলে খেলাপি আরও বাড়বে। আগের সরকারের আমলে অনেকে একটি কোম্পানি দেখিয়ে একাধিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। কোন কোন ক্ষেত্রে প্রভাব খাটিয়ে ঋণকে খেলাপি করতে দেননি। এজন্য এখন খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এছাড়া অসংখ্য প্রতিষ্ঠান তৈরি করে অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন এসব প্রভাবশালী। দুর্বল ব্যাংকে ব্যাপক দুর্নীতিও হয়েছে। তাই ব্যাংক ও ব্যবসায়ী উভয়েই দায় এড়াতে পারেন না।

এছাড়া খেলাপি কমাতে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন, প্রয়োজন হলে ব্যাংকের সংখ্যা হ্রাস, বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর তদারকি এবং জামানতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন। সম্পদসমৃদ্ধ খেলাপি ঋণ বাজেয়াপ্ত করে বিক্রি করা, টাস্কফোর্সের কার্যক্রম দৃশ্যমান করা এবং পাচারকারীদের বিরুদ্ধে মামলা ও বিচার নিশ্চিত করার ওপর তিনি জোর দেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ ১৯ হাজার ৭০২ কোটি টাকা। এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ। একই সময়ে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে ১৩ লাখ ১০ হাজার ৩৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৬৪ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২০ দশমিক ১৬ শতাংশ। আর বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ৪৪ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা। এসব ঋণের মধ্যে খেলাপি হয়ে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এছাড়া বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলো মার্চ পর্যন্ত ৬৭ হাজার ১৩ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এসব ঋণের মধ্যে খেলাপি পরিমাণ ৩ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ।

জানা যায়, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ও সমালোচিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া ব্যাংকগুলো ঋণের প্রকৃত চিত্র দেখাতে শুরু করেছে। তাদের মধ্যে ইসলামী ব্যাংকে খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। একইভাবে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেশ বেড়েছে। পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ, নাসা গ্রুপসহ আরও কয়েকটি বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এখন ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ব্যাংক খাতে বর্তমানে প্রভিশন সংরক্ষণ করার কথা ছিলো ২ লাখ ৭৫ হাজার ১০৩ কোটি টাকা। কিন্তু ব্যাংকগুলো সংরক্ষণ করেছে ১ লাখ ৪ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। সে হিসেবে ব্যাংক খাতের বর্তমান প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। এছাড়া ব্যাংক খাতে ক্ষতিজনক মানের মন্দ ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ ৪২ হাজার ৬৪ কোটি টাকা।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের সময় খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। সেই জায়গা থেকে আজ তা প্রায় ২০ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৪ লাখ কোটির ঘরে পৌঁছেছে।

আরএস

Link copied!