Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ০৪ জুন, ২০২৫,

জামায়াত নিবন্ধন ফেরত পেলেও দাঁড়িপাল্লা প্রতীক পাবে কীভাবে?

আমার সংবাদ ডেস্ক

আমার সংবাদ ডেস্ক

জুন ২, ২০২৫, ১০:৩৮ এএম


জামায়াত নিবন্ধন ফেরত পেলেও দাঁড়িপাল্লা প্রতীক পাবে কীভাবে?

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণার হাইকোর্টের রায় বাতিল করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এর ফলে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) জামায়াতের নিবন্ধন ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে দলটির প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ ব্যবহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে ইসি।

২০১৩ সালে হাইকোর্ট জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছিল। তবে ২০১৬ সালে ফুল কোর্ট সভার সিদ্ধান্তে দাঁড়িপাল্লা প্রতীক বাতিল করা হয়, যা কোনো আদালতের রায় ছিল না। এ কারণে জামায়াত নিবন্ধন ফিরে পেতে আপিলের পাশাপাশি দাঁড়িপাল্লা প্রতীক বরাদ্দের জন্য আলাদা আবেদন করেছিল।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জামায়াতের দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নিয়ে বিতর্ক এবারই প্রথম নয়। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনের আগেও এ প্রশ্ন উঠেছিল, যদিও তখন বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়নি।

রোববার (১ জুন) আপিল বিভাগ জামায়াতকে নিবন্ধন ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে এবং ইসিকে দাঁড়িপাল্লা প্রতীক ব্যবহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বলেছে।

তবে নির্বাচন কমিশন সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে ইসির প্রতীকের তালিকায় দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নেই। তাই এখনই জামায়াতকে এই প্রতীক দেওয়ার আইনি সুযোগ কম। ইসিকে বিধিমালায় সংশোধন এনে আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং শেষে গেজেট আকারে প্রকাশ করতে হবে, যা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ জানিয়েছেন, আদালতের রায় অনুযায়ী আইন বা বিধি মোতাবেক তারা পরবর্তী প্রক্রিয়া গ্রহণ করবেন।

যেভাবে দাঁড়িপাল্লা হারায় জামায়াত

১৯৮৬ সালে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দলীয় প্রার্থীদের জন্য প্রতীক হিসেবে ‘দাঁড়িপাল্লা’ বরাদ্দের জন্য আবেদন করে নির্বাচন কমিশনে।

পরে আবেদনের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তৎকালীন নির্বাচন কমিশন নির্বাচনি প্রতীক হিসেবে ‘দাঁড়িপাল্লা’ প্রতীকটি বরাদ্দ দেয় জামায়াতকে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, জামায়াতের প্রতীক নিয়ে ১৯৮৬ সালেও বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। তখন তারা বলেছে, এটা তাদের অনেক পুরানো প্রতীক। এই প্রতীক নিয়েই ১৯৭০ সালেও ভোট করেছিল। ইসি তখন এই প্রতীক বহাল রেখেছিল।

এরপরে দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লা নিয়ে পরপর আরও পাঁচটি সংসদীয় নির্বাচনে অংশ নেয় জামায়াত। এতে কখনো জোটবদ্ধভাবে, কখনোবা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নেয় দলটি।

২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশন যখন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন চালু করে তখনও চাহিদা অনুযায়ী দাঁড়িপাল্লা প্রতীক দেয়া হয় জামায়াত ইসলামীকে।

হাইকোর্টে এক রিটের আদেশের ২০১৩ সালে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করা হয়। পরে তাদের নিবন্ধন বাতিল করে নির্বাচন কমিশন।

২০১৬ সালে রাজনৈতিক দল বা প্রার্থীকে প্রতীক হিসেবে দাঁড়িপাল্লা বরাদ্দ না দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) চিঠি দেন সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। যদি কাউকে বরাদ্দ দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে ওই বরাদ্দ বাতিলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়।

চিঠিতে আরও বলা হয়, এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতিদের উপস্থিতিতে ফুল কোর্ট সভায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহীত হয়েছে, ‘দাঁড়িপাল্লা’ ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের মনোগ্রামে ব্যবহৃত হবে। অন্য কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাজনৈতিক সংগঠনের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার না করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও বলা হয় নির্বাচন কমিশনকে।

জামায়াতের আইনজীবী শিশির মনির বলেন, তখন একটা ভিন্ন এজেন্ডাকে সামনে নিয়ে কাজটা করা হয়েছিল। ফুলকোর্ট সভার স্টাটাস হলো- প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। এটা কোনো বিচারিক সিদ্ধান্ত না।

তখন উচ্চ আদালতের চিঠির প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ৯ মার্চ ‘দাঁড়িপাল্লা’ প্রতীক বাদ দিয়ে নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা, ২০০৮ সংশোধন করে গেজেট প্রকাশ করে ইসি। ফলে নির্বাচনে দল বা প্রার্থীর প্রতীক হিসেবে দাঁড়িপাল্লা প্রতীক বাদ হয়ে যায়।

প্রতীক ফেরত আসতে পারে কীভাবে?

পাঁচই অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর জামায়াতে ইসলামী নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। একই সাথে দলটি প্রতীক বরাদ্দ বিষয়ে একটি আবেদন দেয় ইসিতে। সেখানে দলটি তাদের দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লার বিষয়ে আদালতের একটি পর্যবেক্ষণ চায়।

জামায়াতের আইনজীবী শিশির মনির বলেন, সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু তখনকার ইসি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত পাওয়ার পরেই প্রতীকের তালিকা থেকে দাঁড়িপাল্লা বাদ দিয়ে দিয়েছে। সে জন্য আমরা আপিল বিভাগের কাছে একটা পর্যবেক্ষণ চেয়েছিলাম। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত দলটির নিবন্ধনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার পাশাপাশি দলীয় প্রতীকের বিষয়েও নির্বাচন কমিশনকে সিদ্ধান্ত নিতে বলেছে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জাহেদ ইকবাল বলেন, এই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো আদালতে না গড়ানোই ভালো ছিল।

এখন জামায়াতকে দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লা ফেরত দেয়ার প্রক্রিয়া শেষ হতে কত সময় লাগতে পারে, সেই প্রশ্ন সামনে আসছে।

নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী বলেন, কোর্টের যে আদেশ থাকবে তার প্রেক্ষিতে বিধিমালাতে এটা অন্তর্ভুক্ত করবে ইসি। বিধিমালায় যুক্ত করার পর খসড়া আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে ইসি। ভেটিং শেষে আইন মন্ত্রণালয় থেকে ফেরত আসলেই গেজেট করতে পারবে নির্বাচন কমিশন।

তবে ঠিক কতদিন সময় লাগবে সেটি এখনই বলছে না নির্বাচন কমিশন। কমিশন বলছে, আদালতের আদেশের সার্টিফাইড কপি আসলেই প্রক্রিয়া শুরু করে থাকে ইসি।

নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেন, আইন বা বিধিতে যা আছে সেই অনুযায়ী সব সিদ্ধান্ত হবে।

নিবন্ধন নিয়ে সংকট শুরু যেভাবে

২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় জামায়াতে ইসলামীকে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন দেয় নির্বাচন কমিশন। পরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসার পরের বছর বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের তৎকালীন সেক্রেটারি সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীসহ কয়েকজন ওই নিবন্ধন দেওয়ার সিদ্ধান্তের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন।

২০০৯ সালে করা ওই রিটের ওপর শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ০১ আগস্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় হাইকোর্ট।

নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী একই বছর আপিল দায়ের করে। পরে ২০২৩ সালের ১৯শে নভেম্বর আপিলকারী উপস্থিত না থাকায় মামলাটি খারিজ করে আদেশ দেয় আপিল বিভাগ। আপিলকারীর পক্ষে সেদিন কোনো আইনজীবী না থাকায় আপিল বিভাগ ওই আদেশ (ডিসমিসড ফর ডিফল্ট) দেন। পরে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এই মামলায় দেরি মার্জনা করে আপিল ও লিভ টু আপিল পুনরুজ্জীবিত চেয়ে দলটির পক্ষ থেকে পৃথক আবেদন করা হয়।

শুনানির পর গত বছরের ২২ অক্টোবর আপিল বিভাগ আবেদন মঞ্জুর (রিস্টোর) করে আদেশ দেন। এরপর জামায়াতের আপিল ও লিভ টু আপিল শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় ওঠে। কয়েক দফা শুনানি শেষে রোববার এ বিষয়ে রায় দেয় আপিল বিভাগ।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, নিজ দলের প্রতীক নিয়ে ভোটে অংশ নিতে হলে ইসির নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। বর্তমানে ইসিতে নিবন্ধিত দলের সংখ্যা ৫০টি। এজন্য দলগুলোর বিপরীতে ৫০টি প্রতীক সংরক্ষণ করেছে ইসি। আর স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য ২৫টি প্রতীক সংরক্ষণ করেছে সংস্থাটি। সেখানে কোথাও দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নেই। 

সূত্র: বিবিসি বাংলা

ইএইচ

Link copied!