Amar Sangbad
ঢাকা রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪,

রিজার্ভের হিসাব নিয়ে ধোঁয়াশা

মো. মাসুম বিল্লাহ

অক্টোবর ২৮, ২০২২, ০৫:০৫ এএম


রিজার্ভের হিসাব নিয়ে ধোঁয়াশা

রিজার্ভের হিসাবায়ন নিয়ে কি সিদ্ধান্ত হয়েছে সে বিষয়ে স্পষ্ট তথ্য দিচ্ছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে বাংলাদেশের সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণের বিষয়ে সংস্থাটির প্রতিনিধি দলের সাথে গতকাল দিনভর বৈঠক করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা। আর্থিক বিভিন্ন সূচক নিয়ে বৈঠক হলেও বেশি প্রাধান্য পেয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসাবায়ন পদ্ধতি। আগে থেকেই আপত্তি জানিয়ে আসা এ পদ্ধতি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হলেও সবশেষ কি সিদ্ধান্ত হয়েছে তা জানায়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

গতকাল সন্ধ্যায় এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জি এম আবুল কালাম আজাদ আমার সংবাদকে বলেন, ‘কি সিদ্ধান্ত হয়েছে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে এটুকু বলব যে, ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে।’ আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে ঋণের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে বলেও জানান তিনি।

এর আগে অক্টোবরে প্রথম দফা সফরে রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতি নিয়ে আপত্তি তোলে আইএমএফ। তখন আন্তর্জাতিক হিসাব পদ্ধতি অনুসরণ করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে পরামর্শ দেয় সংস্থাটি। এরপর দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কত, বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলের মধ্যে প্রশ্নের জন্ম দেয়।

আইএমএফ বলছে, রিজার্ভের হিসাব বেশি দেখানো হচ্ছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের দাবি আগে থেকে যেভাবে হিসাব হয়েছে সেই পদ্ধতিতেই রিজার্ভের গ্রস বা মোট হিসাবটাই প্রকাশ করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে বর্তমানে দেশে রিজার্ভের পরিমাণ ৩৫ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। তবে আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি অনুসরণ করলে যা কমে দাঁড়াবে ২৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। পক্ষব্যাপী সফরের দ্বিতীয় দিন গতকাল এসব বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করে আইএমএফ। সংস্থাটির সঙ্গে কয়েকটি সেশনে বৈঠক হয়।

মুখপাত্র জি এম আবুল কালাম আজাদ জানান, সকালে আইএমএফের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ ব্যাংকে আসে। তারা বেশ কয়েকটি সেশনে বিকাল পর্যন্ত বৈঠক করে। বৈঠকে রিজার্ভসহ সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, সকাল থেকে দিনভর বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ছয়টি সেশনে বৈঠক করে আইএমএফের প্রতিনিধি দল। এর মধ্যে তিনটি সেশনেই আলোচনা হয় রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতি নিয়ে।

দলের সদস্যরা গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান, ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট ও অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করেন। এছাড়া সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, সুশাসন, ব্যাংক খাতের পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করে সংস্থাটি।

মুখপাত্র জানান, আগামী ৩০ ও ৩১ অক্টোবর এবং ২ ও ৮ নভেম্বর সংস্থাটির সঙ্গে আবার বৈঠক হবে। ওই বৈঠকে যেসব বিষয়ে আলোচনা হবে তা সম্পর্কে বিস্তারিত জানাননি তিনি। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, আগামীতে অনুষ্ঠেয় বৈঠকগুলোতে রিসেন্ট মনিটরিং ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড আউটলুক, ইন্টারেস্ট রেট ডেভেলপমেন্ট, সরকারি বন্ড, মানেটারি এক্সচেঞ্জ রেট, রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট, ব্যাংকিং ইস্যুস, ব্যালেন্স অব পেমেন্ট, এক্সটার্নাল লোন ডিসবার্সমেন্ট আইএমএফ টিএ রিপোর্টস, রিসেন্ট ট্রেড পারফরমেন্স, রিসেন্ট এক্সচেঞ্জ পারফরমেন্স, রিস্ক বেসড সুপারভিশন এবং টেকনিক্যাল মিটিং অন এএমএলের বিষয়ে আলোচনা হবে।

এছাড়া ফাইন্যান্সিয়াল ডেটা, অন্যান্য বড় চ্যালেঞ্জ, বপ রেটেড ম্যাটার্স, মনিটারি পলিসি স্ট্র্যাটেজি, এক্সচেঞ্জ রেট প্রেসার, ইনস্টিটিউশনাল অটোনমি অ্যান্ড গভর্নেন্স, কমার্শিয়াল ব্যাংক পারফরম্যান্স এবং এফএসএপি আপডেটের বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হবে বলে জানা গেছে।

খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব হয় আইএমএফের ব্যালান্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন (বিপিএম-৬) ম্যানুয়াল অনুযায়ী। তবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের নিট ও মোট হিসাব করে বাংলাদেশ। নিট হিসাব থেকে ইডিএফসহ বিভিন্ন তহবিলে জোগান দেয়া অর্থ বাদ দেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের গ্রস বা মোট হিসাবটাই প্রকাশ করে। বিষয়টি নিয়ে দুই সংস্থার মধ্যে বিতর্ক চলছে। এ বিতর্ক শুরু হয় ২০২১ সালে। তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের সুরক্ষা মূল্যায়নের একটি খসড়া প্রতিবেদনে বিদেশি সম্পদের ভুল শ্রেণিকরণ চিহ্নিত করে আইএমএফ। এই ভুল শ্রেণিকরণের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের আকার বড় হয়েছে বলে দাবি করে আসছে আইএমএফ।

পরে গত বছরের ৩ থেকে ১৪ অক্টোবর সংস্থার একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা সফরের সময় হিসাব পদ্ধতি পরিবর্তন করে রিজার্ভের হিসাব করার পরামর্শ দেয়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে যা সংশোধন করার কথা। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো নিজেদের পদ্ধতি অনুসরণ করছে। সেই হিসাবে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) সরবরাহ করা  সাত বিলিয়ন ও শ্রীলঙ্কাকে দেয়া ২০ কোটি ডলার রিজার্ভে দেখাচ্ছে।

এছাড়া গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড (জিটিএফ) ২০ কোটি, লং টার্ম ফিন্যান্সিং ফ্যাসিলিটি (এলটিএফএফ) তহবিলে তিন কোটি ৮৫ লাখ, সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিমানকে চার কোটি ৮০ লাখ এবং ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের (আইটিএফসি) আমানত রিজার্ভে দেখাচ্ছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে রিজার্ভে যে অর্থ দেখানো হচ্ছে, সেখান থেকে ৮ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার বাদ যাবে বলে মনে করে আইএমএফ।

অর্থাৎ আইএমএফ পদ্ধতি অনুসরণ করে রিজার্ভ হিসাব করলে বর্তমান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশ করা মোট ৩৫ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ থেকে ৮ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার বাদ দিতে হবে। এতে রিজার্ভ নেমে দাঁড়াবে ২৭ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারে।

সমপ্রতি ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বার্ষিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। সভার এক ফাঁকে আইএমএফের সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল। আলোচনায় বাংলাদেশকে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়ার আশ্বাস পাওয়া গেছে বলে জানা যায়। তবে এ ঋণ তিন কিস্তিতে দেয়া হতে পারে। এরই ধারাবাহিকতায় আইএমএফের প্রতিনিধি দল গত বুধবার ঢাকায় এসেছে।

জানা গেছে, বাংলাদেশের জন্য আগামী ঋণ কর্মসূচি ছাড়াও আর্থিক খাতের সংস্কার, নীতি ও ব্যাকিং খাতের শৃঙ্খলা নিয়ে আলোচনা করতে আইএমএফের প্রতিনিধি দলটি ১৫ দিনের সফরে এসেছে। ঢাকায় অবস্থানের সময় অর্থ বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, পরিকল্পনা কমিশনসহ আরও কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠক করবে। এ সময় বাংলাদেশের জন্য আগামী ঋণ কর্মসূচি ছাড়াও আর্থিক খাতের সংস্কার, নীতি ও ব্যাকিং খাতের শৃঙ্খলা নিয়ে আলোচনা করবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

Link copied!