Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

পাঁচ দশকেও অক্ষম ইউজিসি

মুছা মল্লিক

আগস্ট ১৭, ২০২২, ০১:৩০ এএম


পাঁচ দশকেও অক্ষম ইউজিসি

দেশের জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তুলতে মানসম্মত উচ্চশিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৯৭৩ সালে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন-ইউজিসি। প্রতিষ্ঠাকালীন মাত্র ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কার্যক্রম শুরু করলেও সময়ের সাথে সাথে দেশের প্রায় পঞ্চাশের অধিক সরকারি ও শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেখভালের দায়িত্ব পায়।

নিয়মিত তদন্ত এবং তদন্তের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদনও দাখিল করে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু ইউজিসির অনুসন্ধানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লাগামহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ মিললেও সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে দেখা দেয় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। ফলে প্রতিষ্ঠার প্রায় পাঁচ দশক পার হলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনিয়মের তদন্ত আর সুপারিশ করাতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে সংস্থাটি।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অপরাধ করেও পার পাওয়ায় বিচারহীনতার এমন ক্রমবর্ধমান সংস্কৃতি একদিকে যেমন ইউজিসিকে ‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার’-এ রূপ দিয়েছে; অপর দিকে উচ্চশিক্ষা খাতেও এর বিরূপ প্রভাব ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।  উচ্চশিক্ষা খাতে নজিরবিহীন অনিয়ম হওয়ার পরও আইনের যথার্থ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে না পারার এমন শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন শিক্ষাবিদরা।

এদিকে উচ্চশিক্ষা খাতে অনিয়ম প্রমাণিত হওয়ার পরও যথাযথ ব্যবস্থা নিতে অপারগতা ও ক্ষমতাশূন্য অবস্থার কথা উঠে আসে খোদ ইউজিসির প্রতিবেদনেও। বিভিন্ন সময়ে দায়িত্ব পালন করা চেয়ারম্যানও ইউজিসির আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে সংস্থাটির ক্ষমতায়নের ওপর জোর দিয়েছিলেন। কিন্তু নানামুখী জটিলতায় সে উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি। ইউজিসিকে শক্তিশালী ও যুগোপযোগী করার করতে ক্ষমতায়নের জন্য বছর বছর সুপারিশ করা হলেও অদৃশ্য কারণেই ঠুঁটো জগন্নাথই থেকে যাচ্ছে উচ্চশিক্ষার নীতি-নির্ধারণী এ প্রতিষ্ঠানটি।

ইউজিসি সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যৌন হয়রানি, বিতর্কিত পরীক্ষা পদ্ধতি, মানহীন কারিকুলাম, তথ্য দিতে গড়িমসি, শিক্ষকদের দায়িত্বে অবহেলা, খণ্ডকালীন শিক্ষক দিয়ে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা, কোটা আইন অমান্যসহ উচশিক্ষার নানা অনিয়ম নিয়ে ইউজিসি তদন্ত করলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সে তদন্ত আর আলোর মুখ দেখে না। যেহেতু ইউজিসি সরাসরি কোনো ব্যবস্থা নিতে অক্ষম সেহেতু এ প্রতিষ্ঠান থেকে বারাবার সতর্ক করা হলেও তার প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।

এ প্রসঙ্গে ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী আমার সংবাদকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের তদারকি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কমিশনের আইনি ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা আগেও ছিল। প্রতিষ্ঠানটিকে আইনগতভাবে আরও কার্যকর ও শক্তিশালী করে অর্থবহ সংস্থায় রূপান্তর করা জরুরি। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির দক্ষ জনশক্তিও নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয় দেখভাল করার মতো আইনি সক্ষমতাও ইউজিসির নেই; আর জনবলও নেই।’

জানতে চাইলে ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান আমার সংবাদকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু যখন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন স্থাপন করেন সেখানে মাত্র ছয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। কিন্তু গত ৫০ বছরে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে পঞ্চাশের অধিক; অপর দিকে, বেসরকারির সংখ্যা ছাড়িয়েছে শতাধিক।

এই সময়ের মধ্যে মঞ্জুরী কমিশনকে যুগোপযোগী করে তোলার জন্য যে ব্যবস্থা নেয়ার দরকার ছিল তা সম্ভব হয়নি। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে— আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের মতো এ ধরনের ‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার’ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন আর কোথাও নেই। এমনকি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ আফগান ও ছোট দ্বীপরাষ্ট্র ফিজিতেও নেই।

সেখানে যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন বা হায়ার এডুকেশন কমিশন রয়েছে তারা অনেক ক্ষমতাশীল। আমাদের দেশের মঞ্জুরী কমিশনকেও বিভিন্ন সময় চেষ্টা করা হয়েছে যুগোপযোগী করে একটি হায়ার এডুকেশনে কমিশনে রূপ দেয়ার। কিন্তু নানা জটিলতায় সে পথ দুর্গম হয়ে পড়ে। তা ছাড়া শুধু মঞ্জুরি কমিশন চাইলেই হবে না; এখানে সরকারের একটি প্রক্রিয়া আছে। সেভাবেই এগোতে হয়।’

অধ্যাপক মান্নান বলেন, ‘আমি দায়িত্ব পালনকালে কমিশনকে আরও যুগোপযোগী করতে উদ্যোগ নিয়েছিলাম। আমার আগে আজাদ স্যারও চেষ্টা করেছিলেন। বিষয়টি সরকারের মন্ত্রিপরিষদে গিয়েছিল। মন্ত্রিপরিষদ বলেছিল— মঞ্জুরী কমিশনের একাডেমিক স্বায়ত্বশাসন নিরঙ্কুশ করার জন্য পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে যেভাবে কমিশন আছে সেভাবে কমিশনকে নির্বাহী ক্ষমতা দিয়ে (যেটা এখন একেবারেই নেই) আরও শক্তিশালী ও যুগোপযোগী করা প্রয়োজন। কিন্তু এ ধরনের আইন করতে গেলে সেখানে সিনিয়র সচিবরা থাকেন। আমার সময়েও একই কাজ হয়েছিল।

সচিব কমিটিতে গিয়েছিলেন। সচিবের সাথে আমাদের মঞ্জুরী কমিশনের সিনিয়র কর্মকর্তারা সেখানে আলোচনার পর যে খসড়া আইন করেছিলেন সেটা ছিল অনেকতা— ‘সচিব পুনর্বাসন কেন্দ্র’। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অপরাপর দশটি বিষয়ের সাথে শিক্ষাকে গুলিয়ে ফেললে হবে না। শিক্ষা যেহেতু জাতির মেরুদণ্ড সেই মেরুদণ্ডকে ভেঙে দেয়ার জন্য যা যা করা দরকার আমাদের আমলাতান্ত্রিক গ্যাঁড়াকলে তার সব কিছুই হচ্ছে। আমলারা আজকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও হয়ে যাচ্ছেন। এটি শিক্ষা খাতে হুমকি স্বরূপ। মঞ্জুরী কমিশন ৭৩ সালে যতটুকু শক্তিশালী ছিল এই আমলানির্ভরতায় সেটিও হারিয়েছে।

মঞ্জুরী কমিশন হয়ে গেছে এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি পোস্ট অফিস। কারণ-কমিশনের সদস্যরা অনেক ঝুঁকি নিয়ে অনেক তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করলেও তা বাস্তবায়ন করতে পারছেন না। তারা এসব প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়কে দিচ্ছে কিন্তু মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার পর বেশির ভাগ তদন্ত আর আলোর মুখ দেখছে না। তিনি আরো বলেন, ‘সব জায়গায় একটা আমলাতান্ত্রিক নির্যাস দেয়ার এ অভ্যাস আমাদের ছাড়তে হবে।

একই সাথে মঞ্জুরী কমিশনে যারা সদস্য হচ্ছেন তাদের যেন একাডেমিক ও প্রশাসনিক দক্ষতা থাকে সে বিষয়েও নজর দিতে হবে। মনে রাখতে হবে— মঞ্জুরী কমিশন একটি পৃথক আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। এটা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোনো অধিদপ্তর নয়। কিন্তু বর্তমানে মঞ্জুরী কমিশন একটি অধিদপ্তরে রূপ নিয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত মন্ত্রণালয় নির্ভরতা থেকে কমিশনকে বের করে আনা না যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত কমিশনের থেকে ভালো কিছু আশা করা যাবে না।

এ সম্পর্কে ইউজিসি চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগম আমার সংবাদকে বলেন, ‘ইউজিসি তদন্ত করার পর সে প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে দিচ্ছে। কিন্তু মন্ত্রণালয় সে তদন্ত সাপেক্ষে কি করবে সেটি তাদের বিষয়। এখানে ইউজিসির হাত নেই। কোনো অনিয়ম পেলেও ইউজিসির কিছুই করার নেই। আইনেও পদক্ষেপ সুযোগ নেই ইউজিসির। আইনি ক্ষমতা না থাকার কারণে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও অনিয়ম করে পার পাচ্ছে। আমরা শুধু আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছি।
 

Link copied!