Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

ঝুঁকিতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা

রেদওয়ানুল হক

জুলাই ৬, ২০২২, ১২:৪১ এএম


ঝুঁকিতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা

গত বছরের মতো এবারও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোরবানি না করে টাকা গরিবদের মাঝে দান করে দেয়ার প্রচারে মুখর একটি পক্ষ। তবে অন্য পক্ষ বলছে, এ ধরনের প্রচারের কোনো ভিত্তি নেই। 

কারণ যারা দান করবে, কোরবানি তাদের জন্য বাধা হবে না। এ ধরনের প্রচারের ক্ষেত্রে আগের বছর করোনা সংক্রমণের ঝুঁকির কথা বলা হলেও এবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সাহায্যের বিষয়টি সামনে আনা হয়েছে। 

এ প্রসঙ্গে আলেমরা বলছেন, কোরবানি না করে টাকা দান করে দেয়ার সুযোগ নেই। এতে একদিকে যেমন ধর্মীয় বিধান লঙ্ঘন হবে, অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পশু পালন করা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা। পাশাপাশি দেশের ট্যানারি ব্যবসায়ও এর বড় প্রভাব পড়তে পারে। 

এছাড়া দুর্গত এলাকায় কোরবানি দিয়ে গোশত দান করারও সুযোগ রয়েছে। তাই এ ধরনের নেতিবাচক প্রচার চতুর্মুখী অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। 
 
সরকারি হিসাবে এ বছর কোরবানিযোগ্য এক কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজারের বেশি গবাদিপশু প্রস্তুত রয়েছে। গত বছর এক কোটি ১৯ লাখ গবাদিপশু প্রস্তুত ছিল, তার মধ্যে প্রায় ৯১ লাখ গবাদিপশু কোরবানি হয়েছে। 

জানতে চাইলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মনজুর মোহাম্মদ শাহজাদা আমার সংবাদকে বলেন, এ বছর চলাচলে কোনো বিধিনিষেধ না থাকায় গত বছরের চেয়ে কোরবানি বেশি হবে বলে আমরা আশা করছি। এবার কোরবানিযোগ্য পশুর মধ্যে গরু-মহিষ রয়েছে ৪৬ লাখ, ছাগল-ভেড়া ৭৫ লাখ এবং অন্যান্য পশু রয়েছে ১৪ হাজার। 

কোরবানির উদ্দেশ্যে সারা দেশে খামারি, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও ব্যক্তি উদ্যোগে এসব পশু পালন করা হয়েছে। অনেকে কোরবানির পশু বিক্রি করে ধারদেনা পরিশোধ করবেন। আবার কেউ ব্যবসায়ের কাজে বিনিয়োগ করবেন। ব্যক্তি পর্যায়ে পশু বিক্রি করে অনেকে ঈদের কেনাকাটা ও পরিবারের অন্যান্য ব্যয় নির্বাহ করবেন। 

বিশেষ করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে পশু পালন করেছেন, এখন পশু বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করবেন এবং লভ্যাংশের টাকা পুনরায় বিনিয়োগ করবেন। নেতিবাচক প্রচারের কারণে মানুষ কোরবানি থেকে বিরত থাকলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এসব উদ্যোক্তা। 

অন্যদিকে কোরবানি উপলক্ষে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার পশু বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে পশু বাজারজাত করেছেন খামারিরা। বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সাধারণ সম্পাদক শাহ এমরান আমার সংবাদকে বলেন, ছোট-বড় খামার ও গৃহপালিত মিলে এক কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার ৩৮৯টি কোরবানিযোগ্য গবাদিপশু প্রস্তুত রয়েছে।

 গড় হিসাবে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হবে বলে আমরা ধারণা করছি। নেতিবাচক প্রচারে প্রভাব ফেলবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনকার ব্যবসা কোরবানিকে কেন্দ্র করে। মানুষ যদি কোরবানিই না করে, তাহলে আমাদের ব্যবসা হবে না— এটাই স্বাভাবিক। তবে এ ধরনের প্রচারে প্রভাব পড়বে কি-না তা বলা যাচ্ছে না। 

কোরবানি নিয়ে নেতিবাচক প্রচারের কোনো ধর্মীয় ভিত্তি নেই বলে মনে করেন শীর্ষস্থানীয় আলেমরা। তাদের স্পষ্ট মত হলো, পশু কোরবানি করা একটি ইবাদত। আর অসহায় যারা রয়েছেন, বিশেষ করে বন্যা পরিস্থিতির কারণে তাদের আর্থিক সাহায্য করা সেটা আরেকটি ইবাদত। দুটোই ভিন্ন ইবাদত। কোরবানি ওয়াজিব— এটা তাকে করতেই হবে। মূলত কোরবানি বন্ধ করে দান করা যাবে না। তাহলে কোরবানি আদায় হবে না। 

তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসার সহকারী অধ্যাপক মুফতি মুহাম্মাদ আবুল কাসেম গাজী আমার সংবাদকে বলেন,  কোরবানি বন্ধ করে দান করা যাবে না।  কোরবানি হানাফি মাজহাবের মতে ওয়াজিব, অন্যান্য মাজহাবের মতে সুন্নত। সুন্নাত হোক আর ওয়াজিব হোক, প্রায় সবাই কিন্তু কোরবানি সব সময় দেন। 

রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় ১০ বছর ছিলেন, তিনি নিয়মিত কোরবানি দিয়েছেন। তিনি বলেন, হজ না করে যেমন হজের টাকা  কাউকে দান করা যাবে না, তেমনি কোরবানি না করে পুরো টাকা কাউকে দান করা যাবে না। তাহলে কোরবানি আদায় হবে না। তবে একটা পদ্ধতি আছে, যেমন কেউ এক লাখ বা দুই লাখ টাকা কিংবা আরও বেশি দিয়ে কোরবানি দেন, তারা অর্থের সংখ্যাটা কমিয়ে অন্যকে দান করতে পারেন। 

তিনি বলেন, কোরবানি না করলে বরং ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা বেশি। যেমন- সবাই যদি কোরবানি না করে টাকা বন্যার্তদের দিয়ে দেয়, তাহলে আমাদের দেশের যেসব মানুষ কোরবানিতে বিক্রি করার জন্য পশু পালন করেছে, তাদের কী হবে।  অনেকেই ধারদেনা করে পশু পালন করেছেন; আবার অনেকে পশু বিক্রির টাকা দিয়ে জরুরি প্রয়োজন  মেটাবেন। 

এছাড়া এমনিতেই দেশের ট্যানারি/চামড়া ব্যবসা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। কোরবানিতে এ খাতে বড় ধরনের ব্যবসা হয়। নেতিবাচক প্রচারের কারণে যদি মানুষ কোরবানি না করে, তাহলে এ খাতের ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়বেন। একইসঙ্গে অনেক গরিব মানুষ আছে যারা সারা বছর গোশত কিনে খেতে পারে না, শুধু কোরবানির সময় এলেই তারা গোশত খেতে পারে। এসব মানুষ বঞ্চিত হবে। 

এছাড়া কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রির টাকা গরিব মানুষের হক। এটা থেকেও তারা বঞ্চিত হবে। সব মিলিয়ে বলা যায়— এ ধরনের প্রচার অবিবেচনাপ্রসূত। কেউ না বুঝে, আবার কেউ উদ্দেশ্যমূলক এ ধরনের প্রচার চলাচ্ছেন, যা চতুর্মুখী অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। একইসাথে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ আমলের বিরুদ্ধে এটি নেতিবাচক এক প্রচারণা।

অন্যদিকে  কোরবানির গোশত  কোরবানিদাতা গ্রহণ না করলেও কোনো অসুবিধা নেই। গোশত গরিবদের দিয়ে দিলে কোনো সমস্যা হবে না। কেউ যদি বন্যার্তদের সহায়তা করতেই চান, তাহলে দুর্গত এলাকায় কোরবানি দিতে পারেন। এখন যেসব খাদ্যদ্রব্য দুর্গত এলাকায় বিতরণ করা হচ্ছে, তার তুলনায় কোরবানির গোশত অধিক পুষ্টিকর। 

এছাড়া বন্যায় ঘরবাড়ি ভেঙে যাওয়ায় এবং দীর্ঘ সময় ধরে পানিতে প্লাবিত থাকায় পশুর খাবার নিয়ে বড় সমস্যায় পড়েছেন গৃহস্থরা। এসব পশু ন্যায্যমূল্যে কিনে দুর্গত এলাকায় কোরবানি দিলে একদিকে যেমন অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা, অন্যদিকে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটানো মানুষের পুষ্টিরও সংস্থান হবে। 

তাই বন্যাদুর্গত এলাকায় কোরবানি দিতে সবাইকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি শতাধিক পশু কোরবানির উদ্যোগ নিয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় ইসলামিক স্কলারদের সমন্বয়ে পরিচালিত সংস্থা আস্সুন্নাহ ফাউন্ডেশন। সংস্থাটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দুর্গত এলাকায় পশু কোরবানিতে অংশ নিতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রচার চালানো হচ্ছে। 

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের অনেক মানুষ আছে যারা টাকার অভাবে গোশত কিনে খেতে পারে না। কোরবানির সময় তারা গোশত খায়। এতে তাদের শরীরে পুষ্টি উপাদান জোগানের পাশাপাশি রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। কোরবানি উপলক্ষে দেশের বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠী সুষম খাদ্য খেতে পারে, যা তাদের খাদ্য অধিকারেরও সুরক্ষা দেয়। 

এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. এমএইচ চৌধুরী লেনিন আমার সংবাদকে বলেন, যদিও গোশতের বিকল্প হিসেবে কয়েক প্রকারের ডাল মিশ্রিত খাবার খেলে প্রোটিনের চাহিদা পূরণ হয়, তবুও কোরবানি উপলক্ষে দেশের বিশালসংখ্যক দরিদ্র মানুষ সরাসরি গোশতের প্রোটিন গ্রহণ করে থাকে— যা জনস্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। অন্য সময় টাকার অভাবে এসব দরিদ্র মানুষ দামি এ খাবারটি খেতে পারে না।
 

Link copied!