Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

জাবির আবাসিক হলগুলোতে চরম আসন সংকট

মোসাদ্দেকুর রহমান, জাবি প্রতিনিধি

মোসাদ্দেকুর রহমান, জাবি প্রতিনিধি

আগস্ট ১৩, ২০২২, ০৪:১৮ পিএম


জাবির আবাসিক হলগুলোতে চরম আসন সংকট

দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় খ্যাত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) আবাসন সংকট চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। নিয়মানুযায়ী প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে একটি আসন থাকার কথা থাকলেও তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে হল প্রশাসন। ফলে তীব্র আসন সংকটের দরুন এ বিশ্ববিদ্যালয়টি তার আবাসিক চরিত্র হারাচ্ছে এবং ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক জীবন-যাপন। বিগত বছরগুলোতে ভর্তি হওয়ার পর নবীন শিক্ষার্থীরা হলের গণরুমে থাকতে পারলেও বর্তমানে অনেক শিক্ষার্থীকে গণরুমে জায়গা না পেয়ে ক্যাম্পাসের আশেপাশে মেস ভাড়া নিয়ে থাকতে হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলে ও মেয়েদের পৃথক ৮টি করে ১৬ টি আবাসিক হল রয়েছে। এতে আসন রয়েছে ৮ হাজার ২৭৮টি। তবে এর বিপরীতে বৈধ শিক্ষার্থী (৪৫ থেকে ৫০ ব্যাচ) রয়েছে প্রায় ১২ হাজার ৯ শত ৩৮ জন। তবে হলগুলোতে অবস্থান করছে অনেক অবৈধ শিক্ষার্থী। 
ছেলেদের ৮ হলে ৫ হাজারের মতো আসন থাকলেও প্রায় সবগুলো হলেই অবস্থান করছে ধারণক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ শিক্ষার্থী। সেশনজট, বেকারত্ব, সিট ছাড়ার ব্যাপারে ছাত্রত্ব শেষ হওয়া শিক্ষার্থীদের সদিচ্ছার অভাব, হল প্রশাসনের যথাযথ মনিটরিং না থাকা ও ছাত্রত্ব শেষ হওয়া শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগে বাধ্য করতে না পারা সহ ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র রাজনীতির প্রভাব খাটিয়ে দীর্ঘদিন হলে অবস্থান প্রভৃতি কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া নির্ধারিত সময়ে নতুন ৬ হলের কাজ শেষ না করতে পারাকেও দায়ী করছেন অনেকে।

অনেকেই অভিযোগ করেছেন প্রবীণ শিক্ষার্থীদের কারো কারো রাজনৈতিক ক্ষমতার কাছে নতজানু হল প্রশাসন। বেগম সুফিয়া কামাল হল ব্যতীত আসন সংকট সমস্যা মেয়েদের হলগুলোতেও। মেয়েদের কয়েকটি হলে কিছু শিক্ষার্থী আসন পেলেও অনেকেই অবস্থান করছে গণরুমে। এছাড়া প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরাও বিভিন্ন হলের গণরুমে ও ক্যাম্পাসের পাশে বিভিন্ন ভাড়া বাসায় অবস্থান করছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসের তথ্যমতে, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৪ ব্যাচের (২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষ) ৩৪টি বিভাগের মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এর মধ্যে ৩০টি বিভাগের ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। সেই হিসেবে বর্তমানে ৪৫ ব্যাচ থেকে ৫০ ব্যাচের (২০১৫-১৬ থেকে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ) শিক্ষা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তবে হলগুলোতে ঘুরে দেখা যায় এখনও ৪১, ৪২, ৪৩ ও ৪৪ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা হলে অবস্থান করছে। কেউ কেউ চাকরি পেয়েও ছাড়ছেন না হল। আবার এদের কেউ কেউ একাই দখল করে আছেন দুই কিংবা চারজনের রুম।

এদিকে ছাত্রত্বের মেয়াদ শেষ হওয়া শিক্ষার্থীরা হল ত্যাগ না করায় অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, ‘প্রবীণরা হল ত্যাগ না করে সিট ধরে রাখাই সংকটের অন্যতম কারণ। একারণে এখন গণরুমেও থাকার জায়গা নাই।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আবাসিক হলগুলো ঘুরে দেখা যায়, গণরুমে মানবেতর জীবন-যাপন করছে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা। কোনো হলে ছাত্রসংসদ, কোথাও হলের ডাইনিং কিংবা কমনরুমে কোন রকমে দিন-রাত পার করতে হচ্ছে তাদের। আবার কোনো হলে থাকার জায়গা না পেয়ে মেস ভাড়া নিতে হয়েছে তাদের। এখনও আসন পায়নি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরাও। মিনি গণরুম নামে চারজনের কক্ষে একসাথে ১০-১৫ জন করে থাকতে হচ্ছে তাদের। এছাড়া অনেক হলে তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদেরকেও চারজনের কক্ষে ৬-৮ জন মিলে থাকতে হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘এবার বঙ্গবন্ধু হলে ১৫০ জনের বেশী শিক্ষার্থীকে এলটমেন্ট দেয়া হয়েছে। ছাত্র সংসদ কক্ষে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রুম ছোট হওয়ায় ত্রিশ জন গাদাগাদি করে থাকছি। বাকিরা জায়গা না পেয়ে ক্যাম্পাসের আশে-পাশে মেস ও আত্মীয়দের বাসায় আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়া প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও চুরি হচ্ছে। ঈদে বাড়ি থেকে এসে দেখি তিনটি ফ্যান চুরি হয়ে গেছে। রিডিং রুমে পর্যাপ্ত আসন না থাকায় পড়ার সুযোগও হয় না।’

একই শর্তে শহীদ সালাম বরকত হলের দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘দ্বিতীয় বর্ষ প্রায় শেষের পথে। এখনও সিট পাইনি। হলে পড়ালেখার পরিবেশ নাই। রিডিং রুমেও জায়গা পাওয়া যায় না। একই অবস্থা লাইব্রেরীতেও। যতই দিন যাচ্ছে হতাশা বাড়ছে।’

এক্ষেত্রে হল প্রশাসনের অদক্ষতাকেও দুষছেন প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরাসহ অংশীজনরা। তারা দাবি করেছেন, ‘হল প্রশাসনের দায়িত্ব হলের দেয়ালে হল ত্যাগের নোটিশ টাঙানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এর বাইরে হল প্রশাসন হল গুলোতে কতগুলো সিট খালি রয়েছে তা কখনও মনিটরিং করেছে কিনা এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। গণরুমগুলোতেও হর-হামেশাই চুরি হচ্ছে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। এ নিয়েও নেই কোন মনিটরিং।’

ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের সভাপতি রাকিবুল রনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ঠিক সময়ে কাজ শেষ করলে নতুন ব্যাচগুলোর শিক্ষার্থীদের গণরুমে থাকতে হতো না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি লাঘব করার চেয়ে বড় বড় বিল্ডিং করার চিন্তা বেশী। তারা যদি শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করতো তাহলে দ্রুততম সময়ে হলগুলোর কাজ শেষ করার প্রতি মনোযোগ দিত। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে প্রায় ১৫ হাজারের মতো শিক্ষার্থী অবস্থান করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে রানিং ব্যাচ পাঁচটি। সেই হিসেবে শিক্ষার্থী থাকার কথা দশ হাজারের মতো। এর বেশী শিক্ষার্থীরা অবশ্যই মেয়াদ শেষ হওয়া অথবা বাইরের কেউ।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রত্যেকটি হলে সিট বণ্টনের ক্ষমতা ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের হাতে। ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতাদের কাছে বিভিন্ন সভায় আমরা এটাও শুনি যে আপনারা সারারাত যাতে ঘুমাতে পারেন এজন্য আমরা জেগে থাকি, সিট বণ্টন করে থাকি। অথচ এই দায়িত্ব হওয়ার কথা হল প্রশাসনের। সবকিছু মিলিয়ে এটা মনে করি যে হল প্রশাসন আসলে আন্তরিক নয় ও প্রশ্নের বিষয় যে হল প্রশাসন অপারগ কিনা তাদের দায়িত্ব পালনে তা বোধগম্য নয়।’

আসন সংকট নিরসনে কোন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে হল প্রভোস্ট কমিটির সভাপতি ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুল হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক আব্দুল্লাহ হেল কাফী বলেন, ‘নতুন হলগুলোর কাজ শেষ হলে সিট সংকট কমে যাবে। আশা করি দ্রুতই হলগুলোর কাজ শেষ হবে। আমার হলে ছাত্রত্ব শেষ হওয়া কোন শিক্ষার্থী নেই। এছাড়া ছাত্রত্ব শেষ হওয়া শিক্ষার্থীদের এখন হলে থাকার কোন অধিকারও নেই। অন্য কোন হলে থাকলে আমাদের জানালে আমরা ব্যবস্থা নিবো।’

বিভিন্ন শিক্ষার্থীদের তথ্য মতে হলগুলোর অনেক রুমেই এক বা দুটি করে সিট খালি রয়েছে। হলগুলোতে কয়টি সিট খালি আছে তা নির্ধারণের জন্য কোন মনিটরিং ব্যবস্থা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সিট খালি আছে কিনা তা বলতে পারছি না। সিট’ই পাওয়া যায় না সিট খালি থাকবে কিভাবে?’

সিট সংকট নিরসনে এখন কি পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে এ বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাময়িক উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলমের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।

আমারসংবাদ/এসএম

Link copied!